ইতিহাস ও ঐতিহ্যের খোঁজে মঞ্জুষা জাদুঘরে: ২য় পর্ব

চরকা; ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের প্রতীকছবি: লেখকের পাঠানো

ইতিহাস–ঐতিহ্যের প্রতি এক দুর্নিবার আকর্ষণ ছোটবেলা থেকেই। আজ থেকে হাজারো বছর আগের সময় কেমন ছিল, মানুষগুলো কেমন ছিল, তাঁদের জীবনযাত্রা কেমন ছিল—এসব জানার আগ্রহ আমাকে মোহমুগ্ধ করে রাখে। যা যা দেখছি, তা যেন আগামী প্রজন্মের কাছে, অনুসন্ধিৎসু ইতিহাসপ্রেমিকের কাছে রেখে যেতে পারি, তেমন একটা পথচলা শুরু করেছি নীরবে–নিভৃতে। শিক্ষকতার মতো পেশায় থেকে পরিবারের খরচ থেকে বাঁচিয়ে অল্প অল্প সঞ্চয়ে ড্রোন ক্যামেরা, ডিএসএলআর, আধুনিক স্মার্টফোন, অ্যাকশন ক্যামেরা, ছুটে চলার জন্য সস্তার একটি হিরো বাইক, মোটামুটি মানের একটি গ্যাজেট দাঁড় করিয়েছি বলা যায়। এবার ছুটে চলার পালা, কিন্তু বিধিবাম! হঠাৎ হৃদ্‌যন্ত্র বলে উঠল, তোমার বোধ হয় এবার একটু জিরোতে হবে, বুঝেশুনে পা দিতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শে মাস দুয়েক বিশ্রামে ছিলাম। স্ত্রীর চাপাচাপিতে চিকিৎসার জন্য ভারতে আসার জন্য রাজি হলাম। মূলত ভারত আমাকে টানে। কারণ, এখানকার ইটপাথর, অলিগলি ইতিহাসের কথা বলে। সেসব চর্মচক্ষে দেখার অনুভূতি, ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি! আহ, বলে বোঝানোর ভাষা জানা নেই।

সেসব তো ধারণ করব! কিন্তু সেসব যদি জানাতে না পারি, অতৃপ্তি থেকেই যায়। প্রথম আলোর ‘নাগরিক সংবাদ’ বিভাগে পাঠালাম। ভাবলাম হয়তো ধরতে পারে। পরের দিন চেক করে দেখি ‘সময় পথে কয়েক ঘণ্টা: পায়ানা ভিন্টেজ মিউজিয়াম: প্রথম পর্ব’ (https://nagorik.prothomalo.com/travel/z2xc28nfkv) ভারত সফরের প্রথম অভিজ্ঞতা ঝকমক করছে। অনুপ্রাণিত হলাম। এর ভেতর মহীশূর, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই—অনেক ঐতিহাসিক স্থান ঘোরা এবং ধারণ করা হয়ে গেছে। ফাঁকে ফাঁকে চিকিৎসাও চলছে। আজ দ্বিতীয় কিস্তিতে তুলে ধরতে চাই অতীতের যেসব উপায়–অনুসঙ্গ তৎকালীন জনগোষ্ঠীর জীবনকে গতিময় করে রাখত এবং সময়ের স্রোতে তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে সেসব জিনিস আর নেই, সেসব বিলুপ্ত জিনিসের বিশাল সংগ্রহশালা মঞ্জুষা জাদুঘর নিয়ে। মঞ্জুষা জাদুঘরটি ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের ধর্মস্থলে অবস্থিত, যা আট হাজারের বেশি বৈচিত্র্যময় পুরোনো নিদর্শন ও শিল্পকর্মের এক অসাধারণ সংগ্রহশালা। ড. ডি বীরেন্দ্র হেগড়ে কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ জাদুঘরে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, মুদ্রা, সরঞ্জাম, শিল্পবস্তুর সংগ্রহ স্থান পেয়েছে। জাদুঘরটির বর্ধিত একটি অংশ এক্সপ্রেসওয়ে–সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত, অনেকটা শাখা বলা যায়। হাজারো সংগ্রহের মধ্যে প্রথম দর্শনে মুগ্ধ হওয়া ১৩টি উপকরণ নিয়ে আজকের পর্ব সমাপন করব। প্রিয় পাঠক, ধান ভানতে শিবের গীত অনেক হয়েছে। এবার চলুন এগিয়ে যাই।

চরকা: ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিময় অনুসঙ্গ

ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের এক অবিচ্ছেদ্য উপকরণ। সুতাকে গোলাকারে পাকিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত একটি সরঞ্জাম, যা ঐতিহ্যবাহী তাঁত ও তাঁতিপ্রথার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি প্রাচীন বাংলাসহ দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামীণ জীবনের অন্যতম ও অত্যন্ত পরিচিত দৃশ্য। প্রাচীনকালে হাতে ঘুরিয়ে ব্যবহার করা হতো এবং এর সাহায্যে তৈরি করা হতো সুতাবাঁধা ‘আলনা’ বা ‘চাকা’। এটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মহাত্মা গান্ধীর নাম। ব্রিটিশদের তৈরি কাপড় যখন এ দেশের প্রাচীন হাতে বোনা তাঁতশিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ব্রিটিশদের আগ্রাসনের জবাবে বেছে নিলেন চরকা, তিনি চরকায় সুতা কেটে কাপড় বুনে সেই কাপড় পরিধেয় হিসেবে ব্যবহার করতেন। ক্রমে এই চরকা হয়ে ওঠে স্বাধীনতার প্রতীক। কবিগুরুর চরকা নিয়ে চমৎকার একটি ছড়ায় চরকার আবহ দেদীপ্যমান—

‘এক যে ছিল চাঁদের কোণায়

চরকা-কাটা বুড়ি

পুরাণে তার বয়স লেখে

সাতশো হাজার কুড়ি।

সাদা সুতোয় জাল বোনে সে,

হয় না বুনোন সারা—

পণ ছিল তার ধরবে জালে

লক্ষ কোটি তারা।’

আঁধারের সঙ্গী লন্ঠন

ছবি: লেখকের পাঠানো

ভাবুন তো, স্মার্টফোন নেই, বিদ্যুৎ নেই একটা দিন, একটা রাত। সরকার ও বিদ্যুৎ বিভাগের মুণ্ডুপাত করবেন না? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গরম গরম স্ট্যাটাসের বন্যা বয়ে যাবে না? অথচ একটা সময় এসবের কিছুই তো ছিল না প্রান্তিক মানুষের নাগালে। কেমন ছিল সে সময়? সাক্ষ্য দিচ্ছে পুরোনো ধাতব নির্মিত হ্যান্ড-ল্যান্টার্ন, যা মূলত আগুনের আলোর মাধ্যমে পথনির্দেশ বা পরিবেশ আলোকিত করার জন্য ব্যবহৃত হতো। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের আগের যুগে, বিশেষত আঠারো থেকে উনিশ শতকের মধ্যভাগে এমন লন্ঠনই ছিল রাতের অন্ধকারে মানুষের একমাত্র ভরসা।

এর কাঠামো সম্পূর্ণরূপে লোহার তৈরি এবং এতে রয়েছে একটি গোলাকৃতি কাচের আবরণযুক্ত মুখ, যা আলোকে একটি নির্দিষ্ট দিকে ফোকাস করে প্রক্ষেপণ করত। ওপরের দিকে খাঁজবিশিষ্ট একটি হাতল রয়েছে, যাতে এটি সহজে বহনযোগ্য হয়। রাত্রিকালীন পথ চলা, পাহারা, রেলওয়ে সংকেত কিংবা যুদ্ধের সময়ও নিরাপদ আলোক সরবরাহ নিশ্চিত করা হতো এই লন্ঠনের মাধ্যমে।

হস্তচালিত ছাপাখানা

সর্বশেষ পত্রিকা কখন কিনেছেন? হলফ করে বলতে পারি, এ প্রশ্ন করলে হালের কোনো তরুণ ঠিক মনে করতে পারবেন না, কবে তিনি পকেটের টাকায় খবরের কাগজ কিনেছেন। কারণ, তিনি পেপারলেস যুগের নাগরিক। দেশের মুদ্রণশিল্প আস্তে আস্তে বিলীন হওয়ার পথে, অথচ মাত্র দুই দশক আগেও খবরের কাগজ ছাড়া সকাল ভাবা যেত না। সময় কত দ্রুত বদলে যায়, তাই না? থমকে গেলাম এই মেশিনের সামনে, তার কল্যাণে কতশত খবর, অজানা তথ্য পৌঁছে যেত হাতে হাতে। একসময়ের অত্যাবশ্যকীয় উপদান জাদুঘরে বুকভরা অভিমান নিয়ে চুপচাপ পড়ে আছে। ধরা নিষেধ, তবু ধরে দেখলাম অনুমতি নিয়ে। অনুভব করলাম তার প্রাণচাঞ্চল্য সময়কে। কান পেতে শুনলাম আঠারো ও উনিশ শতকে তার আদর–কদরের কথা। তাকে ছাড়া বই, সংবাদপত্র ও পোস্টার—এসব ভাবাই যেত না। পেশির জোরে হাতল ঘুরিয়ে বা চাকা টেনে চাপ প্রয়োগ করে কাগজে একটি একটি অক্ষর স্থানান্তর করা হতো। এই প্রযুক্তি মূলত গুটেনবার্গের আবিষ্কৃত ছাপার পদ্ধতির উন্নত রূপ এবং বিশ্বব্যাপী গণজ্ঞান বিস্তারে ভূমিকা রাখে।

প্রাচীন ছাপাখানার সান্নিধ্যে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

এরিয়াল ক্যামেরা

ছোট বাচ্চারা এখন ড্রোন ক্যামেরা উড়ায়। অথচ আকাশ থেকে ভূপৃষ্ঠের একটা প্রতিরূপ নেওয়ার জন্য কত আয়োজন। হেলিকপ্টার ভাড়া করো, ইয়া বড় ক্যামেরা সঙ্গে নাও। বলছি এরিয়াল ক্যামেরার কথা। আকাশ থেকে চিত্রগ্রহণ করে সামরিক ও মানচিত্র নির্মাণ প্রযুক্তির জন্য এর আদর কদর কেমন ছিল বুঝতে পারছেন? বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সামরিক ও ভূতাত্ত্বিক জরিপের কাজে ব্যবহৃত হতো। এ ধরনের ক্যামেরার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি বিমান বা উঁচু পর্যবেক্ষণ প্ল্যাটফর্ম থেকে ভূমির চিত্রগ্রহণে সক্ষম।

এই ক্যামেরার সামনে রয়েছে একটি দীর্ঘ টেলিস্কোপিক লেন্স ইউনিট, যা উচ্চতা থেকে বিস্তৃত এলাকা জুম করে ধারণ করতে সাহায্য করে। এর পেছনের অংশে রয়েছে ফিল্ম চেম্বার, যেখানে বৃহৎ নেগেটিভ ফিল্ম রোল ব্যবহার করে ছবি তোলা হতো। এ ধরনের ক্যামেরা সাধারণত জরিপে ব্যবহৃত বিমানে স্থাপিত হতো এবং নিচের ভূমির বিশদ, নিখুঁত ও পরিকল্পিত চিত্র তুলে ধরত।

গ্রামোফোন, শব্দ ধারণ ও বিক্ষেপণের প্রাচীন যন্ত্র
ছবি: লেখকের পাঠানো

এই যন্ত্রগুলো বিশ্বযুদ্ধের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যুদ্ধক্ষেত্রের মানচিত্র, শত্রুর ঘাঁটি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ছবি সংগ্রহে এই ক্যামেরার বিশাল ভূমিকা ছিল। পরবর্তীকালে ভূগোল, নগর–পরিকল্পনা, কৃষি ও বন ব্যবস্থাপনায় এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আজকের স্যাটেলাইট ও ড্রোনপ্রযুক্তির পূর্বসূরি হিসেবে এই এয়ারিয়াল ক্যামেরা ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে আছে।

প্রাক্‌-বিদ্যুৎ যুগের আলোর অগ্রদূত

সময় যেন অসহায় হয়ে ঝুলে আছে মঞ্জুষা জাদুঘরে। কেরোসিনচালিত হারিকেন, ম্যান্টলযুক্ত প্রেশার ল্যাম্প, টিনের তৈলবাতি, এমনকি পুরোনো বৈদ্যুতিক বাল্বযুক্ত লন্ঠন—যেগুলো প্রতিটি একেক সময়ের আলো সরবরাহের অন্যতম মাধ্যম ছিল।

চিত্রে যেসব হারিকেন দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পেট্রোম্যাক্স ধাঁচের প্রেশার ল্যাম্প, যেগুলো কেরোসিন এবং চাপযুক্ত বায়ু ব্যবহারের মাধ্যমে তীব্র উজ্জ্বল আলো তৈরি করত। এগুলো সাধারণত গ্রামীণ এলাকায়, রেলস্টেশনে বা জরুরি পরিস্থিতিতে বহুল ব্যবহৃত হতো। মাঝের দিকে লাল ও কালো রঙের লন্ঠনটি সম্ভবত একটি স্ট্রম লন্ঠন, যেটি বাতাস ও বৃষ্টিতে নিভে যাওয়ার ভয় ছাড়াই ব্যবহার করা যেত।

চিত্রের ডান প্রান্তে দৃশ্যমান একটি পুরোনো ‘পোলার’ ব্র্যান্ডের বৈদ্যুতিক বাতি, যা বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রাথমিক যুগে ব্যবহৃত হতো। এটির উঁচু টুপি ও কাচের আবরণ একে একটি প্রতীকী নকশায় রূপ দেয়।

এরিয়াল ক্যামেরা; আধুনিক ড্রোন ক্যামেরার পূর্বপুরুষ
ছবি: লেখকের পাঠানো

চলচ্চিত্র প্রদর্শনী যন্ত্র (প্রজেক্টর মেশিন)

বিশালাকৃতির দুটি ফিল্ম প্রজেক্টর মেশিন, যা বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সিনেমা হলগুলোয় ব্যবহৃত হতো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য। এই যন্ত্রগুলো মূলত ৩৫ মিমি বা ৭০ মিমি সেলুলয়েড ফিল্ম রিলেভিত্তিক, যেখানে ছবির প্রতিটি ফ্রেম দ্রুতগতিতে চলমান আলো ও লেন্সের মাধ্যমে পর্দায় প্রতিফলিত হতো এবং সঙ্গে থাকত সাউন্ড সিস্টেমের আলাদা ইউনিট।

ডান দিকের প্রজেক্টরের গায়ে স্পষ্টভাবে ‘Cinemecanon’ ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ রয়েছে, যা ভারতের কিছু বিখ্যাত হল ও স্টুডিওতে ব্যবহৃত হতো। প্রতিটি প্রজেক্টরের সঙ্গে রয়েছে দুটি করে রিল হোল্ডার—ওপরে ইনফিড এবং নিচে টেকআপ রিল। এই রিলগুলোর মাধ্যমে সিনেমার পুরো ফিল্ম স্ট্রিপ চলত এবং প্রতিটি প্রদর্শনের পরে রিল ঘুরিয়ে পরবর্তী অংশ প্রদর্শন করা হতো।

এই যন্ত্রগুলোয় সাধারণত আর্ক ল্যাম্প বা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন হ্যালোজেন আলো ব্যবহার করা হতো, যা প্রজেকশন লেন্সের মাধ্যমে ছবিকে পর্দায় প্রক্ষেপণ করত। ছবির বাঁ প্রজেক্টরের নিচে একটি বড় ধাতব কভার যুক্ত, যেখানে কনডেনসার ও ফ্যান বসানো থাকত তাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করার জন্য।

গ্রামোফোন: শব্দ ধারণ ও বিক্ষেপণের প্রাচীনতম যন্ত্র

দুর্লভ, বিশাল হর্ন-গ্রামোফোন, যা বিশ শতকের শুরুর দিকে গান শোনার অন্যতম জনপ্রিয় যন্ত্র ছিল। এই গ্রামোফোনের সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো এর বৃহৎ আকারের ধাতব হর্ন বা বাঁকা ঘণ্টার মতো কাঠামো, যা শব্দতরঙ্গকে পরিবর্ধন করে ছড়িয়ে দিত। হর্নটি মূলত একটি যান্ত্রিক অ্যামপ্লিফায়ার—কোনো ইলেকট্রনিক ব্যবস্থার সাহায্য ছাড়াই শব্দকে উচ্চতর করে তুলত।

এই গ্রামোফোনের মূল কাঠামোটি নিচে কাঠের বক্সে স্থাপিত, যার ওপরের অংশে একটি লাল মখমলঢাকা রেকর্ড টার্নটেবল বসানো আছে। রেকর্ড বসিয়ে হাতে ঘোরানো হ্যান্ডেল বা স্প্রিং মেকানিজম ব্যবহার করে ডিস্ক ঘোরানো হতো। তার সঙ্গে সংযুক্ত হতো একটি সুচ ও সাউন্ডবক্স, যা রেকর্ডের খাঁজ ধরে চলতে চলতে কম্পন তৈরি করত এবং সেই কম্পন ধাতব হর্ন দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে শব্দে রূপান্তরিত হতো।

গ্রামোফোন শুধু সংগীতের মাধ্যম নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বাহক। এককালে ঘরে ঘরে এমন যন্ত্রের মাধ্যমে শোনা হতো রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, রাগাশ্রয়ী কিংবা আন্তর্জাতিক রেকর্ড। এর সাহায্যে সংবাদ, ভাষণ ও নাটকও পৌঁছে যেত সাধারণ মানুষের কাছে।

আখের রস নিষ্কাশন যন্ত্র
ছবি: লেখকের পাঠানো

লার্জ ফরম্যাট স্টুডিও ক্যামেরা: প্রতিকৃতি আলোকচিত্রের ঐতিহাসিক কারিগর

উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত পোর্ট্রেট বা প্রতিকৃতি আলোকচিত্র গ্রহণে ব্যবহৃত হতো। ক্যামেরাটি ভারী কাঠ ও ধাতুর সমন্বয়ে নির্মিত এবং এটি দৃঢ় স্ট্যান্ডের ওপর স্থাপিত, যা ক্যামেরাকে স্থির রেখে নির্ভুল ফোকাসে সাহায্য করত।

এর সামনের অংশে একটি বড় ব্রাস লেন্স সংযুক্ত, যা আলো সংগ্রহ করে ছবিটি এক কাঁচের প্লেটে প্রক্ষেপণ করত। পেছনের দিকে একটি বেলোস (ভাঁজ করা চামড়ার মতো অংশ) রয়েছে, যা লেন্স ও ফোকাসিং স্ক্রিনের মাঝে দূরত্ব নির্ধারণে সাহায্য করত। ছবির নিচের অংশে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে স্ট্যান্ডের ঘূর্ণনযোগ্য হাতল ও ফোকাসিং গিয়ার, যার মাধ্যমে ক্যামেরা ওপরে-নিচে এবং সামনে-পেছনে সরানো যেত।

এই ক্যামেরার মাধ্যমে ছবি তোলার জন্য ফিল্ম নয়, বরং ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করা হতো। প্রতিটি প্লেট ছিল আলাদা, এবং প্রতিবার ব্যবহারের পর নতুন প্লেট লাগাতে হতো। আলোকপ্রবাহ, রকমারি পোজ এবং ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ন্ত্রণে ক্যামেরাটির অসাধারণ দখল ছিল। এ রকম ক্যামেরা দিয়ে সাধারণত স্টুডিও সেটআপে দীর্ঘ এক্সপোজারে ছবি তোলা হতো। তাই বিষয়বস্তু বা মানুষকে বেশ সময় ধরে স্থির থাকতে হতো।

ভারতবর্ষের মুদ্রা সংগ্রহ: ঔপনিবেশিক যুগ থেকে স্বাধীতা–উত্তর পর্যন্ত অর্থনৈতিক স্মারক

সযত্নে সংরক্ষিত ভারতবর্ষের মুদ্রা সংগ্রহ, যা সময়ক্রমে ব্রিটিশ ওপনিবেশিক শাসন, স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রারম্ভিক রাষ্ট্রীয় যুগ এবং আধুনিক ভারতের আর্থিক বিবর্তনের ইতিহাসকে ফুটিয়ে তোলে। এই সংগ্রহে রয়েছে বিভিন্ন মূল্যমান ও ধাতব মিশ্রণের মুদ্রা, যেগুলোর নকশা ও খোদাই প্রতিটিই একেকটি সময়ের প্রতিচ্ছবি।

বাঁ পাশে একটি বিশালাকার মুদ্রায় খোদিত আছেন কিং জর্জ ষষ্ঠ, যা ব্রিটিশ রাজত্বকালে চালু ছিল। এ ধরনের মুদ্রা ছিল রুপালি বা তাম্র-নিকেল মিশ্রণে গঠিত। পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে ১৯৫০-এর দশকের ২০ পয়সা ও ১ পয়সা মূল্যমানের মুদ্রা। অনেক মুদ্রা রয়েছে ফুল আকৃতির স্ক্যালপড প্রান্তবিশিষ্ট, যা ১৯৫৭ সাল থেকে প্রবর্তিত হয়, তখনকার ডেসিমেল কারেন্সি সিস্টেম প্রবর্তনের ফলাফল।

ছবির কেন্দ্রে দেখা যাচ্ছে ১৯৫৭ সালের ৫ পয়সার মুদ্রা, যেটি প্রথম ‘ডেসিমেল পয়সা’ রূপে প্রচলিত হয়। ডান দিকে রয়েছে ১ ও ২ রুপি মূল্যমানের আধুনিক নকশার মুদ্রাও, যেখানে ‘রাষ্ট্রীয় প্রতীক’ ও ‘ধানের শিস’ খোদাই করা।

রিকয়েললেস রাইফেল

বিশেষভাবে তৈরি করা একটি হালকা কামানের মতো অস্ত্র, যা সাধারণত শত্রুর ট্যাংক বা সাঁজোয়া যান ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো। এ ধরনের অস্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, গুলি ছোড়ার সময় এটি বিপরীত দিকে ধাক্কা বা রিকয়েল তৈরি করে না, যার ফলে এটি তুলনামূলকভাবে স্থির থেকে পরিচালনা করা সম্ভব।

অস্ত্রটির নকশা ও নির্মাণ দেখে বোঝা যায়, এটি সম্ভবত ১৯৫০–৭০–এর দশকের মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল এবং সাধারণত জিপ বা হালকা গাড়ির পেছনে বসিয়ে মোতায়েন করা হতো। ঠিক পেছনের দেয়ালে এর একটি টেকনিক্যাল ডায়াগ্রাম আঁকা রয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, কীভাবে এটি একটি জিপের ওপর মাউন্ট করা হতো। এর মাধ্যমে ফিল্ড অপারেশনে দ্রুতগতিতে অস্ত্র চালনা করা যেত এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানো সম্ভব হতো।

রিকয়েললেস রাইফেলগুলোয় মূলত ব্যাক-ব্লাস্ট প্রযুক্তি ব্যবহৃত হতো, যার মাধ্যমে আগুনের শিখা ও গ্যাস পেছনের দিকে নির্গত হয়ে সামনের গুলির রিকয়েল হ্রাস করত।

এই অস্ত্র আজকের দিনে আধুনিক ট্যাংক–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় পুরোনো হয়ে পড়লেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময় থেকে কোরিয়ান যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত সংঘর্ষ বা মধ্যবিশ শতকের অন্যান্য সামরিক সংঘাতে এর ব্যাপক ব্যবহার ছিল।

ভারতবর্ষের সমরাস্ত্র

কাচে ঘেরা সুরক্ষিত বক্সে প্রাচীন তলোয়ার, খাঁড়া, র‍্যাপিয়ার, স্যাবার ও লাঠি সংরক্ষিত, যেগুলো বিভিন্ন সময়, সংস্কৃতি ও সামরিক ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে। প্রতিটি অস্ত্রের নিজস্ব নকশা, বক্রতা ও হ্যান্ডেলের গঠন দেখে বোঝা যায় এগুলোর ব্যবহারভিত্তিক পার্থক্য ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।

বাঁ পাশে রয়েছে দীর্ঘ ধারালো লাঠিজাতীয় অস্ত্র ও সরু ব্লেডবিশিষ্ট র‍্যাপিয়ার, যা ইউরোপীয়দের দ্বারা ব্যবহৃত হতো দ্বৈরথ ও সম্মুখযুদ্ধে। এর পাশে কিছু তলোয়ারের হ্যান্ডেল গোলাকৃতি রক্ষাকবচ দিয়ে মোড়ানো, যা ‘স্যাবার’ নামে পরিচিত। এগুলো মূলত অশ্বারোহী সেনাদের ব্যবহারের জন্য তৈরি ছিল, বিশেষ করে মোগল ও মারাঠা বাহিনীতে এগুলোর ব্যবহার ছিল ব্যাপক।

মাঝবরাবর ভারী ব্লেডযুক্ত কয়েকটি তলোয়ার আছে, যা ভারতীয় উপমহাদেশে রাজ্যভিত্তিক সেনাপতিদের বা শাসকদের সম্মানসূচক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তলোয়ারের ফলার ওপর দেখা যায় কিছু অলংকার বা খোদাইচিত্র, যা অস্ত্রকে শুধু যুদ্ধের মাধ্যম নয়, বরং শিল্পের নিদর্শনেও পরিণত করেছে।

ডান দিকে কিছু সরু ছিপের মতো অস্ত্র ও গোল কাঠের মাথাযুক্ত প্রশিক্ষণ লাঠি আছে, যেগুলো দঙ্গল বা অনুশীলনের কাজে ব্যবহৃত হতো। এতে দেখা যায় যুদ্ধশৈলীর প্রস্তুতি ও তরবারি চালনায় দক্ষতা অর্জনের ঐতিহাসিক উপকরণ।

চা তৈরির ঐতিহ্যবাহী রুশ যন্ত্র

আঠারো শতকের রুশ চা সংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক। সামোভার শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘নিজে গরম করে’। এটি চা গরম রাখা ও পানি ফুটানোর একপ্রকার যন্ত্র, যার মাধ্যমে একসঙ্গে একাধিক ব্যক্তিকে চা পরিবেশন করা যেত।

বিশেষ এই সামোভার ব্রোঞ্জ বা পিতল দিয়ে তৈরি এবং তার নিচের অংশে রয়েছে একটি চুল্লির মতো কাঠামো, যেখানে কয়লা বা কাঠ জ্বালিয়ে ভেতরের পানি গরম করা হতো। জলাধারের মাঝে একটি উল্লম্ব ধাতব নল দেখা যাচ্ছে, যার মাধ্যমে তাপমাত্রা রক্ষণ করা হতো। সামনের দিকে একটি কল বা ট্যাপ রয়েছে, যার সাহায্যে ফুটন্ত পানি ঢালার ব্যবস্থা করা হতো।

রাশিয়ার বাইরে ইরান, তুরস্ক ও এশিয়াতেও সামোভারের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে তা শুধুই চায়ের জন্য নয়, সামাজিক মিলনস্থলের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হয়। সামোভার শুধু এক প্রযুক্তিগত আবিষ্কার নয়, বরং এটি ছিল অতিথিপরায়ণতা, আড্ডা ও আন্তরিকতা প্রকাশের সাংস্কৃতিক প্রতীক।

এই যন্ত্র আধুনিক বৈদ্যুতিক কেটলির পূর্বসূরি বলা চলে। বর্তমানে সামোভারগুলো জাদুঘরে সংরক্ষিত থাকে ঐতিহাসিক শিল্প ও জীবনধারার নিদর্শন হিসেবে।

ভারতবর্ষের ডাকটিকিট

তৎকালীন ভারত সরকারের প্রকাশিত একগুচ্ছ ডাকটিকিট, যেগুলো দেশবরেণ্য সাহিত্যিক, কবি, দার্শনিক ও সাংবাদিকদের সম্মান জানিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি ডাকটিকিট শুধু একজন ব্যক্তির ছবি নয়, বরং ভারতীয় জ্ঞানের ভান্ডার, সাহিত্যচর্চা ও চিন্তাশীলতার ঐতিহাসিক পরম্পরার স্মারক।

এই সংগ্রহে দেখা যাচ্ছে...

ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, শ্রী অরবিন্দ ও হরনাথ দের মতো ঐতিহাসিক চিন্তাবিদ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরোজিনী নাইডু, মধুকরী বসু, দত্তাত্রেয় রামাচন্দ্র বেনে—প্রখ্যাত কবি ও গদ্যকার, ড. আর গাডগিল, ড. ভি বি রাজাদীক্ষিত, ড. ডি ডি কৌশিক, ড. এম ভি হঠিনে—সমাজবিজ্ঞান ও ভাষাতত্ত্বের চিন্তাবিদ এবং ম্যাক্স মুলার, রমণ মহর্ষি, শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব, মা আনন্দময়ী—যাঁরা ভারতীয় দর্শন ও আত্মিক ভাবনার প্রতিনিধিত্ব করেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা মাস্টারদা সূর্য সেন।

অনেক টিকিটে ‘ইন্ডিয়া’ এবং টাকায় মূল্যমান দেওয়া রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিছু টিকিট রঙিন, আবার কিছু পুরোনো সেপিয়া বা ব্রাউন টোনে ছাপা, যা প্রকাশনার সময় ও ছাপার শৈলীর পার্থক্য বোঝায়।

এই ডাকটিকিটগুলো শুধু যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না, এগুলো ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জাতীয় শ্রদ্ধাঞ্জলির এক মহামূল্য দলিল। প্রত্যেক ব্যক্তির অবদান শিক্ষাক্ষেত্র, সাংবাদিকতা, দর্শন, চিন্তা বা কবিতায় ছিল অবিস্মরণীয়। এ টিকিটগুলো ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক শৈল্পিক দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

প্রিয় পাঠক, আগামী সংখ্যাগুলোয় ‘নাগরিক সংবাদ’ বিবেচনা করলে মহীশূর প্রাসাদ, টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ, মাজার, ডেথ প্লেস, পোর্ট, চেন্নাই মেরিনা সৈকতসহ বেশকিছু তথ্যচিত্র ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে। ততক্ষণ পর্যন্ত ভালো থাকুন। চলবে...

লেখক: রহিম সৈকত, শিক্ষক