চট্টগ্রাম থেকে সিউল: ভ্রমণ অভিজ্ঞতা-২

ছবি: লেখকর পাঠানো

শাহনেওয়াজ ফিরোজ

প্রথম পর্বের পরে...

এন সিউল টাওয়ার: দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। এটি সিউলের একটি আইকনিক চিহ্ন হিসেবে পরিচিত এবং শহরের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে এন সিউল টাওয়ার সম্পর্কে কিছু তথ্য দেওয়া হলো—

অবস্থান ও উচ্চতা: এন সিউল টাওয়ার, সিউলের ন্যাশনাল প্রতিবেশী পার্কের মধ্যে অবস্থিত, ম্পংগিয়াং পাহাড়ের শীর্ষে অবস্থিত। শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩০০ মিটার (৯৮১ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত। এই টাওয়ারের সর্বমোট উচ্চতা ৪৩ মিটার (১৪১ ফিট) এবং এটিকে ১৯৮০ সালে নির্মিত হয়েছিল। টাওয়ারটি শহরের মধ্যে অন্যতম উচ্চতম ভবন।

প্যানোরামিক ভিউ: এন সিউল টাওয়ার থেকে সিউলের অসাধারণ প্যানোরামিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। এখানে দর্শনার্থীরা শহরের বিস্তীর্ণ দৃশ্যসহ এর চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে পারেন।

অবসরে সময় কাটানোর সুযোগ: টাওয়ার কামরা একাধিক রেস্তোরাঁ এবং ক্যাফে রয়েছে, যেখানে দর্শনার্থীরা কফির কাপের সঙ্গে শহরের দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।

লকস লাগানো: এন সিউল টাওয়ারে বিশেষভাবে ‘লকস’ (লক) লাগানোর একটি রীতি চালু রয়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকারা এখানে তাঁদের নাম ও তারিখ লেখার পর একটি লক লাগিয়ে তাদের প্রেমের স্থায়িত্বের প্রতীক হিসাবে এটি মজবুত করে রেখেছেন।

শিল্প প্রদর্শনী: টাওয়ারের সামনে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিল্প এবং সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়, যা এসকিউল মানুষের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে প্রদর্শন করে।

ছবি: লেখকর পাঠানো

যাতায়াত, সময় ও টিকিট ক্রয়

দর্শনার্থীরা টাওয়ার পর্যন্ত হাঁটা বা ক্যাবলের মাধ্যমে পৌঁছাতে পারেন। পাশাপাশি, নানা ধরনের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাও রয়েছে, যা টাওয়ার অভিমুখী।

কেবল কার: টাওয়ারে যাওয়ার জন্য কেবল কার পরিষেবা রয়েছে, যা দর্শনার্থীদের জন্য সহজ এবং মজাদার; যাতে সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

খোলার সময়: এন সিউল টাওয়ার সাধারণত সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খোলা থাকে, কিন্তু সময় পরিবর্তিত হতে পারে, তাই নির্দিষ্ট সময় জানতে আগে থেকে যোগাযোগ করা উচিত।

টিকিট মূল্য: টিকিটের মূল্য প্রাপ্তবয়স অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে এবং বিভিন্ন প্যাকেজের মাধ্যমে অফার করা হয়।

এন সিউল টাওয়ার সিউলের কেন্দ্রবিন্দুর কাছে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান। যদি আপনার সিউলে ভ্রমণের সুযোগ হয়, তবে এটি আপনার পর্যটন তালিকায় অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এখানে এসে আপনি সিউলের মনোরম দৃশ্য এবং সংস্কৃতি উপভোগ করার পাশাপাশি একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন।

ছবি: লেখকর পাঠানো

লট্টে ওয়ার্ল্ড এবং লট্টে ওয়ার্ল্ড টাওয়ার

লট্টে ওয়ার্ল্ড এবং লট্টে ওয়ার্ল্ড টাওয়ার সিউলে বেড়ানো এবং উপভোগ করার জন্য স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় স্থান।

আরও পড়ুন

লট্টে ওয়ার্ল্ড

লট্টে ওয়ার্ল্ড একটি বিশাল বিনোদন পার্ক, শপিং মল এবং হোটেল কমপ্লেক্সের সমন্বয়ে গঠিত। এটি সিউলের bustling সঙ্গে সমৃদ্ধ একটি গন্তব্য যেখানে পর্যটকেরা অনেক রকমের বিনোদনমূলক কার্যক্রম উপভোগ করতে পারেন। এখানে বিভিন্ন থিম করে আকর্ষণীয় রাইড, শিশুদের জন্য বিশেষ বিনোদন ব্যবস্থা এবং পারফরম্যান্স শো অনুষ্ঠিত হয়।

ছবি: লেখকর পাঠানো

লট্টে ওয়ার্ল্ড টাওয়ার

লট্টে ওয়ার্ল্ড টাওয়ার সিউলের একটি চমৎকার স্থাপনা এবং এটি দক্ষিণ কোরিয়ার সর্বোচ্চ ভবন, ২৫৩৩ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত। টাওয়ারের ওপর থেকে সিউলের অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি উপভোগ করা যায়। শীর্ষে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন পয়েন্টে গিয়ে গোটা শহরের মনোজ্ঞ দৃশ্য দেখতে পারেন, যারা উচ্চতা–প্রেমী তাদের জন্য এটি একটি স্বর্গ।

বিনোদন এবং শপিং

লট্টে ওয়ার্ল্ডে রয়েছে বিভিন্ন রেস্তোরাঁ, যেখানে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক খাবারের সুবিধা প্রদান করা হয়। এছাড়া, এখানে বিশাল শপিং মল রয়েছে, যেখানে আপনি ব্রান্ডেড পোশাক, গহনা, সৌন্দর্য পণ্য ও অন্যান্য সামগ্রী কিনতে পারবেন।

সারসংক্ষেপে, লট্টে ওয়ার্ল্ড এবং লট্টে ওয়ার্ল্ড টাওয়ার সিউল একটি আদর্শ গন্তব্য, যা সব বয়সী দর্শকদের জন্য নানা রকমের কার্যক্রম এবং বিনোদনমূলক সুযোগ প্রদান করে। এখানে বেড়ানো কোরিয়ানদের নজরের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের কাছেও একটি অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে।

ছবি: লেখকর পাঠানো

গ্যাংনাম  সিটি

দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অবস্থিত গ্যাংনাম-গু তার প্রাণবন্ত এবং উচ্চতর পরিবেশের জন্য বিখ্যাত। এটি একটি প্রচলিত এবং সমৃদ্ধ জেলা হিসাবে বিখ্যাত, প্রায়ই বিলাসবহুল কেনাকাটা, উচ্চমানের ফ্যাশন এবং আধুনিক বিনোদনের সঙ্গে যুক্ত। গ্যাংনাম সিটি সত্যিই একটি আকর্ষণীয় স্থান, বিশেষ করে যারা বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং আধুনিক সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী। সিউলের এই এলাকাটি শুধু দরদামে নিত্য নতুন ট্রেন্ডের জন্য নয়, বরং এর আর্কিটেকচার এবং শহরের সার্বিক ভঙ্গির জন্যও পরিচিত।

ফেরারি (Forza Motors Korea) শোরুম দেখার অভিজ্ঞতা অনেকের জন্য স্বপ্নের মতো হতে পারে। এখানে বিভিন্ন মডেলের ফেরারি গাড়ি প্রদর্শিত হয়, যা গাড়ি–প্রেমীদের জন্য এক অসাধারণ দৃষ্টি। এই শোরুমের আশেপাশে বিএমডব্লিউ শোরুমও রয়েছে, যা মোটরসাইকেল ও গাড়িপ্রেমীদের জন্য আরেকটি আকর্ষণ।

গ্যাংনামের প্রাণবন্ত পরিবেশ, ক্যাফে, রেস্তোরাঁ ও বুটিক্সের মধ্যে সেসব বিলাসবহুল গাড়ির শোরুম আরও একটি পরিমণ্ডল তৈরি করে।

সিউল পুরাতন প্রেসিডেন্ট ভবন পরিদর্শন

সিউলের পুরাতন প্রেসিডেন্ট ভবন, যাকে সাধারণত ‘The Blue House’ বলা হয়, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের অফিস এবং আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। এটি সিউলের বুকে অবস্থিত এবং একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক স্থান।

ছবি: লেখকর পাঠানো

পরিদর্শনের জন্য তথ্য:

ঠিকানা: সিউলের উপকণ্ঠে অবস্থিত, গিওংবুকগুন এলাকায়।

প্রবেশদ্বার: বেশির ভাগ সময় সাধারণ জনগণের জন্য প্রবেশের সুবিধা পাওয়া যায়। তবে, কিছু সময়সূচী ও নিরাপত্তার কারণে প্রবেশ নিষিদ্ধ হতে পারে।

ভবনের স্থাপত্য: ভবনটির স্থাপত্য কোরিয়ান ঐতিহ্যবাহী ডিজাইন অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে, যার গায়ে রয়েছে নীল রঙের টাইলস, যা এটিকে একটি বিশেষ স্বকীয়তা দেয়।

অবস্থান ও সৌন্দর্য: The Blue House শহরের বিশাল পাহাড়ি প্রেক্ষাপটে অবস্থিত এবং এর চারপাশে সুন্দর বাগান ও প্রাকৃতিক দৃশ্য রয়েছে।

সংস্কৃতি ও ইতিহাস: ভবনটি দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ও বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

পরিদর্শন সময়: সাধারণত সামাজিক অনুষ্ঠান বা সরকারি কাজের জন্য পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী পরিদর্শনের সুযোগ পাওয়া যায়।

ট্যুর পরিচালনা: অনেক সময়, গাইডেড ট্যুরের ব্যবস্থা থাকে, যা ভবনের ভেতরের ইতিহাস ও তথ্য জানাতে সহায়ক।

ছবি: লেখকর পাঠানো

নির্দেশনাসমূহ:

প্রতিবন্ধকতা: ভবনটির ভেতর প্রবেশের জন্য বিশেষ নিয়মাবলি অনুসরণ করতে হবে।

ছবি তোলার নিয়ম: ছবি তোলার ক্ষেত্রে কিছু নিয়মাবলি আছে, সেগুলি মেনে চলা উচিত।

আপনি যদি সিউল-এ The Blue House পরিদর্শনে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন, তবে স্থানীয় সময়সূচী ও নিয়মাবলি সম্পর্কে আগেই  তথ্য সংগ্রহ করা উচিৎ। এটি একটি অভিজ্ঞতা হবে, যা আপনাকে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি গভীর ধারণা দেবে।

ছবি: লেখকর পাঠানো

দক্ষিণ কোরিয়ার খাবার

দক্ষিণ কোরিয়ার খাবার স্বাদ গ্রহণ না করলে ভ্রমণ অসম্পূর্ণ। কিমচি, বিবিম্বাপ (Bibimbap), গ্রিলড মাংস (কোরিয়ান বারবিকিউ) এবং বিভিন্ন ধরনের রাস্তার খাবার চেষ্টা করেছি।

১. কিমচি: খাবারটা আসলে বিদেশিদের জন্য নয়। কোরিয়াতে বেশিরভাগ রেস্তোরাঁয় (কিংবা যে কোনো জায়গায়) আপনি কিমচি খেতে পারেন। এটা আসলে পিকেল্ড (বা আচারে পরিণত করা) বাঁধাকপি। প্রথম প্রথম এটি খেতে ভালো না লাগলেও যখন ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন, তখন এটিকে খুব সুস্বাদু মনে হবে! তা ছাড়া, এটি খুব স্বাস্থ্যকর।

২. ডাকগালবি: এটা হলো কোরিয়ান লঙ্কার পেস্ট দিয়ে বানানো স্টার-ফ্রায়েড চিকেন (ভাজা মুরগি)। আমরা এর অবশিষ্ট সসের সঙ্গে ফ্রাইড রাইস বানিয়েও পরিবেশন করি। আপনি ডাকগালবিকে অনেক রেস্তোরাঁতে দেখতে পাবেন, কারণ, এটা খুব সস্তা!

৩. কোরিয়ান চিকেন: আপনি হয়তো ভাবছেন সব দেশেই তো চিকেন পাওয়া যায়, এতে নতুন কি? তা হতে পারে, কিন্তু এই কোরিয়ান পদটা সত্যিই অনেকটা আলাদা, অরেঞ্জ ফ্লেভারে কিছুটা মিষ্টি, ক্রিস্পি।

৪. ব্যাকবান-জেওংসিক: এটা হলো বাস্তব কোরিয়ান শৈলীর খাবার—একসঙ্গে অনেক রকমের সাইড ডিশ এবং প্রধান খাবারের ভরপুর সংমিশ্রণ। সুতরাং আপনি একসঙ্গে অনেক রকম স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন। আমি বলতে চাই, এর জন্য আপনাকে ভালো মানের ব্যাকবান রেস্তোরাতে যেতে হবে, কারণ, এর স্বাদ অন্য জায়গার তুলনায় রেস্তোরার মানের ওপর নির্ভর করে।

৫. গিম্বাপ বা কিম্বাপ: গিম্বাপ বা কিম্বাপ হল কোরীয় এক জনপ্রিয় খাবারের নাম। যা সামুদ্রিক শৈবাল, ভাত, বিভিন্ন সবজি, বিভিন্ন মাছ, মাংস, ডিম দিয়ে তৈরি করা হয়। ‘গিম্বাপ’ সাধারণত রোল করে ছোট ছোট অংশে কেটে পরিবেশন করা হয়।

এ ছাড়া আরো কিছু জনপ্রিয় খাবার রয়েছে, যেমন — নায়েং-মিউওন, গালবিজ্জিম, বুলগোগি, বুডেজ্জিগে, হোএ, গেজাঙ, আগউইজ্জিম, রামেণ, কিমচি ফ্রাইড রাইস, মাকচাঙ, সানডে, ইউখোয়ে, জকবাল, বসাম, গুকবাপ্... ইত্যাদি।

ছবি: লেখকর পাঠানো

শেষ কথা

সিউল সত্যিই একটি জীবন্ত শহর, যেখানে ইতিহাস এবং সংস্কৃতি আধুনিকতার সঙ্গে মিশে গেছে। এখানে যাত্রা করলে তা আপনার মনে দাগ কাটবে এবং নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করবে। এই সফরের স্মৃতি আমি সারাজীবন স্মরণ করব এবং আশা করব আবার কোরিয়াতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাব।

নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]