মুগ্ধতার মালয়েশিয়া: পর্ব-১
ভারত ও ভুটানের পর এবার আমার গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়া। এর আগে একা বা অফিসের কারও সঙ্গে গিয়েছি। এবারের ভ্রমণ সপরিবার। এবং সেই সুযোগ অনেকটা লটারির টিকিট জেতার মতো করেই হাতে এসেছে।
আমি যখনই দেশের বাইরে গিয়ে কিছু দেখে মুগ্ধ হই, তখনই মনের অজান্তে তুলনা করে ফেলি দেশের সঙ্গে। মনে হয়, আমার দেশে তো এর চেয়ে ভালো কিছু আছে, অথবা দেশেও তো এমন করা যেত...। যেমন পিনাংয়ের বাতু ফিরিঙ্গি সৈকতে দাঁড়িয়ে মনে হলো, এর চেয়ে কক্সবাজার শতগুণে ভালো। সেখানে জলকেলি করতে করতে পুত্র জেলিফিশের আক্রমণের শিকার হলো, মনে হলো, কেন যে ছাই এখানে এলাম! কিছুক্ষণ পর আমার স্ত্রীকেও বিষাক্ত হুল ফোটাল বদমাশ জেলিফিশ। এরপর আর জলে থাকা চলে না। লোকে ব্যক্তিত্বহীন মানুষকে ‘জেলিফিশ’ বলে গালি দেয়। এবার জানলাম, ওরা মোটেই নিরীহ নয়।
কুয়ালালামপুরের সুউচ্চ সব অট্টালিকা দেখে আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল, আহা, কত–না বাংলাদেশের শ্রমিকদের ঘাম ও শ্রমে গড়ে উঠেছে এসব স্কাইস্ক্র্যাপার! ঢাকায় কি এমন শততলা ভবন নির্মাণ হতে পারত না? নিশ্চয়ই আমাদের ভূমিকম্প, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় একটা বড় বাধা, যা কুয়ালালামপুরকে আক্রান্ত করে না৷
শহর বলতে আমি কেবল কুয়ালালামপুর আর পিনাং দেখেছি। লাংকাউইকে গ্রাম বা মফস্সল বলা যায়। তবে সবখানেই মুগ্ধ হয়েছি ট্রাফিক ব্যবস্থা দেখে। প্রথমত, সব ড্রাইভার নিয়মমাফিক গাড়ি চালায়, কেউ কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে না। সবাই সিগন্যাল বাতি অনুযায়ী চলে। দ্বিতীয়ত, আমি যে এক সপ্তাহ ছিলাম, কোনো মোড়ে বা রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ চোখে পড়েনি। ২০১৬ সাল থেকে ওরা স্মার্ট ট্রাফিক অ্যানালিটিকস অ্যান্ড রিকগনিশন সিস্টেম (এসটিএআরএস) প্রযুক্তি ব্যবহার করা শুরু করেছে, যা রাস্তার পরিস্থিতি অনুযায়ী লাল-সবুজ বাতি জ্বালায়। দূর থেকে সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে তারা সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে। তাই সবকিছু চলছে ঠিকঠাক, নিরাপদ, নিরবচ্ছিন্ন। সত্যি বলছি, যে আট দিন ছিলাম, আমি একটা গাড়িকেও একবার হর্ন বাজাতে শুনিনি!
পিনাংয়ের কোনো এক রাস্তায় Grab (আমাদের দেশের Uber–এর মতো) এর গাড়িতে চলতে চলতে ছেলেকে বলছিলাম, বড় হয়ে তুমি যদি ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ার হও, অবশ্যই এদের মতো ড্রেনেজ সিস্টেম তৈরি করবে। ওদের পাহাড়গুলো থেকে যেন বৃষ্টির জমে থাকা পানি হঠাৎ রাস্তায় এসে ঝামেলা না করতে পারে, সে জন্য ওরা পাহাড়ের শরীরের ভেতর বসিয়ে দিয়েছে শত শত পাইপ। সেই পাইপ বেয়ে ওপরের পানি এসে পড়ছে রাস্তার পাশের নর্দমায়। সে নর্দমাও পরিচ্ছন্ন।
লাংকাউইর ইগল স্কোয়ারে দেখলাম, পর্যটকদের জন্য বন্ধ, সংস্কার চলছে। সেদিন মে দিবস৷ তাই শ্রমিকেরা কাজ করছিলেন না। সে সুযোগে ভেতরে ঢুকে দ্রুত দেখে নিলাম। মালাক্কা প্রণালির জলের ওপর নির্মিত ডেকে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল আমাদের কক্সবাজারের চেয়ে ভালো কিছু নির্মাণ সম্ভব। ওদের প্রেগন্যান্ট আইল্যান্ড বা ক্রোকোডাইল আইল্যান্ড দেখে আমি কিছুটা হতাশ। ভ্লগগুলোতে কী ফুলিয়ে ফাঁপিয়েই না এর গুণকীর্তন করে! এর চেয়ে বান্দরবান কম যায় কিসে? ল্যাঙ্কাউইর স্কাই ব্রিজের আদলে আমাদের সাজেকেও একটা ব্রিজ আছে। কেল এল ইকো ফরেস্টের ঝুলন্ত সেতুর সঙ্গে আমাদের রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু দিব্যি টেক্কা দিতে পারে।
তবে মিঠাপানির হ্রদ আমাকে মুগ্ধ করেছে। স্রষ্টার কী অপার মহিমা! সমুদ্রের ভেতর পাহাড়বেষ্টিত এক হ্রদ, যার পানিতে সাঁতার কাটতে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ অনুভূত হয়। সেখানে আমাদের নৌকায় এক অস্ট্রেলিয়ান প্রৌঢ় দম্পতি ছিলেন৷ ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীকে পরিবার সম্পর্কে নিচু স্বরে প্রশ্ন করছিলেন, ‘এরা কোন দেশের?’
ভদ্রলোকের জবাব, ‘বাংলাদেশ। ভারতের গায়ে লেগে থাকা ছোট্ট এক দেশ। ওরা দারুণ ক্রিকেট খেলে...।’
আড়ি পেতে তাঁদের কথোপকথন শুনে বুকটা গর্বে ফুলে উঠেছিল।
তবে বাংলাদেশ ছাড়ার আগে বিমানবন্দরে যে ভোগান্তি হলো, তার স্মৃতি আমি বয়ে বেড়াব আজীবন। ইমিগ্রেশন পুলিশ আমার যাবতীয় কাগজ চেক করেই ক্ষান্ত হননি, আমার ফোনে ব্যাংক থেকে যেসব মেসেজ আসে, সেসব দেখেও নিশ্চিত হতে চেয়েছেন আমার মাসিক আয় কেমন। ভিসার আবেদনের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের ছাড়পত্র জমা দিতে হয় জানতাম। কিন্তু এখানে আমার ও আমার স্ত্রীর ছুটির প্রমাণক আবার দেখতে চাইল। ভেবেছিলাম, মালয়েশিয়ার পুলিশ আমাদের বেশি জেরা করবে। হলো উল্টো। সেখানে আমরা নির্বিঘ্নে ইমিগ্রেশন পেরিয়ে গেলাম। মালয়েশিয়ান একটা সিম কিনে গ্র্যাবে কল দিয়ে শুরু হলো কুয়ালালামপুর ভ্রমণ।
এর আগে ছবি বা ভিডিওতে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার দেখে কখনো ধারণা করতে পারিনি, কী অপার বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। সেই গল্প পরের পর্বে। চলবে...
লেখক: কাজী মনজুর করিম মিতুল, প্রকৌশলী