টুইন টাওয়ারের আলোকছটা: পর্ব-২
আমাদের পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার দর্শন শুরুতেই হোঁচট খেল। সেদিন ছিল সোমবার (২৯ এপ্রিল, ২০২৪)। সকালে গুগল ম্যাপ খুলে দেখতে চাইলাম টুইন টাওয়ার কোন পথে যাব। কিন্তু সোমবার ওটা Closed দেখাচ্ছে! ... মানে ভেতরে ঢোকা যাবে না। সাপ্তাহিক ছুটির আর দিন পেল না!
কিছুটা মন খারাপ করে বেরিয়ে পড়লাম কেনাকাটা করতে। McDonald's -এ খেয়ে ফিরলাম হোটেলে। খেতে খেতে দেখছিলাম ওদের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা কেউই নগদ টাকা দিয়ে কিছু কিনছে না। ওদের মুঠোফোনটাই ওদের ওয়ালেট। সেটা দিয়ে QR Code স্ক্যান করে ওরা খাবার অর্ডার করছে, দাম মেটাচ্ছে। ফলে মা–বাবার কষ্টে উপার্জিত টাকা ওরা কোথায় খরচ করছে, তার স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
আমাদের হোটেলটা বেশ পুরোনো এক অট্টালিকায়। আমাদের রুম ছিল ২৫ তলায়। আর সুইমিংপুলটা ৯ তলায়। পুলের পরিবেশটা সম্রাটদের প্রাসাদের আদলে করা। মাথার ওপর ছাদ, দুই পাশে গোলাকার থামের ওপর অপূর্ব কিছু ভাস্কর্য। আর সেখানে বাস করে কিছু কবুতর। ওরা মাঝেমধ্যে এসে বসছিল পুলের পাড়ে। তাই আর মন খারাপ ভাবটা রইল না। সেই সঙ্গে যখন চোখে পড়ল, অদূরেই সুউচ্চ মারদেকা টাওয়ারের কোমরের কাছে মেঘেরা এসে ভিড় করেছে, আর মেঘেদের ভেতর দিয়ে গাঢ় নীল কাচে মোড়ানো ভবনটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, বিস্ময়ে আমাদের তো মুখ হা হয়ে গেল। আফসোস, সাঁতার কাটতে এসেছি বলে ফোনটা রুমে ফেলে এসেছি। এই অপরূপ দৃশ্য তাই রয়ে গেল মনের মেমোরি কার্ডে। ফোনের ক্যামেরায় সেটা ধারণ করা গেল না।
টুইন টাওয়ারে ঢুকতে পারব না তো কী হয়েছে? বাইরে তো ঘোরা যাবে। কাজেই বিকেলে চলে গেলাম KLCC (Kualalampur City Centre). আমরা প্রথমে গেলাম পেছনের দিকটায়। সেখানে লেকের ভেতর চমৎকার এক ফোয়ারা আছে। সন্ধ্যার পর সেই ফোয়ারায় যুক্ত হয় রঙিন আলো। মিউজিকের তালে তালে সে আলো আর জল নেচে ওঠে নির্দিষ্ট সময়ে।
পেছনের সেই লেক পাড় থেকে বেশ কিছু পথ হেঁটে যখন পৌঁছলাম টুইন টাওয়ারের ঠিক গোড়ায়, তখন ইস্পাতের সেই ভবন যেন আমাকে চুম্বকের মতো টানছিল। স্পর্শ করলাম সেই ইস্পাতে মোড়ানো কলাম। অসাধারণ অনুভব! দূর থেকে বা ছবিতে দেখে সত্যিই বুঝিনি কী অপার বিস্ময়কর এই স্থাপনা! কী তার দ্যূতি! কী তার চাকচিক্য! আর প্রতিটি ইস্পাতের পাতের যে অভিজাত Color আর Texture, সেটা ভাষায় অপ্রকাশ্য। পোর্চ থেকে বেরিয়ে সামনে আরেক বিশাল ফোয়ারা আর বাগান। সেটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভবনটার দিকে তাকালে প্রথমেই আমার যেটা মনে হলো, তা হচ্ছে, এত সুন্দর এক অট্টালিকা সত্যিই কি মানুষ তৈরি করেছে? এর গায়ের যে আলোকছটা, তা যে অপার্থিব, অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর! দিনের আলোয় এর সৌন্দর্য এক রকম, ইস্পাতে তখন ঠিকরে পড়ে ঝলমলে রোদের আলো। বিকেলের পর বদলে যায় এর রূপ ও রং। অনবদ্য সে দৃশ্য!
দুই চোখ ভরে দেখে নিলাম। ক্যামেরাও সচল হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। আর তখনই হঠাৎ বৃষ্টি! মালয়েশিয়ার আবহাওয়াটাই নাকি এমন। এই রোদ, এই মেঘ, এই বৃষ্টি। আর মে মাস থেকে তো ওদের বর্ষাকাল শুরু। আমরা দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিলাম পোর্চে। আমাদের সঙ্গে বেশ কিছু বিদেশি পর্যটক। তাদের অধিকাংশই ভারতীয়। গ্র্যাবের ড্রাইভার বলেছিল, মালয়েশিয়া ভারতীয়দের ফ্রি ভিসা দিচ্ছে। তাই কলকাতা থেকে চেন্নাই সব রাজ্য থেকে পর্যটকের ঢল নেমেছে এ দেশে।
হিন্দি-বাংলা-তামিল-ইংরেজি কলকাকলি শুনতে শুনতে সেই বৃষ্টিও উপভোগ করলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। আশপাশের ভবনগুলো আর রাস্তায় জ্বলে উঠল ঝলমলে আলো। তবু টুইন টাওয়ার তার আলোকছটা নিয়ে স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল। বৃষ্টি থামতেই আমরা আবার ফিরে গেলাম সামনের ফোয়ারা আর বাগানের দিকটায়। সেখান থেকে জমজ মিনার দেখে চলেছি। আশ মিটছে না। তবু ফিরতে হলো।
এর পরের দিন সকালে আবার গেলাম। একটু বেলা হয়ে গিয়েছিল। ১২টায় যখন টিকিট কাটতে বেজমেন্টে গেলাম, তখন জানা গেল, বেলা ২টার আগের সব টিকিট শেষ। বলে রাখি, এরা টিকিট দেয় সকাল ১০টা থেকে। দর্শনার্থীরা রাত ৮টা পর্যন্ত ভেতরে ঢুকতে পারবেন। তবে প্রতিটি টিকিট ৪৫ মিনিটের জন্য। টিকিটের মূল্য মালয়েশিয়ানদের জন ৪৫ রিংগিত, বিদেশিদের জন্য জনপ্রতি ৯৮ রিংগিত (১ রিংগিত = ২৫.৮০ টাকা )।
এই ভবনের নিচতলায় যে একটা বিশাল শপিংমল আছে, সেটা কিন্তু সপ্তাহে সব দিন খোলা থাকে। সেটা নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। আমরা ১২টা থেকে ২টা, এই দুই ঘণ্টা কী করা যায়, তা নিয়ে ভাবিত।
একটু ভেবে চলে গেলাম KL eco forest দেখতে। ২০ মিনিটের পথ যেতে ৫০ মিনিট লাগল যানজটের কারণে। আর সেদিন ছিল ভ্যাপসা গরম। তাই ইকো ফরেস্টে ঘুরতে বেশ কষ্টই হলো।
ইকো ফরেস্ট মানে হলো, এখানে যে প্রাচীন জঙ্গল ছিল, সেটাকে এরা সংরক্ষণ ও সংস্কার করেছে। এর ভেতর ঝুলন্ত সেতু দিয়ে বেশ একটা ঘোরার পথ তৈরি করা হয়েছে।
এখানকার গাছগুলো বেশ উঁচু। পুরো জঙ্গলজুড়ে এক অদ্ভূত নির্জনতা। আর এই ভরদুপুরে টানা ঝিঁঝিপোকার ডাক। তিনজনে ১২০ রিংগিত খরচ করে এই জঙ্গল দেখার কোনো অর্থই আমার মিতব্যয়ী স্ত্রী খুঁজে পেল না। আমি আর আমার পুত্র মেঘ অবশ্য উপভোগ করলাম ঝুলন্ত সেতুর ওপর এই হাঁটাহাঁটি আর বানর দর্শন। কাছেই ছিল KL Tower, সেটাও দেখা হলো বাইরে থেকে। সেও এক দারুণ স্থাপত্য।
এবার ফিরে গেলাম পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারে। বলে রাখি, ১৯৯২ সালে নির্মাণ শুরু হয় পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের। কাজ শেষ করে উদ্বোধন হয় ১৯৯৯ সালে। এখানে পেট্রোলকে Petronas বলা হয়। এই টাওয়ারটি মূলত: ‘পেট্রলিয়াম ন্যাশনাল বারহাদ’ নামের মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত তেল ও গ্যাস কোম্পানির প্রধান কার্যালয়। এ ছাড়া এখানে বড় বড় দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অফিস আছে। মোট তলার সংখ্যা ৮৮। উচ্চতা ৪৫১ মিটার ( ১৪৮৩ ফুট)।
অন্যদিকে কে এল টাওয়ারের উচ্চতা ৪২১ মিটার, আর মারদেকা টাওয়ার ছাড়িয়েছে সবাইকে (১১৮ তলা, ৬৭৮.৯ মিটার উচ্চতা)।
২টা বাজার ১০ মিনিট আগে পৌঁছে লাইন ধরে লিফটে উঠলাম আমরা। অবিশ্বাস্য গতিতে লিফট উঠছে, আমার কানের ভেতর কী যেন হলো, বিমান টেক অফ করার সময় যেমনটা হয়। মাধ্যাকর্ষণ বলের বিপরীতে চলার প্রভাব।
আমাদের ৪২ তলায় পৌঁছে দেওয়া হলো মাত্র এক মিনিটে। দোতলা ব্রিজের সেটা ওপরের তলা। পর্যটকেরা এখানে আসেন, আর ভবনের মূল ‘টেনান্ট’রা নিচের তলা দিয়ে যাতায়াত করেন। ব্রিজটা ভূমি থেকে ১৭০ মিটার উচ্চতায় রয়েছে। (নির্মাণের সময় ব্রিজটি আগে তৈরি করে ক্রেন দিয়ে ওপরে তুলে দুই মিনারের মধ্যে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেটা নির্মাণ কালের ছবি দেখে জানতে পারলাম)।
আমরা সেখানে মিনিট দশেক দাঁড়াবার সময় পেলাম। গাইড জানালেন, এই ব্রিজটা দুই টাওয়ারকে যুক্ত করে। তবে এটা এমনভাবে তৈরি হয়েছে, যেন ঝড় বা ভূমিকম্পের সময় টাওয়ার দুটো যখন দুলে ওঠে, তখন যেন ব্রিজটা দুই টাওয়ারের মাঝের দূরত্ব কম-বেশি হলে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ১০ ইঞ্চির একটা Adjustable Gap রাখা হয়েছে ব্রিজ ও টাওয়ারের সংযোগস্থলে। কাচে ঘেরা এই ব্রিজ থেকে আশপাশের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। নিচের গাড়িগুলো তখন দেখতে সেই ছোট্টবেলায় যে Matchbox গাড়িগুলো নিয়ে খেলতাম, সেগুলোর মতো লাগছিল। কয়েকটা ছবি তুললাম, তারপর ডাক পড়ল ওপরে যাওয়ার। এবার ৪২ তলা থেলে ৮৩ তলা উঠলাম ৩৮ সেকেন্ডে। ভিডিও করে রাখলাম সেই অবিস্মরণীয় উত্থানের প্রামাণ্যচিত্র। ৮৩ তলা থেকে ছোট আরেকটা লিফটে করে উঠে গেলাম ৮৬ তলায়৷ এখানেই অপেক্ষা করছিল এক বিপুল বিস্ময়। এই ফ্লোরটাও কম বড় নয়। এখানে প্রথমেই চোখে পড়ল কুয়ালালামপুর শহরটার একটা 3D Model. সেখানে এক বিশাল কাচের বাক্সে যেন পুরে ফেলা হয়েছে গোটা শহরটা। কত যে উঁচু দালান এই শহরে, তা একনজরে দেখার সুযোগ পেলাম। এ ছাড়া টুইন টাওয়ারের বেশ কিছু বড় বড় মডেল সাজিয়ে রাখা। নির্মাণকালের অনেক ছবি ও তথ্য পেলাম দেয়ালে।
কাচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে মনে হয়, আমি যেন আকাশে চলে এসেছি। এত ওপর থেকে শহর ছাড়িয়ে দৃষ্টি চলে যায় দূর দিগন্তজোড়া পাহাড়ের কাছে। এক সঙ্গে মারদেকা টাওয়ার, কে এল টাওয়ার আর টুইন টাওয়ারের একটা অংশ ধরে রাখলাম আমার ক্যামেরার ফ্রেমে।
এই ভরদুপুরে বাইরে হঠাৎ আঁধার ঘনিয়ে এল। ঘন মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। জানালার কাচের ওপাশে সব কিছু ঝাপসা। পরে বুঝলাম আমাদের জানালার বাইরে থেকে ঘিরে রয়েছে ধূসর মেঘ। বৃষ্টি ঝরছিল অবিরল ধারায়…। আমরা সেদিকে তাকিয়ে আছি অপলক মুগ্ধতায়, বিপুল বিস্ময়ের বিহ্বলতায়... । আমাদের সময় ফুরিয়ে আসছিল, কিন্ত মুগ্ধতা কাটছিল না।
‘কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে’, এই অনুভূতি নিয়েই ফিরতে হলো মেঘেদের কাছ থেকে মাটির কাছে, স্বপ্নের কাছ থেকে বাস্তবতার কাছে। চলবে...
লেখক: কাজী মনজুর করিম মিতুল, প্রকৌশলী