চীন দেশে বাউল বেশে: ইউ পর্ব
পেছনে পড়ে রইল সাংহাই। গত কয়েক দিন আমাদের সমস্ত অস্তিত্বের সঙ্গে সাংহাই মিশে গেছে। এখন নতুন পথ নতুন শহর ইউ–এর পথে আমরা। সাংহাই থেকে ইউ প্রায় ২৮৪ কিলোমিটার দূরত্বে। বিমান ও রেলযোগে যাওয়া যায়। রেলের মধ্যে আবার দুই ধরনের সার্ভিস-সাধারণ গতির ও দ্রুতগতির। আমরা সাধারণ গতির টিকিট অনলাইনে বুকিং করেছি, পৌঁছাতে সময় লাগবে দুই ঘণ্টা। দ্রুত গতির ট্রেনে এক ঘণ্টা। আমাদের অত তাড়া নেই। কিন্তু সমস্যা একটু আছে অন্য জায়গায়। রিপন ভাই টিকিট যখন বুকিং করছিল, তখন এক কাণ্ড ঘটে। বুকিং সাধারণত ট্রেনগুলো ছেড়ে যাওয়ার স্টেশন দেখাচ্ছে সাংহাই নান, যা পুরো ম্যাপজুড়ে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি, রিপন ভাই আর আমিন ভাই এক বিতিকিচ্ছি অবস্থায় পড়ে গেলাম। অনেক খুঁজে যখন উপায় পাচ্ছি না, তখন মাথায় এল সাংহাই নান অর্থ অনুসন্ধান করে দেখি, উত্তর অভাবনীয়। নান অর্থ দক্ষিণ। সাংহাই নান বলতে সাংহাই সাউথ রেলওয়ে স্টেশন, যেখান থেকে আমাদের ট্রেন ছেড়ে যাবে। ৯টায় রেলগাড়ী ছেড়ে যাবে, তিনি সবাইকে সাড়ে ছয়টায় রুম ছেড়ে বের হওয়ার জন্য বলে দিলেন। আমরা মেট্রোরেলে চড়ে স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। স্টেশনে বেশ তাড়াতাড়ি এসে গেছি, আটটায় হোটেল ছাড়লেও কোনো অসুবিধা হতো না। মেট্রোরেলে ২০ মিনিটের বেশি সময় লগে না সাংহাই সাউথ রেলওয়ে স্টেশন পৌঁছাতে। নাম নিয়ে সূক্ষ্ম জটিলতা আমরা গুরুত্বসহকারে নিয়েছি, যাতে কোনো বিড়ম্বনার শিকার হতে না হয়, এ জন্য এত আগে আসা।
স্টেশনের গায়ে পরিষ্কারভাবে লিখা আছে ‘সাংহাইনান রেলওয়ে স্টেশন’ অথচ মেট্রোরেল বা শহরের ম্যাপ সব জায়গায় উল্লেখ করা আছে সাংহাই সাউথ রেলওয়ে স্টেশন! অবস্থাটা এইবার বুঝুন। আমাদের ট্যুর লিডার রিপন ভাই মেধাবী আর পরিশ্রমী। উনি প্রতিটি বিষয় সতর্কতার সঙ্গে নজরদারি করেন। টিকিট কাটা, হোটেল বুকিং, ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা এমনকি খাবারদাবার সব বিষয়ে উনি উইচেট বা হোয়াটঅ্যাপ গ্রুপ খুলে সবার মতামত নিয়ে সুন্দর পরিকল্পনা করেন। এই সাতসকালে হোটেল ছেড়েছি কিন্তু চা–বিস্কিট আর ডিম সেদ্ধ সবার জন্য রেডি ছিল। ইংলিশ টি (চা) চীনে তেমন পাওয়া যায় না, চীনারা চায়নিজ টি আর কফি পছন্দ করে। তাই চায়না আসলে আমাদের চিরচেনা চায়ের জন্য মনটা নিসপিস করে। রিপন ভাইয়ের সঙ্গে জুয়েল ভাই থাকলে আমাদের ট্যুর পরিপূর্ণতা পায়। জুয়েল ভাই হলো আমাদের মূল সেফ আর ছোট ভাই জুবায়ের আমাদের রসনা পূজায় নতুন মাত্রা যোগ করছে।
রেলস্টেশনে সিকিউরিটি চেক বিমানবন্দরের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। লাগেজ স্ক্যানারে ঢুকিয়ে সবার লাগেজ চেক করছে। আমাদের দুটি লাগেজ খুলতে হলো, ভেতরে সবজি কাটার ছোট ছুরি আছে আরেকটিতে বডি স্প্রে! এগুলো নেওয়া যাবে না। জুয়েল ভাই বডি স্প্রে হাতে নিয়ে গায়ে লাগানো শুরু করলেন, মওকা দেখে আমরাও যত পারি স্প্রে করে নিলাম। এটি মোশাররফ ভাইয়ের বডি স্প্রে। ওদের যখন দিয়ে দিতে হবেই, তখন যত পার গায়ে মেখে নাও? ছুরিতো আর গায়ে মারা যাবে না! ওটাকে নিরাপদে দিয়ে দিলাম।
এত সুন্দর রেলস্টেশন, বিমানবন্দরও হার মানবে। প্রতি রেলের জন্য আলাদা আলাদা গেট ও ওয়েটিং এলাকা নির্ধারণ করা, সুন্দর পরিপাটি ওয়েটিং চেয়ার দেওয়া। ইন্টেরিয়রের সঙ্গে মিল রেখে লম্বা করে বেঞ্চ পাতা আছে সঙ্গে সুন্দর সবুজ বাগান। আমরা দখল করে শোয়া দিলাম, একটা ছোট ঘুম। ট্রেনের সময় এখনো দুই ঘণ্টা বাকি। প্রতিটি ওয়েটিং গেটের পাশেই ওয়াসরুম ও টয়লেট, সুন্দর পরিপাটি ও পরিষ্কার–পরিছন্ন। তবে একটা বড় সমস্যা এখানে আছে, শুধু এখানে না চায়নার সব টয়লেটে এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। চীনারা টয়লেটে পানি ব্যবহার করে না, শুধু টিস্যু দিয়ে কাজ শেষ করে ফ্লাস করে। সোজা কথায় টয়লেটে কোনো পানির কল বা স্প্রে বা বদনা থাকে না। সব পাবলিক টয়লেটের একই চিত্র। এর প্রতিকার হিসাবে আমরা একটি খালি বোতল ব্যাকপ্যাকে সব সময় রাখি, টয়লেট চাপলে ওয়াসরুমের বেসিন থেকে বোতলে পানি ভরে টয়লেটে যায়। তারপর টিস্যু আর পানি ব্যবহার করে পরিশুদ্ধ হই!
ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে একে একে খোসে পড়ছে তারিখগুলো। হোটেলে ফিরে এসে খাওয়াদাওয়া শেষে বাক্সপেটারা নিয়ে আমরা প্রস্তুত সেনজেন রওয়ানা হওয়ার জন্য। ইউ বিমানবন্দর থেকে রাত ১০টায় সেনজেন যাত্রা করবে বিমান, আমাদের ইউ ভ্রমণের গল্পও শেষ। সময়ের জন্য জমা রইল সেনজেন ভ্রমণের গল্পগুলো।
একদম সঠিক সময়ে রেলগাড়ি ছাড়ল, চায়নার ইলেকট্রিক রেলে বহুবার চড়েছি কিন্তু সাধারণ রেলগাড়িতে এই প্রথম। স্বাভাবিকভাবে আমাদের দেশের মতো রেলগাড়ির ঝাঁকুনি আশা করছিলাম। ঝাঁকুনি একেবারেই নেই! ১৮৪ কিলোমিটার দুই ঘণ্টায় পৌঁছাতে যথেষ্ট গতিরও দরকার হয়। কোনো ঝাঁকুনি আর আওয়াজ ছাড়াই এগিয়ে চলছে নির্দ্দিষ্ট গন্তব্যে। মাঝেমধ্যে কিছু স্টেশনে থামল, যাত্রী উঠানামা করল। সামনে খাবারের কেবিনও আছে, ইউনিফর্ম পরিহিতা এক নারী এটা–ওটা খাবারসামগ্রী নিয়ে আমাদের সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করছে। খাবার অর্ডার দিতে ইচ্ছা হলেও, ভাষাগত জটিলতায় নিবৃত থাকলাম। সবাই ঘুমের রাজ্যে ঝিমুনি দিচ্ছি, হঠাৎ আমিন হন্তদন্ত হয়ে উঠে খাবার কেবিনের দিকে হাঁটা ধরল, ফিরে এল এক তোড়া আঙ্গুর নিয়ে।
চলতি গাড়ি থেকে অন্যদিকের অন্য কোনো লাইন দেখতে বড় অদ্ভুত লাগে। মনে হয় ওই লাইন গেছে না জানি কোন রূপকথার শহরে, সুদূরের তৃষ্ণায় মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। মন খুঁজে রূপকথার দেশে যাওয়ার নির্ভুল রাস্তা। আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন ফিকে আলোয় ঢাকা। গাড়ি ছুটে চলেছে দুই ধারে ছড়ানো প্রান্তরের মধ্য দিয়ে, ছুটে চলেছে ছোট ছোট পাহাড় টিলার ভেদ করে। দূরে-চলে-যাওয়া সটান লম্বা পথের দুই পাশের গাছগুলোকে দেখায় যেন সাজানো তোরণ। দুই ধারে নিবিড় সবুজ গাছপালা, ছোটো ছোটো পাহাড়। একটু আগেই আমরা কথা বলছিলাম, এখন আমরা চুপ। আমরা অপেক্ষমাণ, এর পরেই ইউ।
স্টেশনে নেমে হোটেলে পৌঁছানোর রাস্তা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম সবাই। ইউতে মেট্রোরেল নেই, বাস বা ট্যাক্সিতে যেতে হবে। বাক্সপেটারার যে বহর চারটা ট্যাক্সির দরকার হবে, এর চেয়ে বড় সমস্যা হল ট্যাক্সিগুলো ঠিকমতো ঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারছে কি না? চায়না নতুনদের জন্য মোটেই সহজ জায়গা না, যোগাযোগ এখনো একটি বড় সমস্যা। বিমানবন্দরে বাসেই হোটেলের জায়গায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। স্টেশনের কয়েকজন যাত্রীকে চীন ভাষায় লিখা ঠিকানা দেখিয়ে বাস নম্বর জানার চেস্টা করা হলো। বিমানবন্দর থেকে প্রায় ২০টার মতো বাস বিভিন্ন রুটে ছেড়ে যাই। সঠিক বাস নির্ধারণ না করে বাসে চাপলে কপালে দুর্ভোগ অনিবার্য।
জুয়েল, রিপন আর মোশারফ ভাই কয়েক গেটে খোঁজখবর নিলেন। ৮০২ নম্বর বাসে চেপে বসলাম দুই টাকা দিয়ে। ইতিমধ্যে হোটেল ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ হলো, সে লাইভ লোকেশন উইচেটে পাঠিয়ে দিল। বাস এগিয়ে চলল সুন্দর মসৃণ রাস্তা ধরে। ম্যাপ দেখিয়ে চলেছে আমাদের পথের নিশানা। সময় লাগবে ৩৫ মিনিট। দিগন্তে ঘন কুয়াশার মধ্য দিয়ে ক্ষণিকের জন্যও উঁকি মারেনি সূর্য। ইউ পাহাড়ঘেরা সবুজ এক শহর, চারদিকে স্বপ্নময় মনোরম দৃশ্য। পরিকল্পিত বড় বড় দালান, প্রশস্ত রাস্তাঘাট, সাজানো ফুটপাথ বাগান দিয়ে ঘেরা। নিয়মের শৃঙ্খলায় গড়িয়ে চলছে ছোট বড় সব যানবাহন। দুই বাস স্টপেজের মাঝামাঝি জায়গায় আমাদের হোটেল, এই নিয়ে একটু দ্বিধা কাজ করল কোনটায় নামব? মঞ্জু ভাই বলল পরেরটাতে। মঞ্জু ভাই ঠিক, দু-টাকা খরচ করে একটু বেশি গাড়িতে চড়া গেল। টাকা খরচ করে কম পথ কেন চড়ব? একটু বেশি দেখা হলো, একটু বেশি ঘুরা হলো।
মোশারফ ভাই ম্যাপ ধরে এগিয়ে গেলেন, পেছন পেছন আমরা। ম্যাপের নির্দেশিত পথে বড় রাস্তা থেকে একটি ছোট রাস্তায় মোড় নিলাম। হোটেল খুঁজে পাওয়া গেল, লোকেশন ভালোই। হোটেল থেকে সামান্য এগিয়ে গিয়ে রাস্তা পার হলেই ফুতিয়েন মার্কেট। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হোলসেল মার্কেট। গোলমাল লাগল অন্য জায়গায়! হোটেল মালিক জানাল এই বিল্ডিংয়ে সবাইকে রুম দিতে পারবে না, পাশে তার আরেকটি হোটেল আছে ওইখানে অরেকটা রুম নিতে হবে, তাও আবার তিন ঘণ্টা সময় লাগবে! হোটেলমালিক আরেকটা কূটবুদ্ধি প্রয়োগ করল। সে বলল, তোমরা অনলাইন বুকিং ক্যানসেল করে দাও; কারণ, ওইভাবে আমি রুম দিতে পারছি না। বুকিং ক্যানসেল করলে হোটেলমালিক থেকে অনলাইন বুকি কোম্পানি কমিশন নেবে না, তার লাভ বেড়ে যাবে। বুকিং ক্যানসেলে আমরা রাজি হলাম না। তার প্রস্তাবমতো এখনে একটি রুম আর অন্য হোটেলটিতে আরেক রুমে থাকার জন্য আমরা রাজি হলাম। অনলাইনে বুকিং করলে রুমের সাইজ উল্লেখ করা থাকে, এখানে যে রুমটি সে আমাদের দিল, তা আকারে ছোট। অন্য হোটেলের রুম দেখে এসে জুয়েল ভাই জানালেন ওই রুমটি বেশ বড়, দুই রুমের অ্যাপার্টমেন্ট। কিন্তু পাঁচটায় রুম পাওয়া যাবে। মালপত্র রুমে রেখে সবাই ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেতে বের হলাম।
চলতি গাড়ি থেকে অন্যদিকের অন্য কোনো লাইন দেখতে বড় অদ্ভুত লাগে। মনে হয় ওই লাইন গেছে না জানি কোন রূপকথার শহরে, সুদূরের তৃষ্ণায় মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। মন খুঁজে রূপকথার দেশে যাওবার নির্ভুল রাস্তা। দুই ধারে নিবিড় সবুজ গাছপালা, ছোটো ছোটো পাহাড়। একটু আগেই আমরা কথা বলছিলাম, এখন আমরা চুপ। আমরা অপেক্ষমাণ, এর পরেই ইউ।
আশপাশে অনেক মুসলিম রেস্তোরাঁ দেখতে পেলাম। পছন্দসই একটিতে ঢুকে সাদা ভাত, ক্যাপসিকেম-চায়নিজ মাসরুম ও সবজি দিয়ে মুরগির মাংস হালকা ঝাল দিয়ে রান্না করা খাবার খেলার। বেশ সুস্বাদু। রিপন ভাই আমিন ভাইকে সঙ্গে করে কোথায় যেন গেলেন, আমাদের রুমে যেতে বললেন। সবাই বিশ্রাম করছি। কিছু সময় পর রিপন আর আমিন ভাই পেস্টি আর মিষ্টি নিয়ে হাজির। সবার জন্য সারপ্রাইজ। আজ মঞ্জু ভাইয়ের জন্মদিন উদ্যাপন করা হবে। সবাই হইহুল্লোড় করে কেক কাটলাম, মিষ্টি খেলাম। মঞ্জু ভাই ঘোষণা দিলেন রাতের ডিনার উনার পক্ষ থেকে। গত বছরও আমরা ফিলিপিনের ম্যানিলায় মঞ্জু ভাইয়ের জন্মদিন উদ্যাপন করছি।
অন্য হোটেলটি আমাদের পাশেই, রুম রেডি। জুয়েল, রিপন, জুবায়ের ও মোশারফ ভাই ওখানে গিয়ে রুম বুঝে নিলেন। ইউতে শীত সাংহাইয়ে চেয়ে বেশি। সন্ধ্যা হয়ে এল, আমরা সবাই আশপাশের জায়গাগুলো ঘুরেফিরে দেখছি। প্রচুর মুসলিম আছে এই এলাকায়। আফ্রিকার মানুষ বেশি, আরবেরও অনেক মানুষজন দেখা গেল। আশপাশে সব গয়নার দোকান, বেশির ভাগ মুক্তার আদলে পুঁথি দিয়ে গড়া। খদ্দেরও আছে দেখলাম। বস্তায় বস্তায় তসবিহ, মতির বিভিন্ন গয়নার মালামাল কার্টুনে ভরা হচ্ছে। বেশির ভাগ আফ্রিকা আার আরব দেশগুলোয় যাবে মনে হচ্ছে, পরে জানলাম কম বেশি পুরো পৃথিবীতে চালান হয় এইসব জিনিসপত্র।
কয়েকজন দোকানির সঙ্গে আলাপ হলো, প্রায় সবাই ইংরেজি বোঝে ও ভাঙা ভাঙা বলতে জানে! তবে কয়েকজন বেশ ভালোই বলতে পারে। সাংহাই, গুয়াংজুর মতো মেগা শহরেও এই অভিজ্ঞতা আমাদের হয়নি। ইংরেজিতে চীনাদের আগ্রহ বেশ কম দেখেছি, দু-একটা ইংরেজি কথা শুরু করলেই কিংবুদু বলে কেটে পড়ে। আগামীকাল আমাদের কর্মসূচি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার ইইউ ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সিটি বা ফুতিয়ান মার্কেট ঘুরে দেখা ও ব্যবসা বাণিজ্যের সম্ভাব্যতা যাচাই। তাই এই সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করলাম। এক ভদ্রলোক বেশ সুন্দরভাবেই ফুটিয়ান মার্কেট নিয়ে বোঝালেন। তার ভাষ্যমতে ফুটিয়ান মার্কেট ডিস্ট্রিক্ট ১, ডিস্ট্রিক্ট ২ এভাবে পাঁচটি ডিস্ট্রিক্ট এ বিভক্ত এবং প্রতিটি ডিস্ট্রিক্ট চতুর্থ তলা পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রতিটি ডিস্ট্রিক্টের প্রতি ফ্লোর ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের দোকান দিয়ে সাজানো আছে আর চতুর্থ তলাটি মূলত ইন্ডাস্ট্রিয়াল পণ্যের জন্য করা। আমরা যেখানে আছি ডিস্ট্রিক্ট ১, তার ঠিক উল্টো দিকে। পুরো ফুতিয়ান মার্কেট মূলত ড্রাগনের অবয়বে তৈরি আঁকাবাঁকা, আয়তনটাও বৃহৎ।
ফুতিয়ান মার্কেটে খেলনা, ইলেকট্রনিকস, গয়না, হার্ডওয়্যার, কাপড় থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সব ছোটখাটো জিনিস অত্যন্ত কম দামে পাওয়া যায়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকে ব্যবসায়ীরা এখান থেকে পণ্য আমদানি করেন। এই মার্কেটে মোট দোকানের সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। মার্কেটটি এতটাই বিশাল যে প্রতিটি দোকানে মাত্র ৩ মিনিট করেও যদি সময় ব্যয় করা হয় প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা করে সব দোকান দেখতে এক বছরের বেশি সময় লাগবে।
রাতে আমাদের জমজমাট ডিনার হল মঞ্জু ভাইয়ের সৌজন্যে। রাতে সঙ্গে শীত বাড়ছে, তাপমাত্রা প্রায় ১০ ডিগ্রি নেমে এল। আমরা আনেক রাত অবধি ঘুরে বেড়িয়ে রুমে ফিরে গেলাম। আগামীকাল সকাল ৯টায় ফুটিয়েন মার্কেট অভিযান। ৯টার আগে নাশতা শেষ করে আমরা মার্কেটের ডিস্ট্রিক্ট-১–এর নিচতলায় প্রবেশ করলাম, সব খেলনার দোকান। পুরোটা হেঁটে শেষ করা অসম্ভব আমরা এলেমেলোভাবে ঘুরে দেখা শুরু করলাম। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে প্রতিটি ডিস্ট্রিক্টে দোকানের সংখ্যা ও পণ্যের বিবরণ প্রকাশ করছি। ডিস্ট্রিক্ট ১: প্রায় ১০ হাজার ৫০০টি দোকান (খেলনা ও গয়না)।
ডিস্ট্রিক্ট ২: প্রায় ১০ হাজারটি দোকান (ব্যাগ, ইলেকট্রনিকস ও হার্ডওয়্যার)।
ডিস্ট্রিক্ট ৩: প্রায় ৭ হাজারটি দোকান (স্টেশনারি, কসমেটিকস ও চশমা)।
ডিস্ট্রিক্ট ৪: প্রায় ১৯ হাজারটি দোকান (কাপড়, মোজা ও জুতা)।
ডিস্ট্রিক্ট ৫: প্রায় ৭ হাজারটি দোকান (বেডিং, গাড়ির পার্টস ও ইমপোর্টেড পণ্য)।
নির্দিষ্ট কোনো পণ্যের খোঁজে সেই পণ্যের ডিস্ট্রিক্টে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই আমরা ব্যাগ, ইলেকট্রনিকস ও জুতার দোকানগুলো ঘুরে দেখছি। এর জন্য আমাদের মূলত ডিস্ট্রিক্ট-১ থেকে ডিস্ট্রিক্ট -৪ পর্যন্তই হাঁটতে হলো। মার্কেট বন্ধ হয় বিকেল পাঁচটায়। ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত টানা হেঁটে ঘুরে বেড়ানো মধ্যে শুধু আধঘণ্টার মধ্যাহ্নভোজের বিরতি। এর মধ্যে অবশ্য কেনাকাটা হয়েছে, বিক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক আলাপ হয়েছে। তবে কোনোটাই তেমন অর্থবোধক হয়ে উঠেনি, ভবিষ্যৎ ব্যবসার পরিকল্পনার অভিজ্ঞতা হয়ে কাজ করেছে। আমরা দোকানের সমুদ্রে ডুবেছিলাম সারাটা দিন, মার্কেট বন্ধ হওয়ার আগেই বের হয়ে এলাম।
আমরা বের হয়ে এলাম ডিস্ট্রিক্ট-৪ এর গেইট দিয়ে, হোটেলে ফিরতে হলে ডিস্ট্রিক্ট-১ এ ফিরতে হবে। অনুমানে ভর করে হাঁটা ধরলাম, কিছু সময় হাঁটার পর নিজেদের ডিস্ট্রিক্ট-৫–এর সামনে আবিষ্কার করলাম! এতক্ষণ আমরা উল্টোপথে চলেছি। খুব ক্লান্ত বোদ করছি সবাই। আবার দিক পরিবর্তন করে হাঁটতে থাকি কিছু দূর এগিয়ে খেই হারিয়ে ফেলি! মার্কেটটি আসলে ড্রাগনের মতোই এঁকেবেঁকে গেছে। ভেতরে হাঁটার সময় বোঝা যায়নি, এখন মূল রাস্তায় এসে বোঝা গেল ব্যাপারটা। আগত্য পথচারীদের সাহায্য নিতে হলো, তাতেও কম গোল বাঁধেনি। দুইবার পথ পরিবর্তন করতে হলো। এর মাঝে শুরু হলো বৃষ্টি! দূরত্ব যতটুকু ভেবেছিলাম তার চেয়ে ঢের বেশি। ডিস্ট্রিক্ট-১ থেকে ডিস্ট্রিক্ট -৪ পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিমি ফিরতি পথও তাই। বৃষ্টিতে ভিজে সবাই কাক ভেজা হয়ে হোটেলে ফিরলাম।
কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে জুয়েল ভাইদের রুমে একত্র হলাম। জমজমাট আড্ডা শুরু হলো। এই আড্ডা আর গল্পবাজির কোনো সীমারেখা নেই। কোনো বিষয়ভিত্তি নেই। রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে, বাইরে বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম। খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করে ঘুমাতে গেলাম।
পরদিন সকালে বৃষ্টি আর নেই, ঝকমক করছে আকাশ। নতুন মার্কেট ভ্রমণে বের হলাম ‘ইউ ডিজিটাল গ্লোবাল ট্রেড সেন্টার’। এটি ভবিষ্যতের ডিস্ট্রিক্ট -৬। এটি মূলত সনাতন পাইকারি বাজারের চেয়ে আধুনিক ডিজিটাল ট্রেড, লাইভ স্ট্রিমিং কমার্স, এবং এআই প্রযুক্তির সমন্বয়ে তৈরি হচ্ছে। রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহার করে লোকেশন ডিস্ট্রিক্ট-৫ শেয়ার করার সময় দেখলাম দুটি ডিস্ট্রিক্ট-৫ দেখাচ্ছে। দুটির ভাড়াও একই দেখাচ্ছে। আন্দাজে একটি সিলেক্ট করে কনফার্ম করলেন রিপন ভাই। একটু পরেই গাড়ি হাজির। রাস্তা গড়িয়ে যে জায়গায় এসে গাড়ি দাঁড়াল আমরা হকচকিয়ে গেলাম। রাইড শেয়ারিং অ্যাপের ম্যাপও সব ঠিক দেখাচ্ছে! অর্থাৎ অন্য ডিস্ট্রিক্ট-৫ লোকেশনটি সিলেক্ট করতে হবে। জুয়েলদের ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হলো, ওরা তখনো রওয়ানা হয়নি। এই শহরে ডিস্ট্রিক্ট শব্দটি বড় ভবন বা কমপ্লেক্সে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় মনে হলো!
প্রায় একসঙ্গে আমরা সবাই ডিস্ট্রিক্ট-৫ এ পৌঁছালাম, ওখান থেকে হেঁটে রাস্তা পার হয়ে ‘ইউ ডিজিটাল গ্লোবাল ট্রেড সেন্টার’ এ প্রবেশ করলাম। ভবনটি একেবারে নতুন, প্রতিটি সাজসজ্জা একেবারে নতুন ও আধুনিক। কসমেটিক পণ্য আর ডিজিটাল পণ্যের প্রচুর ডিসপ্লে সেন্টার ও বিক্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সাধারণ ড্রোন থেকে, অসংখ্য ড্রোনের সমন্বয়ে ডিসপ্লে ড্রোন, মেডিকেল টেকনোলজির ইকুইপমেন্ট ও বিভিন্ন আইটি পণ্যের প্রচুর শোরুম ভিজিট করলাম। মনে হচ্ছে ইউতে এসে আমরা দোকানপাটের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বিশালতার একটা সীমারেখা থাকে কিন্তু চীনাদের এই অদ্ভুত মার্কেট প্লেসের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন অতিমানবীয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড়–ছোট পণ্যদ্রব্যের পাইকারি বাজার ফুতিয়েন মার্কেট গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পেয়েছে। যদিও চীনারা এই ব্যপক মেগা মার্কেট বা ব্যবসায়িক হাব গড়ে তুলার পরিকল্পনা এক দিনে বাস্তবায়ন করেনি। ১৯৮০-এর দশকে ইইউ শহরের ছোট একটি স্থানীয় বাজার থেকে গড়ে তোলা ‘ইউ ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সিটি’ যা ফুতিয়েন মার্কেট নামে পরিচিত ২০০০ দশকের শুরু থেকে ধাপে ধাপে তৈরি করা হয়েছে।
ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে একে একে খোসে পড়ছে তারিখগুলো। হোটেলে ফিরে এসে খাওয়াদাওয়া শেষে বাক্স পেটারা নিয়ে আমরা প্রস্তুত সেনজেন রওয়ানা হওয়ার জন্য। ইউ বিমানবন্দর থেকে রাত ১০টায় সেনজেন যাত্রা করবে বিমান, আমাদের ইউ ভ্রমণের গল্পও শেষ এইখানেই। পরবর্তী সময়ের জন্য জমা রইল, চায়নাতে আমাদের প্রিয় আর অতি পরিচিত শহর সেনজেন ভ্রমণের-গল্পগুলো।
লেখক: মুহম্মদ কামরুল হাসান সিদ্দিকী, তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]