মেঘালয় ভ্রমণ, সেং খাসি মুভমেন্ট বা আদি খাসীয় সংস্কৃতি

ভারতের মেঘালয়ে লাল ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা বৃত্তে সবুজ রঙের মোরগের ছবি বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়।ছবি: লেখক

ভারতের মেঘালয় ভ্রমণে অনেক জায়গায় লাল ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা বৃত্তে সবুজ রঙের মোরগের ছবির স্টিকার, গাড়িতে, দেয়ালচিত্র ও আরও অনেক জায়গায় দেখলাম, বিশেষ করে ‘সোহরা’তে (চেরাপুঞ্জির আদি এবং বর্তমান নাম)। আমাদের খাসিয়া চালককে জিজ্ঞেসও করলাম, এ মোরগের মানে কী। সে না বোঝে ইংলিশ না বোঝে হিন্দি। আমি বুঝি না তার ভাষা। তাই সে আমার প্রশ্নের পাত্তা দিল না। আমিও আর তাঁকে ঘাঁটালাম না। কিন্তু মনের মধ্যে খচখচ করতে শুরু করল যখন বেশ কিছু জায়গায় আবার মোরগের স্ট্যাচু বা ভাস্কর্য দেখলাম।

যাহোক এই খচখচানি মন নিয়েই খুব সুন্দর করে মেঘালয়ের সোহরা ও শিলং ভ্রমণ শেষ করলাম। ফিরতি পথে বাসে বসে নেটে ঘাঁটাঘাঁটি করা শুরু করলাম, এই লাল মোরগের কাহিনি কী?

বাংলায় প্রথমে সার্চ করে কিছুই পেলাম না, পরে ইংরেজিতে সার্চ করতেই বাঁধল বিপত্তি। ছোট বেলায় Hen মানে মুরগি, Cock মানে মোরগ—এটাই পড়েছি। অন্য কোনো নাম জানতাম না। এমনিতেই আমার ইংরেজি ভোকাবোলারির নলেজ আলহামদুলিল্লাহ আর ইংলিশ/বাংলা দুটিরই বানান/স্পেলিং সোবাহান আল্লাহ।

মোরগের ইংরেজি Cock ছাড়া আমি তো আর কিছু জানি না। Meghalayan Cock, Cock symbol, Red Cock লিখে সার্চ করলে নেটে কী আসতে পারে, সেটা নিশ্চই ধারণা করা যাচ্ছে, এখন আমি ইন্টারনেটে কীভাবে পাই এই মেঘালয়ান Cock মানে ‘মোরগ’–এর খোঁজ। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে জানলাম মোরগের ইংরেজি আরেক নাম হচ্ছে রোস্টার (adult females who lay eggs are hens, and males are roosters, cocks, or cockerels)।

এবার খুঁজতে সুবিধা হলো, জানলাম এই মোরগ হচ্ছে ‘সেং খাসি’ মুভমেন্ট বা ‘আদি খাসীয় সংস্কৃতি ও ধর্ম রক্ষা’র যে আন্দোলন, সেটার প্রতীক। লাল চতুর্ভুজের মাঝখানে গোলাকার সাদা বৃত্তের মধ্যে সবুজ রঙের মোরগ/রোস্টার এই আন্দোলনের পতাকা। সাদা বৃত্ত হচ্ছে উদীয়মান সূর্য এবং মোরগ হচ্ছে একই সঙ্গে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, নতুন সকাল ও নতুন সময়ের প্রতীক, যে আলো নিয়ে আসে। খাসীয়দের আদি বিশ্বাস অনুসারে, মানুষ যখন পাপে মগ্ন হয়ে গিয়েছিল, তখন দেবতা সূর্যকে ঘুম পারিয়ে দেন, যাতে পৃথিবীতে আলো ছড়ানো বন্ধ হয়ে যায় এবং পৃথিবী ডুবে যায় এক অন্ধকারের সমুদ্রে। মানুষ ও প্রাণী তখন অনুশোচনা করে এবং মোরগ/রোস্টার মানুষ ও অন্য প্রাণীর হয়ে দেবতার কাছে ক্ষমা চেয়ে তার তেজোদীপ্ত ডাকে সূর্যের ঘুম ভাঙায় এবং শুরু হয় নতুন সকাল ও সময়ের। মজার কথা হচ্ছে, জাপানিরাও কিন্তু একই বিশ্বাস রাখে।

ভারতের মেঘালয়ে ‘সোহরা’তে (চেরাপুঞ্জির আদি এবং বর্তমান নাম) লাল ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা বৃত্তে সবুজ রঙের মোরগের ছবি
ছবি: লেখক

এখন আসি একটু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায়। নানা গ্রাম থেকে এলে তাঁর বড় মেয়ের বাসায় মানে আমাদের বাসায় নানুর পালা মোরগ–মুরগি থেকে পাইপলাইনে থাকা সবচেয়ে বড় ‘রাতা মোরগ’টা নিয়ে আসতেন, আবার আমি নানাবাড়ি গেলে অবধারিতভাবে পাইপলাইনের বড়টাই জবাই হতো এবং এই দুই ক্ষেত্রেই নানা জবাই করতেন আর আমি ধরতাম, তখন টের পেতাম কী প্রচণ্ড শক্তি ও তেজ একটা ‘রাতা মোরগ’–এর থাকে। জামালপুরে কিছুদিন থাকার সময় একদিন বাজার থেকে প্রথমে খাওয়ার জন্যই একটা মোরগ নিয়ে আসি, কিন্তু বাসায় আনার পর মায়ের এটা এত পছন্দ হয়ে যায় যে এটা আর রান্না না করে পালতে শুরু করলেন।

এটার চালচলন পুরো রাজার মতো, দেখতেও এত সুন্দর আর ভীষণ তেজি। মনে আছে, এটার জন্য ভাড়া বাসার পরিত্যক্ত জায়গা আমি আর মা মিলে পরিষ্কার করে গুনার বেড়া দিয়ে বিশাল বড় করে খাঁচা বানিয়েছিলাম। মোরগটা এতই তেজ ছিল যে ডানা ঝাপটিয়ে পা দিয়ে সেই খাঁচা ভেঙে পা কেটে একদম রক্তারক্তি অবস্থা।

ভারতের মেঘালয়ে মোরগ
ছবি: লেখক

মা তিন দিন রীতিমতো এটাকে ব্যান্ডেজ করে রেখেছিল এবং নিয়মিত ক্লিন করে সুস্থ করেছিল। প্রায় ছয় মাস এ মোরগটাকে নিয়েই আমার আর মায়ের অবসর সময়গুলো কাটল, এটাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য মা একেক করে প্রায় সাতটা মুরগিও পালা শুরু করলেন। তখন খুব কাছ থেকে দেখা হয়েছিল একটা মোরগের তেজ, চালচলন, খাওয়া, স্বভাবের আভিজাত্য।

আচ্ছা, মোরগের ঝুঁটিটা কি অনেকটা মেঘালয়ের মানচিত্রের মতো না? নাকি আমার একারই দৃষ্টিভ্রম।

  • লেখক: কাজী ইমদাদুল ইসলাম অনিক, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার

  • নাগরিক সংবাদে, ভ্রমণকাহিনি, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]