নোহকালিকাই ফলস—অশ্রুসিক্ত বেদনাময় এক জলপ্রপাত

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

ভারতের মেঘালয় রাজ্যর চেরাপুঞ্জি যাওয়ার পথে দেখা মেলে এই জলপ্রপাতেরছবি: লেখকের পাঠানো

নোহকালিকাই জলপ্রপাতের নামকরণের করুণ কাহিনি শুনলে চোখে জল আসতে বাধ্য। এর উচ্চতা ১ হাজার ১২০ ফুট। এটা ভারতের অন্যতম উঁচু জলপ্রপাত। মেঘালয় রাজ্যর চেরাপুঞ্জি যাওয়ার পথে দেখা মেলে এই জলপ্রপাতের। কেউ গিয়েই সঙ্গে সঙ্গে এই ঝরনা দেখে ফেলেছেন, এমন লোকের সংখ্যা খুব কম। বর্ষাকালে এটার দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সারাক্ষণ মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি করে এই ঝরনা। কখনো কখনো মেঘের চাদর সরিয়ে একটুখানি উঁকি মেরে যাবে। উঁকি মেরেই আবার লুকিয়ে যাবে মেঘের চাদরে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি—শুধু সৌন্দর্যই নয়, নোহকালিকাই ঝরনার নামকরণের নেপথ্যে রয়েছে করুণ কাহিনি। সেই কাহিনি শুনে আনন্দের মধে৵ও চোখে জল আসে পর্যটকদের।

চেরাপুঞ্জি যাওয়ার পথে বর্ষাকালে এটার দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সারাক্ষণ মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি করে এই ঝরনাটি
ছবি: লেখকের পাঠানো।

খাসিয়াদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। সমাজের নিয়ম মেনে বেশ সুষ্ঠু জীবন চলছিল রংযাইরতেহ গ্রামের বাসিন্দা লিকাইয়ের। মাত্র ১৯ বছর বয়সে স্বামীহারা হলেন লিকাই। এক সন্তানকে নিয়ে শুরু হলো বৈধব্যযাপন। জঙ্গলে কাঠ বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করেই মা-মেয়ের সংসার চালান লিকাই। ইতিমধ্যেই এক যুবকের মনে দাগ কাটলেন লিকাই; কিন্তু মেয়ে থাকায় দ্বিতীয়বার আর ঘর বাঁধতে রাজি হননি একলা মা। যুবকও নাছোড়বান্দা। বেশ ঘোরাঘুরি শুরু করলেন লিকাই পেছনে। প্রতিনিয়তই প্রেম নিবেদন করতে থাকেন যুবকটি। বেশ কয়েক দিন পর রাজি হয়ে যান লিকাই। আবারও বিয়ে করলেন তিনি। খাসিয়াদের মাতৃতান্ত্রিক সামাজিক রীতি অনুযায়ী লিকাইয়ের বাড়িতে এসে সংসার করতে শুরু করলেন যুবক। দিনে লিকাই কাজ করেন। আর ঘরে মেয়েকে সামলান ওই যুবক। রাতে বাড়ি ফিরে মেয়েকে নিয়ে সময় কাটতে থাকে লিকাইয়ের। প্রথম কয়েক দিন বেশ ভালই লাগছিল তাঁর। বাসায় ফিরে লিকাই মেয়েকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতেন। ফলে দুরত্ব বাড়তে থাকে দুজনের। দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রীর সঙ্গে দূরত্বের জন্য লিকাইয়ের মেয়েকে দায়ী করতে থাকেন যুবক। রীতিমতো আক্রোশ তৈরি হয়ে যায় মেয়েটির ওপর। লিকাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই মেয়েটিকে বেধড়ক মারধর করতে শুরু করতেন যুবক। যদিও তা ঘুণাক্ষরে টের পাননি লিকাই।

আরও পড়ুন

একদিন কাজ সেরে বাড়ি ফিরে মেয়েকে দেখতে পাননি লিকাই। ক্লান্ত শরীরে খিদে নিয়ে খেতে বসেন লিকাই। যুবকের রান্না করা মাংস দিয়ে ভাতও খেয়ে ফেলেন তিনি। এরপর পান সাজাতে বসেন; কিন্তু ওই কাজ করতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ লিকাইয়ের। দেখতে পান, পানের বাটা থেকে বেরোচ্ছে কাটা আঙুল। মায়ের মন শিউরে ওঠে। এ আঙুল যে মেয়ের ছাড়া কারও নয়, তা বুঝতে একমুহূর্তই যথেষ্ট।

নোহকালিকাই জলপ্রপাতের সামনে সপরিবারে লেখক
ছবি: লেখকের পাঠানো
আরও পড়ুন

ইতিমধ্যেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন লিকাইয়ের দ্বিতীয় স্বামী। লিকাইয়ের চিৎকার চেঁচামেচিতে আশপাশের বাতাস ভারী হয়ে যায়। তাকে খুঁজে বের করে আনেন গ্রামবাসী। নিজের মুখে লিকাইয়ের স্বামী স্বীকার করেন কেবলমাত্র আক্রোশের বশেই মেয়েকে খুন করে হাড় ফেলে দেন ওই ঝরনায়। আঙুলটি ফেলতে ভুলে যান। সে জন্য খুনের কথা টের পেয়ে যায় লিকাই। একথা শুনে শোকে পাথর হয়ে যান সন্তানহারা মা লিকাই। কারও কথা না শুনে তিনি দৌড়ে যান ঝরনার কাছে। সেখানেই ঝাঁপ দেন তিনি। আর কেউই লিকাইকে খুঁজে পাননি। তারপর থেকে লিকাইয়ের নাম অনুযায়ী ওই ঝরনার নাম হয়েছে নোহকালিকাই। স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, ঝরনার জলেই যেন অমরত্ব লাভ করেছেন লিকাই।

যেখানেই ঘুরতে যান না কেন, মনে রাখবেন, ঘুরতে গিয়ে আপনার দ্বারা যেন পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয়।

*মারুফ হোসেন, ব্যাংকার