চট্টগ্রাম থেকে সিউল: ভ্রমণ অভিজ্ঞতা-১

কোরিয়ান কোম্পানি ইয়াংগনে চাকরির সুবাদে দক্ষিণ কোরিয়া ভ্রমণের সুযোগটি আমার জন্য এক বিশেষ অভিজ্ঞতা। এ সফরকে আমি পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড হিসেবে গ্রহণ করি এবং আমি ভাগ্যবান যে দুইবার সুযোগটি পেয়েছি।

প্রথম সফর

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম কোরিয়া সফর। এটি ছিল আমার প্রথম আন্তর্জাতিক সফর। একা বিদেশে যাওয়ার অনুভূতি ছিল একেবারে অনন্য। প্রথম যাত্রাটি বিশেষ আনন্দের ছিল। কারণ, আমি আমাদের চেয়ারম্যান সাং কি-হক (Mr. Kihak Sung) এর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত জেট (ফেলকন) বিমানে কোরিয়া যাই। পুরো বিমানে আমরা তিনজন, সঙ্গে দুইজন পাইলট। এটি ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কোরিয়ার সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, খাবার এবং দেশটির মানুষের আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমার কাজের পরিবেশ এবং সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে আমি তাঁদের কাজে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছিলাম।

দ্বিতীয় সফর

২০২৩ সালের জুনে আবার কোরিয়া যাওয়ার সুযোগ পাই। এবার সঙ্গে আমার টিমের এক সহকর্মী ছিলেন এবং অন্য ইউনিটের আরও তিনজন। সফরটি আমার জন্য একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা ছিল। কারণ, আমরা একসঙ্গে কাজ করি এবং অভিজ্ঞতা বিনিময় করি। অন্য ইউনিটের তিনজন সদস্য আমাদের দুজনের এক সপ্তাহ পরে কোরিয়া পৌঁছান। পরে আমরা একসঙ্গে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করি।

দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল সত্যিই এক আকর্ষণীয় শহর। এখানে আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের এক অত্যাশ্চর্য সমন্বয় ঘটে। সিউলে ভ্রমণের সময় দেখেছি কীভাবে আধুনিক স্থাপত্য ও প্রযুক্তি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করে।

কোম্পানির হেড অফিস

ইনচন বিমানবন্দরে নামার পর আমাদের কোরিয়ান টিমের ইনচার্জ, মিস এলিস আন্তরিকতাসহ স্বাগত জানান। তিনি আমাদের কোম্পানির গেস্ট হাউসে নিয়ে যান। এটি  বিমানবন্দর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে হেওয়া (Hyehwa) নামে সুন্দর স্থানে। গেস্ট হাউসের পরিবেশ অত্যন্ত সুন্দর ও আরামদায়ক ছিল। এলিস আমাদের জন্য সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি আমাদের জন্য লোকাল ট্রান্সপোর্ট কার্ড করে দেন এবং খাবারের ব্যবস্থা করেন।

পরদিন আমরা কোম্পানির হেড অফিসে গেলাম। পূর্বের অভিজ্ঞতার কারণে আমি সহজেই পৌঁছাতে পেরেছিলাম কোনো সমস্যা ছাড়াই। আমাদের কোম্পানির হেড অফিস সিউল মেট্রো স্টেশনের কাছে। সেখানে পৌঁছানোর পর আমাদের সিনিয়র টিম ইনচার্জ এলিসকে রিপোর্ট করলাম। তিনি আমাদের অফিসের অন্য সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং আমাদের ডেস্কটি দেখিয়ে দিলেন।

এটি একটি পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড ট্রিপ হলেও, আমাদের কিছু নিয়মিত অফিস কাজও সম্পন্ন করতে হয়েছিল হেড অফিসে। সেখানে কাজের পরিবেশ অত্যন্ত উৎসাহজনক ছিল এবং আমরা নতুন সম্পর্ক গড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এরপর আমরা আরও কী কী কার্যক্রম করব বা কোথায় যাব, সেই পরিকল্পনা করতে শুরু করলাম।

গিয়ানগাক প্যালেস

সিউলে পৌঁছানোর পর আমাদের ভ্রমণ শুরু হয় বিখ্যাত গিয়ানগাক প্যালেস দিয়ে। গিয়ানগাক প্যালেস সিউলের অন্যতম ঐতিহাসিক এবং বিখ্যাত স্থান। এটি জোসন রাজবংশের প্রধান রাজপ্রাসাদ হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৩৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত, এই প্রাসাদটি কোরিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীন প্যালেস, যা তার ইতিহাস ও সংস্কৃতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্যালেসটি সিউলের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং এখানে প্রবেশ করলেই পুরানো ঐতিহ্যের এক অনন্য অনুভূতি হয়। প্যালেসের চারপাশে অসাধারণ দেয়াল ও সুন্দর বাগান দেখা যায়, যা প্রাকৃতির সৌন্দর্যকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। আমরা প্যালেসের সামনে গিয়ে পরিবর্তন অনুষ্ঠানের বিশাল দৃশ্য উপভোগ করলাম। এটি কোরিয়ান ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিহিত সৈন্যরা ঐতিহাসিক স্মৃতি জাগিয়ে তোলে।

নামডেমুন মার্কেট এবং মিয়োংডং প্যালেস পরিদর্শনের পর আমরা নামডেমুন মার্কেট এবং মিয়োংডং এলাকায় ঘুরেছি। সিউলের দুটি খুবই জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় শপিং এলাকার নাম।

নামডেমুন মার্কেট

নামডেমুন মার্কেট সিউলের সবচেয়ে পুরনো এবং বৃহত্তম ঐতিহ্যবাহী বাজার। এখানে নানান ধরনের পণ্য মেলে। যেমন পোশাক, আনুষঙ্গিক সামগ্রী, ইলেকট্রনিক্স, হস্তশিল্প এবং আরও অনেক কিছু। বাজারটি দিন–রাত সব সময় খোলা থাকে। তাই এখানে যেকোনো সময় কেনাকাটা করতে পারেন। এটি কোরিয়ান সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে আপনি কোরিয়ান খাবারও উপভোগ করতে পারেন।

মিয়োংডং

মিয়োংডং সিউলের অন্যতম বিখ্যাত শপিং এবং ফ্যাশন জেলা। এটি আধুনিক এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জন্য পরিচিত। এখানে আপনি বিভিন্ন ধরনের কসমেটিকস, পোশাক এবং ফ্যাশন অ্যাকসেসরিজ কিনতে পারেন। এ ছাড়া, মিয়োংডং-এ অনেক ভালো রেস্তোরাঁ এবং রাস্তার খাবারের স্টল আছে, যেখানে কোরিয়ার সুস্বাদু খাবারের স্বাদ নিতে পারবেন। এ দুটি স্থানে ঘুরে আপনি সিউলের সংস্কৃতি এবং আধুনিকতার একটি চমৎকার মিশ্রণ উপভোগ করতে পারবেন।

সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য-বুকচন হানোক ভিলেজ

আমাদের সফরের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বুকচন হানোক ভিলেজ ঘুরে দেখা। বুকচন হানোক ভিলেজ সিউলের অন্যতম সুন্দর ও ঐতিহ্যবাহী স্থান। এটি একটি ঐতিহাসিক গ্রাম যেখানে ৬০০ বছরের পুরনো কোরিয়ান হানোক ঘরবাড়ির স্থাপত্য দেখতে পাওয়া যায়। এ হানোকগুলো জোসন রাজবংশের আমলের এবং বর্তমানে অনেকগুলো ঘর সংস্কৃতি কেন্দ্র, গ্যালারি, রেস্তোরাঁ ও চা–ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বুকচন হানোক ভিলেজের সরু রাস্তা এবং ঐতিহ্যবাহী ঘরবাড়ি ঘুরে দেখতে একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা। এখানকার ঘরগুলোর স্থাপত্যশৈলী খুবই দৃষ্টিনন্দন, যা কোরিয়ান ঐতিহ্যকে প্রকাশ করে। গ্রামটি পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত হওয়ায়, সেখান থেকে সিউলের চমৎকার দৃশ্যও উপভোগ করা যায়। ভিলেজের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর সময় আপনি কোরিয়ার পুরানো সময়ের একটি স্বাদ পাবেন, যা আপনার সফরের অন্যতম স্মরণীয় অংশ হয়ে থাকবে।

হান নদীর পার

হান নদী প্রায় ৫১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ (কোরিয়ান উপদ্বীপের চতুর্থ দীর্ঘতম নদী) এবং সিউল শহরের সীমার মধ্যে, নদীটি ১ কিলোমিটার এরও বেশি প্রশস্ত, প্রসারিত। সিউলের উত্তর ও দক্ষিণ অংশকে সংযুক্ত করে ২৭টি সেতু নদী অতিক্রম করেছে। হান নদীর পার সিউলবাসীরা এবং পর্যটকদের জন্য একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় স্থান। নদীটির সৌন্দর্য ও সংস্কৃতি লোকেদের আকৃষ্ট করে থাকে।

হান নদীর পারে বিভিন্ন বিনোদনমূলক কার্যক্রম রয়েছে, যেমন সাইক্লিং, হাঁটা এবং পিকনিক। নদীর দুই পাশে রয়েছে সুন্দর পার্ক, যেখানে বিশাল সবুজ এলাকা, খেলার মাঠ এবং বিশ্রামের ব্যবস্থাও রয়েছে। বিশেষ করে, সন্ধ্যার দিকে নদীর পারে বসে সূর্যাস্ত উপভোগ করা একটি অতুলনীয় অভিজ্ঞতা। এ ছাড়া এটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সেতুগুলোর কারণে উত্তর ও দক্ষিণ সিউলকে সংযুক্ত করেছে, যা শহরের পরিবহনব্যবস্থা এবং অন্য সাংস্কৃতিক স্থানগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনপ্রিয় হান নদীর সেতুগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘মাপনাং সেতু’ এবং ‘ওলডাঙ্গ সেতু’ যেখানে প্রতিদিন অনেক লোক যাতায়াত করে। নদীর পারে সেখানে কিছু ক্যাফে ও রেস্তোরাঁও রয়েছে, যেখানে আপনি নদীর নৈসর্গিক দৃশ্যের সামনে বসে খাবার উপভোগ করতে পারবেন।

অতএব হান নদীর পার একটি জীবন্ত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, যেখানে স্থানীয় এবং বিদেশি পর্যটকেরা একসঙ্গে এসে প্রকৃতির মধ্যে সময় কাটাতে পারেন। চলবে...

*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]