হাম হাম–বাংলাদেশের দুর্গম জলপ্রপাতে আমরা

প্রায় ১৪০ ফুট উঁচু থেকে এ ঝরনার পানি পড়েছবি: লেখকের পাঠানো

২৫ জুলাই ২০২৫ শুক্রবার খুব ভোরে আমরা তিনজন বের হই হাম হাম জলপ্রপাতের উদ্দেশে। সিলেটের শ্রীমঙ্গল থেকে আমরা যাত্রা শুরু করি সকাল আটটার দিকে। সকালের নাশতা শেষ করে সমশেরনগর বাসস্ট্যান্ড থেকে যাওয়া ও আসাসহ ১ হাজার ৪০০ টাকায় একটি রিজার্ভ সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিই কমলগঞ্জ উপজেলার কলাবনপাড়া পর্যন্ত।

কিছুক্ষণ যেতেই শুরু হলো চা–বাগান। বর্ষা মৌসুম হওয়ায় চা–গাছগুলো সবুজ হয়ে আছে। রাস্তার দুই পাশে সবুজের সমারোহ। ছোট টিলাগুলো সবুজে মোড়ানো। চা–বাগান শেষ হতেই শুরু হলো লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। রাস্তার দুই পাশে ঘন বন আর উঁচু উঁচু বিশাল আকৃতির গাছ দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চলেছি। ঘণ্টা দুয়েক সিএনজিতে যাওয়ার পরে আমরা পৌঁছাই চম্পাপাড়া নামক স্হানে। এখানে নাম, ঠিকানা এন্ট্রি করতে হয় ও গাইড নিতে হয়। কয়েকজনের মধ্য আমরা রুবেল নামের একজনকে গাইড হিসেবে নিলাম ৩০০ টাকা ফি দিয়ে। মিনিট পাঁচেক সময়ের মধ্য এন্ট্রি শেষ করে আবার সিএনজি চলতে শুরু করল।

সাড় ১০টা নাগাদ আমরা পৌছে যাই হাম হাম নামক স্থানে। মূলত এখান থেকেই হাইকিং শুরু হবে। সিএনজি পার্ক করার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দৌড়ে এল। তাদের হাতে ছোট ছোট বাঁশ। ১০ টাকা করে আমরা তিনজন তিনটি বাঁশ নিয়ে নিলাম এবং গাইডকে একটি দিলাম। এখান থেকে পানি ও শুকনা খাবার নিয়ে নিলাম।

নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

শুরু হলো হাঁটা। গাইডের একহাতে বড় একটি দা অন্য হাতে বাঁশ নিয়ে সামনে আর আমরা পেছনে সারিবদ্ধভাবে যাচ্ছি। শুক্রবার হওয়ার কারণে বেশ পর্যটক আছেন। আমরা বনের মধ্য দিয়ে হাঁটছি। সবাই বেশ উৎফুল্ল। পথিমধ্য অন্যদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে। হাসি–ঠাট্টা আর আনন্দ নিয়েই এগোচ্ছি। চারপাশে ঘন বন, মাঝখানে হাঁটার সরু পথ। সামনে একটু উঁচু পাহাড় পার হতে হবে। ঘন জঙ্গলের কারণে বাতাস নেই বললেই চলে। প্রচণ্ড গরম ভেতরে। ছোট এই পাহাড় পার হতেই আমরা মোটামুটি ক্লান্ত। এবার হাঁটার গতি সবার কমে এসেছে। এ বনের মধ্যে একটি দোকান পেলাম। দোকানের বাঁশ দিয়ে বানানো বসার জায়গায় বসে পড়লাম।

লেবুর শরবত আর কলা খেয়ে আবার হাঁটা শুরু হলো গহিন জঙ্গলে। সামনে উঁচু–নিচু পথ, বাতাস নেই। আমরা ঘেমে ঘেমে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। সামনে আবার উঁচু পাহাড়। এক হাজার ফুট হবে। একদম খাড়া। এবড়োখেবড়ো পথ। এবার সবার মুখ মলিন হয়ে গেল। শুরু করলাম ওপরে ওঠা। দুই হাত আর দুই পা কাজে লাগিয়ে উঠলাম, ততক্ষণে শরীরের সব শক্তি শেষ। ওপরে উঠেই দেখি দোকান। দোকানের সামনের বাঁশের মাচায় শুয়ে পড়লাম। কারও মুখে কোনো কথা নেই। আমাদের মতো অনেক পর্যটকই শুয়ে আছেন। এখানে লেবুর ঠান্ডা শরবত পেলাম। এ সময় এটাকে অমৃত মনে হলো। গাইড বেশিক্ষণ থাকতে দিলেন না। সামনে আরও বহু পথ বাকি।

এমন পথ বেয়ে উঠতে ও নামতে হয় হাম হাম ঝরনা দেখতে গেলে
ছবি: লেখকের পাঠানো

আবার হাঁটা শুরু করলাম। পরনের টি–শার্ট খুলে হাঁটতে পারছি না। পথটা এতই সরু যে আশপাশের জঙ্গলের ডগাগুলো গায়ে লাগছে। অনেক বাঁশবাগান; আর বাঁশবাগানে অক্সিজেন কম থাকে। মাঝেমধে৵ বনের ফাঁকফোকর দিয়ে ভারতের সীমান্ত দেখা যাচ্ছিল। এরই মধ্যে শুরু হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বৃষ্টি পথটাকে আরও পিচ্ছিল করে তুলল। এই পিচ্ছিল পথে উঁচু–নিচু পথ পাড়ি দেওয়া খুবই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে এগোতে থাকলাম। এবার সামনে বড় একটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লাম। প্রায় ৫০০ ফুট নিচে নামতে হবে। একদম খাড়া, বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে। কিছুক্ষণ আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টিতে পথটা বেশ পিচ্ছিল হয়ে আছে। বাঁশ ধরে ধরে খুব সাবধানে একজন একজন করে নামলাম।

এবার শুরু হলো ঝিরিপথ। বড় বড় পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা পানিতে হাঁটছি। ভীষণ স্রোত। স্রোতের বিপরীতে হাঁটা খুবই কঠিন। পানির নিচে পাথর কী অবস্থায় আছে জানা নেই। খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। কখনো হাঁটুসমান পানি; আবার কখনো কোমর পর্যন্ত। পাথরগুলো খুবই পিচ্ছিল। খুব সাবধানে পা ফেলে এগোচ্ছি আমরা। হাতের বাঁশ দিয়ে আগে দেখে নিচ্ছি পানির গভীরতা। তারপর পা ফেলছি। আঁকাবাঁকা এই ঝিরিপথ বেশ রোমাঞ্চকর। কখনো অন্ধকার, আবার কখনো মৃদু আলোয় আমরা এগোচ্ছি। এবার ঝরনার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমরা কাছাকাছি চলে এসেছি। সামনের একটি বাঁক পেরোতেই চোখে পড়ল অনিন্দ্যসুন্দর হাম হাম জলপ্রপাত। কাছে গিয়ে সবাই বসে পড়লাম। ক্লান্ত শরীরে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। ক্যামেরা অন করে ছবি তোলারও শক্তি নেই। কিছুক্ষণ বসে থেকে শুকনা খাবার খেয়ে নেমে পড়লাম ঝরনায়। প্রায় ১৪০ ফুট উঁচু থেকে পানি পড়ছে। বর্ষার মৌসুম হওয়ায় পানিতে ভরপুর। দারুণ সুন্দর। ততক্ষণে ঝরনার পানির ভেসে আসা কণায় আমরা শীতল হয়ে গেছি। ভুলে গেছি সব কষ্ট। তাকিয়ে আছি অপলক। তিন ঘণ্টা হাঁটতে হয়েছে এখানে আসতে। কিছুক্ষণ ঝরনার জলে গা ভিজিয়ে ছবি তুলে এবার ফেরার পালা।

অনিন্দ্যসুন্দর হাম হাম জলপ্রপাত দেখতে পর্যটকের ভিড়
ছবি: লেখকের পাঠানো

ফেরার কথা মনে হতেই সবাই বিমর্ষ হয়ে গেল। আবার এ পথ পাড়ি দিতে হবে। গাইডের তাগাদায় ফেরা শুরু করলাম। সেই ঝিরিপথ, সেই পিচ্ছল পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটা। তবে এবার হাঁটছি স্রোতের অনুকূলে। পা ফেলতেই স্রোত টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ঝিরিপথ পেরিয়ে আবার সেই পাহাড়ি পথ। বৃষ্টি হয়ে পথটাকে এবার আরও জটিল মনে হলো। তাছাড়াও শরীরের শক্তি হওয়ায় ফেরার সময় বেশ বেগ পেতে হলো। পিচ্ছিল পাহাড়ে ওঠা যত কঠিন, নেমে আসা তার চেয়েও কঠিন। তার ওপর ৯০ ডিগ্রি খাড় পথ। আমার পা ফুলে ভীষন ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। এখানে বিপদে পড়লে উদ্ধারের কোনো ব্যবস্থা নেই। এটা একটি সমস্যা। আরও সমস্যা নেটওয়ার্কও নেই যে কাউকে বলবেন। যেখানে নিজেকে নিয়ে পার হওয়াই কঠিন, সেখানে অন্যকে নিয়ে যাওয়া দুরূহ ব্যাপার। এ নিয়ে সরকারের ওপরের মহলের কাজ করা উচিত। যথারীতি ধীরে ধীর সময় নিয়ে দোকনের মাচায় শুয়ে বিশ্রাম করে নেমে আসি। যেতে তিন ঘণ্টা লাগলেও আসার সময় চার ঘণ্টার ওপর সময় লেগেছে বিশ্রামের কারণে।

সন্ধ্যায় খুব ক্ষুধার্থ অবস্থায় যখন গাইডের বাড়িতে গরম ভাতের সঙ্গে মুরগির ঝাল মাংস ও চানাচুর দিয়ে চা–পাতা ভর্তা খেলাম, তখন মনে হলো পার্থিব জগতে ফিরে এলাম। খাওয়াদাওয়া শেষে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় শ্রীমঙ্গল চলে এলাম।