সাজেকে খুঁজি নিসর্গ তোমায়

ছবি: লেখকের পাঠানো

কর্মজীবনের ব্যস্তময় সময়ে অতিরিক্ত চাপের কারণে অনেক সময় শরীরে ক্লান্তি-শ্রান্তি চলে আসে। তাই ছুটে যেতে হয় কোনো এক নৈসর্গিক প্রান্তরে।

২০১৯ সালের ২১ থেকে ২৩ নভেম্বর উখিয়া থেকে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার সাজেক ইউনিয়নের পর্যটন স্পটগুলোতে ভ্রমণে গিয়েছিলাম একটি টিআরএক্স মাইক্রোবাস ভাড়া করে মোট ১১ জন। আমাদের শেড সংস্থার বিএসএফপি প্রজেক্ট ম্যানেজার শোভন-আল-ফুয়াদ ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা সেই ভ্রমণে গিয়েছিলাম কায়সার ভাই, মুকুল ভাই, তারেক ভাই, মহিউদ্দিন ভাই, কবির ভাই, আশরাফুল ভাই, রনি ভাই, নাজমুল ভাই, ফরহাদ ভাই, আমি এবং ড্রাইভার ভাই।

সেই ভ্রমণের কয়েক দিন আগের মুকুল ভাই সেন্টারে আমাকে জানাল, আমরা কয়েকজন মিলে সাজেক ভ্রমণে যাচ্ছি, আপনিও যেতে চাইলে বলুন। আমি তো সাজেকের কথা বলায় খুশিতে আটখানা! সাথে সাথেই সম্মতি জানিয়ে দিলাম।

২১ তারিখ সন্ধ্যায় পুষ্টি কেন্দ্রের কাজ করে সবাই কথামতো আমাদের প্রজেক্ট অফিস উখিয়ার জাদিমুড়ায় উপস্থিত হই। সবাই উপস্থিত হওয়ার পর শোভন ভাই আঞ্চলিক ‘আতিক্কা ট্যুর’ নামে ভ্রমণের একটি প্ল্যান তৈরি করলেন। ওখানে একেকজনের দায়িত্ব ভাগ ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন

মাগরিবের পর আমাদের গাড়িটি উখিয়া ছাড়ল। উখিয়া থেকে কক্সবাজার শহরে প্রবেশ করার পর আমরা সবাই মিলে আমাদের এক সহকর্মী ইসমাইল, যিনি কদিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি আছেন তাঁকে দেখতে গেলাম।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

নির্দেশ অনুযায়ী সবাইকে কক্সবাজার শহরে ১ ঘণ্টা সময় দেওয়া হলো ভ্রমণের কেনাকাটা সেরে নেওয়ার জন্য। আমি সেই ফাঁকে শহীদ দৌলত ময়দানে (কক্সবাজার ও পাবলিক লাইব্রেরি) একটি মিউজিক্যাল ব্যান্ড প্রোগ্রাম উপভোগ করি।

সন্ধ্যা ৭টায় গাড়ি কক্সবাজার থেকে সাজেকের উদ্দেশে রওনা দিল। গাড়িটি গিয়ে প্রথমে সোজা চকরিয়ায় যাত্রাবিরতি দিল এবং আমরা সেখানে হালকা নাশতা সেরে আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম।

রাতে ঘুমঘুমভাবে নিজেকে আবিষ্কার করি চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছে গেছি। চোখ খুলতেই দেখি একটি ফিলিং স্টেশনে গাড়িতে রিফুয়েলিং হচ্ছে।

তারপর গাড়ি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক হয়ে সোজা খাগড়াছড়ি সড়কে রওনা দিল। শীতের রাতের এই ঠান্ডায় রাস্তাঘাটে যানবাহন ও মানুষের আনাগোনা কম ছিল। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা দুর্গম সড়ক, গাড়ি চলছে একবার উঁচুতে, আরেকবার নিচুতে।
সকালে নিজেকে আবিষ্কার করি আমরা খাগড়াছড়ি শহরে। সারা রাত আমি নাকি সহকর্মীদের কাঁধে ভর দিয়ে অনেক ঘুমিয়েছিলাম। খাগড়াছড়ি শহর থেকে একটি রেস্তোরাঁয় নাশতা খেয়ে আমরা আবার একটু পেছনে ফিরে এসে আমাদের ভ্রমণের প্রথম স্পট আলুটিলা গুহায় ঘুরি। আসলেই আলুটিলা গুহা একটি সুন্দর জায়গা। খাগড়াছড়ির পুরো শহরটি এখান থেকে সহজে দেখা যায়।

আলুটিলা ভ্রমণ শেষ হলে আমরা খাগড়াছড়ি শহরে পুনরায় ঢুকে দীঘিনালা উপজেলা পর্যন্ত যাই। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে একটি চাঁদের গাড়ি ভাড়া করে সাজেকের উদ্দেশে রওনা হই।

চাঁদের গাড়ি যখন সাজেকের দুর্গম উঁচু–নিচু পাহাড়ি সড়কে চলছে, তখন মাঝেমাঝে অনেক ভয় পেয়ে যাই, আবার সহকর্মীদের সাথে দুষ্টুমি করে অনেক সময় মজাও পাই। এ রকম সুউচ্চ পাহাড়ি সড়ক এর আগে দেখিনি। দীঘিনালা থেকে সাজেকের রুইলুই পাড়া পর্যন্ত পৌঁছাতে পুরো যাত্রাকালে বিজিবি বাহিনীর বহর ছিল ট্যুরিস্টদের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য।

রুইলুই পাড়ায় পৌঁছে আমাদের ভ্রমণ দল একটি দোতলা কাঠের আবাসিক হোটেলে ওঠে। হোটেলের রুমে ঢুকে রিফ্রেশ হয়ে একটি রেস্তোরাঁয় নাশতা করতে যাই। ব্যাম্বু ফ্রাই, পরোটাসহ অন্যান্য নাশতা পরিবেশন করা হয় আমাদের।

রাতে সাজেকের রুইলুই পাড়ায় ঘুরি, হেলিপ্যাডের স্থানে পূর্ণিমার আলোতে বসে গান ও আড্ডার আয়োজন হয়। এসব শেষে চিলেকোঠা রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেয়ে আবার আবাসিক হোটেলটিতে ফিরে আসি। রাতে ওখানে সবাই নিদ্রা গ্রহণ করি। এই রাতটিতে অনেক ঠাট্টা-মজার মাঝে সবচেয়ে মনে পড়ে সহকর্মী কবির ভাইয়ের স্বপ্নের ঘুম ভেঙে গিয়ে চমকে উঠে খাটে শোয়া আমাদের সবাইকে খাট থেকে ফেলে দেওয়া।
প্রত্যুষে হোটেলের জানালা খুলে দেখি কি সুন্দর কুশায়াচ্ছন্ন ভোর! শোভন ভাইয়ের ডাকে এই ভোরে উঠে যখন সবাই হেলিপ্যাডে দাঁড়িয়ে কুয়াশাগুলো দেখি, তখন মনে হয়েছিল যেন মেঘ ছুঁয়েছি।

সকালে চিলেকোঠা রেস্তোরাঁয় কাঁচা ফল কলা, পেঁপে ও ব্যাম্বু বিরানি দিয়ে নাশতা সারি। তারপর সাজেকে নির্মিত সেনাবাহিনীর সুন্দর রেস্টুরেন্ট ও অবকাশকেন্দ্রগুলোতে ঘুরি, সবাই মিলে জিরো পয়েন্টে ছবি তুলি।

তারপর বের হই কংলাক পাহাড়ে আরোহণের উদ্দেশ্যে। সবাই একটি একটি বাঁশ লাঠি নিয়ে কংলাকে যাই। পথিমধ্যে কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঢুকে শিশুশিক্ষার্থীদের মাঝে বেসিক পুষ্টি শিক্ষা দেওয়া শেষে নাশতা বিতরণ করা হয়।

স্কুলটির শিক্ষকদের আন্তরিকতা কখনো ভোলার নয়। স্কুলের পাশের দোকানের দোকানি মেয়েটি ছিল স্কুলের ম্যাডামের মেয়ে। যেহেতু বাল্যকাল থেকেই ম্যাডামের মেয়েটি ভারতের মিজোরামে অধ্যয়নরত আবার বাংলা ভাষাও জানেন না, সেহেতু তার সাথে আমি ইংরেজি ভাষায় কথোপকথন করে তাদের এলাকা সাজেক, মিজোরামের অবস্থা জানতে পারি। কংলাক প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে এবার অনেক কষ্টে কংলাক পাহাড়ের সুউচ্চ চূড়ায় শেষ পর্যন্ত ঘর্মাক্ত হয়ে আরোহণ করা সম্ভব হয় আমাদের। কংলাক পাহাড়ের চূড়ার দোকানি পাহাড়ি এক দিদির ভাষ্য অনুযায়ী সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৬ ফুট উঁচুতে আরোহণ করেছি আমরা।
কংলাক পাহাড় থেকে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা উখিয়ায় ফেরার উদ্দেশে রওনা হই। সাজেক ভ্রমণ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দকর ভ্রমণ, যার স্মৃতিরোমন্থন করলে এখনো মনে হয় সাজেকের মতো নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আঁধারে যেন আবার যেতে পারি।

লেখক: মাহবুব নেওয়াজ মুন্না