তৃতীয় দীর্ঘতম ও সর্বোচ্চ উঁচু রেল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, লাসা টু গোয়াংজু

লেখকছবি: লেখকের সৌজন্য

আমি যখন এই লেখাটা শুরু করি, তখন পৃথিবীর সর্বোচ্চ উঁচুতে—ট্রেনের মধ্যে। চলেছি তিব্বতের রাজধানী লাসা থেকে চীনের বাণিজ্যিক নগরী গোয়াংজুর উদ্দেশ্য। ৪ হাজার ৯১৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেব ৫৫ ঘণ্টায়। এটা পৃথিবীর তৃতীয় দীর্ঘতম ও সর্বোচ্চ উঁচু রেলপথ। জনপ্রতি ভাড়া ৯২২ ইউয়ান। এ এক অন্য রকম যাত্রাপথ। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম রেলপথ ট্রান্স সাইবেরিয়া রেলপথ, যা রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর সঙ্গে সাইবেরিয়ার ভ্লাদিভোস্টক অঞ্চলকে সংযুক্ত করেছে। এ পথের দৈর্ঘ ৯ হাজার ২৫৯ কিলোমিটার।

তিব্বতের গড় উচ্চতা ১১ হাজার ফুট। আর ভূপৃষ্ট থেকে লাসা রেলস্টেশনের উচ্চতা ১১ হাজার ৯৪৫ ফুট। এ রকম উচ্চতায় ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা সত্যিই অন্যরকম। আমাদের ট্রেনের সময় ১২.৪০ মিনিট। ১১টার মধ্যে স্টেশনে চলে আসি। যেহেতু আমরা বিদেশি, তাই আমাদের তিব্বত ট্যুরের পারমিট, পাসপোর্ট সবকিছু চেক করে ১১.৩০ মিনিট নাগাদ ওয়েটিং রুমে অপেক্ষায় থাকি। সাধারণত বিমানে যাওয়ার সময় যে রকম নিরাপত্তা চেক ইমিগ্রেশন পার হতে হয়, এখানকার ট্রেনেও একইভাবে সবকিছু করতে হলো। ১২.২০ মিনিটে আমাদের কামরায় ঢুকে পড়ি। ছোটখাটো ছিমছাম পরিষ্কার থ্রি টায়ার। আমাদের শোবার জায়গা নিচে। সাদা পরিষ্কার বিছানা, বালিশ, কম্বল—সব দারুন। ঠিক ১২.৪০ মিনিটে ছাই রংয়ের ট্রেনটি হুইসেল দিয়ে যাত্রা শুরু করল। ৫৫ ঘণ্টার জার্নি। আমরা জুতামোজা খুলে রিল্যাক্স মুডে স্লিপারে বসে আছি। অতি আধুনিক বিলাসবহুল ট্রেন। ১২ হাজার ফুট ওপর দিয়ে যাচ্ছি। স্টেশন পার হতেই চোখ ছানাবড়া। বিশাল বিশাল পাহাড়। পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। তবে এই ট্রেন নাকি ১৬ হাজার ৬০০ ফুট পর্যন্ত উঠবে। অতি উচ্চতায় স্টেশনটির নাম টেংগুলা, পরবর্তী স্টেশন। ১৬ হাজার ৬২৭ ফুট উঁচুতে।

ছবি: লেখকের সৌজন্য

টেংগুলা রেলস্টেশন পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্টেশন। লাসার বাতাসে অক্সিজেনের অভাব আছে। কারণ প্রথমত, অতি উচ্চতা, দ্বিতীয়ত এখানের পাহাড়ে গাছপালা নাই, ধূসর পাহাড়। গড়ে ১৪ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে যাত্রা হওয়ায় ট্রেনের ভেতরে যেন অক্সিজেনের সমস্যা না হয়, সে জন্য প্রেসারাইজড অক্সিজেন রয়েছে ট্রেনে। সবাই যেন স্বাভাবিক শ্বাস–প্রশ্বাস নিতে পারে। ট্রেনটিকে স্থানীয়রা বলেন ‘প্লাটো ট্রেন’ বা ‘মালভূমির ট্রেন’। এ ট্রেনে দুই ধরনের কামরা। একটা বসার আরেকটা স্লিপার। স্লিপারের সামনের করিডরে দারুণ বসার জায়গা।

কুয়েনলুল পর্বতমালার বুক চিরে ছুটে চলেছে ট্রেন। স্বচ্ছ কাচের জানালা দিয়ে চোখে পড়ে হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য। তিব্বতের মালভূমি। ধূসর রঙের পাহাড়, গুল্ম আর গাছপালাবিহীন পাহাড়। আর এসব পাহাড় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। কখনো ধূসর, কখনো হলুদ আবার কখনো লাল আভা যুক্ত। আকাশের দিকে তাকালে মন ভরে যায়। এত নীল আকাশ। মেঘ নেই। মাঝেমধ্যে বরফে মোড়ানো পাহাড় উঁকি দিচ্ছে। আবার কখনো বরফে মোড়ানো পাহাড়ের পাশ দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে। ট্রেনের দুই পাশে বরফে মোড়ানো পাহাড়। হিমবাহ গলে হ্রদে পড়ছে। আমাদের পলক পড়ে না। অপলক দৃষ্টিতে তিকিয়ে আছি। ট্রেন যাচ্ছে শব্দহীন। মাঝে পাহাড়ের বুক চিরে টানেলের মধ্য দিয়ে চলছে। কখনো কখনো ১০ মিনিট লাগছে টানেল শেষ হতে। ১১০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলছে। এ রকম অসংখ্য টানেল এ পথে।

ছবি: লেখকের সৌজন্য

তবে আমরা ট্রেনের শব্দ বলতে বুঝি ঝক ঝকা ঝক, ঝক ঝকা ঝক—এরকম কোনো শব্দ নেই। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরা। ইলেকট্রনিক ট্রেন। কোনো শব্দ নেই। মাঝেমধ্যে ভেতরে থাকা সাউন্ড সিস্টেমে চাইনিজ ভাষায় কী যেন শোনা যায়। আমরা চলেছি। স্বচ্ছ জানালা দিয়ে দেখছি মন ভরে। প্রচুর ইয়াক চোখে পড়ছে। দলবেঁধে গুল্ম খাচ্ছে। কিছু দূর যেতেই বিশাল হ্রদ। নীল পানি। মিষ্টি পানির হ্রদ। বিশাল। পাশ দিয়ে ট্রেন চলছে। হ্রদের একপাশ সুউচ্চ পাহাড়। আবার কখনও হ্রদের দৃষ্টিনন্দন রেল সেতুর ওপর দিয়ে। অনেকক্ষণ দেখার পর হ্রদটি এঁকেবেঁকে পাহাড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল। বরফে মোড়ানো পাহাড় দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বরফে মোড়ানো পাহাড়গুলো ছুঁয়ে দেখি, এত কাছ দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে ওয়েটাররা এসে আলতো করে জিগ্যেস করছে, কিছু লাগবে কি না। সব ধরনের খাবারের ব্যবস্থা আছে। অনেক লম্বা জার্নি। রাত ১০টা নাগাদ ঘুমিয়ে পড়ি। এভাবেই কাটল প্রথম দিন।

ছবি: লেখকের সৌজন্য

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতেই চোখ পড়ল পাহাড়ে। পর্বতের গায়ে রোদের খেলা। সুর্যের আলো পড়ছে পাহাড়ে। সোনালি রং ধারণ করছে পাহাড়। মনোরম সুন্দর। বরফে মোড়ানো পর্বতগুলো ততক্ষণে দৃষ্টি সীমার অনেক দূরে চলে গেছে। শুরু হয়েছে মালভূমি। সকালের প্রয়োজনীয় কাছ সেরে সকালের নাশতা করে বসে থাকি জানালার পাশে। অপার সৌন্দর্য দেখি। বিশাল মালভূমি। যতদূর চোখ যায়, জনমানবহীন। দুপাশে ধূ ধূ প্রান্তর। মাঝেমধ্যে দলবেঁধে গাধাদের বেড়ানো দেখি। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি গাধা বসবাস করে। যেদিকে তাকাই, শীতল মরুপ্রান্তর, কোথাও কেউ নেই। নির্জন, নিস্তব্ধ। হিমবাহ থেকে তৈরি হওয়া নদীর পাশ দিয়ে যাচ্ছি কখনো। দূরে দেখা যায় বরফাচ্ছাদিত পাহাড়। আর মালভূমিতে হরেক রকমের পাখি, বন্য প্রাণী, ছাগলের মতো দেখতে এ রকম একজাতীয় প্রাণীর দেখা মিলল। প্রায় ১৭ হাজার ফুট ওপরের স্টেশনে এসে ট্রনটি গতি কমিয়ে দেয়। দ্বিতীয় দিনের মাঝামাঝি সময়ে আমরা আস্তে সমতল ভূমির দিকে যাচ্ছি। মনে হলো তিব্বতের এলাকা শেষ। আমরা চীনের এলাকায় প্রবেশ করছি। চীনের এলাকায় প্রবেশ করতেই একটা স্টেশনে ট্রেন থামল। ট্রেনের এটেনডেন্টস এসে জানালো আমাদের ট্রেন পরিবর্তন করতে হবে। যেহেতু আমরা সমতলে চলে এসেছি। তাই আমাদের অন্য ট্রেনে উঠতে হবে। সবার আসন, কামরা একই থাকবে। দুটো ট্রেন পাশাপাশি দাঁড়ানো সমান্তরালভাবে। আমরা শুধু দরজা দিয়ে বের হয়ে পাশের ট্রনে উঠলাম। ভেতরের সবকিছু একই রকম। শুধু প্রেসারাইজড অক্সিজেন পার্টটুকু নেই। এভাবে দ্বিতীয় দিন পার হলো।

ছবি: লেখকের সৌজন্য
আরও পড়ুন

তৃতীয় দিনে আমরা চলছি সমতলে। পাহাড় চোখে পড়ছে তবে কিছুটা দূরে। ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলছে। প্রচুর আপেলবাগানের দেখা মিলল, রেল লাইনের দুই পাশে। তবে আমি ভুটান গিয়েছিলাম, তখন আপেল গাছগুলো অনেক বড় দেখেছি। এখনে দেখলাম ছোট ছোট গাছে বড় বড় আপেল ধরে আছে। বিশাল বিশাল বাগান। কমলার বাগানও দেখলাম। আর যতদূর চোখ যায়, বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ। ফুলকফি, বাঁধাকপি প্রচুর।

বুঝতে পারলাম আমরা প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি। টিকিটে পৌঁছানোর সময় ছিল ২০টা ১১। একদম সঠিক সময়ে ট্রেনটি গোয়াংজু স্টেশনে এসে থামল। এভাবেই আমাদের পৃথিবীর তৃতীয় দীর্ঘতম ও পৃথিবীর সর্বোচ্চ উঁচু রেল ভ্রমণ সমাপ্ত হলো।

*লেখক: মারুফ হোসেন, পর্যটক

**নাগরিক সংবাদে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। মেইল [email protected]