মেঘালয়: মেঘ ও মেগালিথ

বিবাহবার্ষিকী উদ্‌যাপনে জাফলং ভ্রমণ। সেখানেই দূর থেকে দেখা ১৯৩২ সালে নির্মিত ঝুলন্ত এক বিস্ময় মেঘালয়ের প্রধানতম দুই পাহাড় খাসি ও জৈন্তিয়ার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা ডাউকি সেতু, যার আরেক নাম ‘Gateway of Shillong’। এটি মূলত তৎকালীন শ্রীহট্ট বা সিলেটকে শিলং বা মেঘালয়ের রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত করে। পাহাড়প্রেমী সহধর্মিণীর ইচ্ছায় পরবর্তী গন্তব্য ঠিক হলো মেঘের দেশ—মেঘালয়।

মেঘালয়ে প্রবেশের মুহূর্ত থেকে ভ্রমণের শেষ পর্যন্ত যে উত্তেজনার শুরু হয়েছিল, তার বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও আমার আগ্রহ ছিল এখানকার সংস্কৃতি জানার। এর আগে আমি প্রথম আলোতে লিখেছিলাম মেঘালয়ের সেং খাসি আন্দোলনের প্রতীক ‘রোস্টার সিম্বল’ নিয়ে। কিন্তু এই আগ্রহের মধ্য দিয়েই যে পৃথিবীজুড়ে এক আদি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হবে, তা আগে বুঝিনি।

পুরো মেঘালয় ভ্রমণের সময় এই রোস্টার সিম্বল এতটাই আবদ্ধ করে রেখেছিল যে অন্য দিকগুলো প্রায় অগোচরে রয়ে গিয়েছিল। তবে দু-একটি বিষয় যে চোখে লাগেনি, তা নয়—কিন্তু গুরুত্ব পায়নি। তাই বলে কি আর মনের খচখচানি দূর হয়? মেঘালয়ে বেশ কিছু স্থানে তিনটি অসমান পাথরকে পরপর সাজানো দেখা যায়। অনেকটা আমাদের শহীদ মিনারের মতো—মাঝেরটা বড়, পাশেরটা একটু ছোট, আর ডান পাশেরটা আরও ছোট। পর্যটনকেন্দ্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনাতেও এই পাথর–সংবলিত পোস্টার-স্টিকার দেখেছি। এমনকি স্যুভেনির শপগুলোতেও ফ্রিজ ম্যাগনেটের দেখা মিলেছে। প্রথমদিকে এগুলোকে ধর্মীয় ভেবেই এড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই খচখচানি থেকেই প্রায় দুই বছর পরেও তিন পাথরের মর্ম বুঝতে নেট ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। কিন্তু সঠিক সূত্র না থাকলে লক্ষ-কোটি তথ্যের ভিড়ে অন্তর্জালে ঘাঁটাঘাঁটি করাও এক বিশাল হ্যাপা। তবে এর মধ্যেই পেয়ে গেলাম মেগালিথের সন্ধান।

আরও পড়ুন

মেগালিথ কী

‘মেগালিথ’ শব্দের অর্থ বৃহৎ শিলা নির্মাণ বা বড় পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ। প্রাচীনকালে এগুলো সমাধি, স্মৃতিচিহ্ন বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নির্মিত হতো। পৃথিবীর নানা প্রান্তে যেমন স্টোনহেঞ্জ বা ইস্টার দ্বীপের মোয়াই ভাস্কর্য মেগালিথিক নিদর্শন হিসেবে পরিচিত, তেমনি মেঘালয়াও এই মানচিত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান।

গ্রিক শব্দ ‘megas’ (বড়) ও ‘lithos’ (পাথর) থেকে এসেছে মেগালিথ। একক বিশাল পাথর হলে তা মনোলিথ নামে পরিচিত (monos = একক)।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

মেঘালয়ের মেগালিথ সংস্কৃতি

মেঘালয়ের পাহাড়ি গ্রামগুলোয় ঘুরে বেড়ালে চোখে পড়ে উঁচু-নিচু নানা আকারের পাথরের সমাহার। কোনোটি উল্লম্বভাবে দাঁড়ানো পুরুষ পাথর বা মেনহির, আবার কোনোটি সমতলভাবে বসানো নারী পাথর বা ডলমেন। স্থানীয় খাসি ও পনার ভাষায় এগুলোর ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। একত্রে এগুলোকে বলা হয় মওবিন্না।

তিন পাহাড়, তিন জাতি, তিন পাথর

এখন আসি মেঘালয়ের এই তিন পাথরের গল্পে। মেঘালয়ে স্থানীয় আদিবাসীরা মনোলিথ ও মেগালিথ সাধারণত শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য স্থাপন করেন, যা আধুনিক স্মৃতিস্তম্ভের মতোই।

বিশেষ করে তিনটি খাড়া পাথরের সমন্বয় বারবার চোখে পড়েছে। অনেকটা শহীদ মিনারের মতো সাজানো এই তিন পাথরের রয়েছে গভীর তাৎপর্য—

  • একটি পাথর পিতৃকুলের জন্য,

  • একটি মাতৃকুলের জন্য,

  • আরেকটি গোত্র বা পূর্বপুরুষের সম্মানার্থে।

এই তিনটি মনোলিথকে বুঝতে হলে মেঘালয়ের পাহাড় ও মানুষকে আরেকটু ভালোভাবে জানতে হবে। মেঘালয়ের পশ্চিমে গারো পাহাড়, মাঝে খাসি পাহাড় আর পূর্বে জৈন্তিয়া পাহাড়। এই তিন পাহাড়ে বসবাসকারী গারো, খাসিয়া ও জৈন্তিয়া জনগোষ্ঠী মিলে আজকের মেঘালয়। তাই তিনটি মনোলিথ এখানকার মানুষের কাছে শুধু পাথর নয়, এগুলো তিন জনগোষ্ঠীর ঐক্যের প্রতীক।

সরকারি প্রতীকে মেগালিথ

এতটাই সম্মানিত এই সংস্কৃতি যে ২০২২ সালে সোনালি জয়ন্তী উপলক্ষে গৃহীত মেঘালয়ের সরকারি প্রতীকে যুক্ত করা হয়েছে তিনটি মনোলিথ। প্রতীকের অন্যান্য অংশে আছে—

তিনটি পাহাড়চূড়া ‘M’ অক্ষরের আকারে গঠিত, যা রাজ্যের তিনটি পাহাড়শ্রেণি—খাসি, জৈন্তিয়া ও গারো পাহাড়কে উপস্থাপন করে।

মেঘের চিত্র রাজ্যের নামের প্রতীক; ‘মেঘালয়’, অর্থাৎ ‘মেঘের আবাস’।

তিনটি মনোলিথ রাজ্যের তিন প্রধান জনগোষ্ঠী—খাসি, জৈন্তিয়া ও গারো জাতিকে নির্দেশ করে।

ঐতিহ্যবাহী ওয়াংলা উৎসবের ঢোল।

ঐতিহ্যবাহী রিকগিতক ও পাইলা পুঁতির মালা।

ইংরেজি ভাষায় লেখা ‘Government of Meghalaya’ শব্দবন্ধ।
এই প্রতীকে একসঙ্গে ধরা পড়েছে প্রকৃতি, ঐতিহ্য ও ঐক্যের প্রতিচ্ছবি।

মেঘালয়ের জীবন্ত ঐতিহ্য

বিশ্বের বহু স্থানে মেগালিথ এখন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হয়ে আছে। কিন্তু মেঘালয়ে মেগালিথ এখনো জীবন্ত—মানুষের বিশ্বাস, আচার ও পরিচয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। তাই বলা যায়, মেঘালয়ের মেগালিথ শুধু শিলা নয়—এগুলো মানুষের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতার শক্ত প্রতীক।

লেখক: কাজী ইমদাদুল ইসলাম অনিক, সফটওয়্যার প্রকৌশলী