চীন দেশে বাউল বেশে: সাংহাই পর্ব

পিপল স্কয়ারে মঙ্গোলিয়ার কালচারাল অনুষ্ঠানের সামনে সবাই একসঙ্গেছবি: লেখকের পাঠানো

নদী দেখার জন্য বুঝি মানুষ এত দূর বেড়াতে আসে! তবে নদীটা যদি বয়ে যায় কোনো মহাশহরকে দুভাগ করে আর শহরটি যদি হয় ইতিহাস আর আধুনিকতার পৃষ্ঠপোষক, তবে এত দূর যাওয়া যায়! চীনের সাংহাই শহরে এবার আমরা হাজির। একেকটা নামের সঙ্গে কত কত অনুষঙ্গ জড়িয়ে থাকতে পারে, সাংহাই তেমন একটি নাম। একটি অতিমহানগরী, জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের বৃহত্তম নগরী, চীনের প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র, যার জিডিপি অনেক দেশের চেয়েও বৃহৎ। সাংহাই শব্দের অর্থ ‘সাগরের ওপরে’। পূর্ব চীনে অবস্থিত, এর পূর্বে রয়েছে পূর্ব চীন সাগর। হুয়াংপু নদী শহরটিকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত আধুনিক এলাকাটি হলো পুডং (Pudong) এবং পশ্চিম তীরকে বলা হয় পুশি (Puxi)।‎ ‎

আমরা আস্তানা গেড়েছি পশ্চিম তীর পুশি এলাকায় পিপল স্কয়ারে। পিপল স্কয়ারের যেখানে আমাদের হোটেল, তা শহরের একেবারে কেন্দ্র। পিপল স্কয়ার মেট্রোরেলের স্টেশন থেকে বের হয়ে এক শ মিটারের মধ্যে হোটেলের অবস্থান। অনলাইন বুকিং করে সস্তায় পাওয়া হোটেল। সেই হোটেল খুঁজে পেতে আমরা গলদঘর্ম। এক শ মিটারের জায়গায় তিন কিলোমিটার হাঁটিয়ে গুগল ম্যাপ আমাদের এক পাবলিক টয়লেটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল! গুগল চায়নাতে কাজ করে না। তবে ভিপিএন ব্যবহার করে কাজ করা যায়। আমরা সেইভাবেই কাজ এগোচ্ছিলাম। সেই সকাল ছয়টায় গুয়াংজু বাইয়ান বিমানবন্দরে এসে বিমান চেপে আড়াই ঘণ্টা উড়ে সাংহাই পৌঁছালাম। সাংহাই পুডং বিমানবন্দরে মেট্রোরেলে চড়ে ৫০ মিনিট পর পিপলস স্কয়ার স্টেশন। সেই কখন থেকে হাঁটছি আর হাঁটছি। আটজন ভিনদেশি মানুষ লাইন ধরে হেঁটে চলেছি সঙ্গে আটাশ সাইজের বিশাল লাগেজ। এই দেশের চোখ ছোট নাক বোঁচা মানুষগুলোর কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কদাচিৎ কেউ তাকালে আমরা সবাই তাকে ঘিরে বুকিং সাইটে ইংরেজি আর চায়নায় লেখা হোটেলের ঠিকানা দেখায়, তার চায়না ভাষা আর ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করি। ফলাফল শূন্য। শুধু এক রাস্তা থেকে বের হয়ে অন্য রাস্তা, শেষ পরিণতি এই পাবলিক টয়লেট। ক্লান্তিতে সবাই বিধ্বস্ত। সাংহাইয়ের ঠান্ডার মধ্যে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। আমাদের দেশের একেবারে মাঘ মাসের শীত। ভাগ্য এতটুকু সুপ্রসন্ন যে মেট্রোরেলের স্টেশন থেকে বের হয়ে কেএফসি পেয়েছিলাম, ওই চিকেন যতটুকু সম্ভব শক্তি জুগিয়ে চলেছে।

পশ্চিম তীরের (পুশি) বুন্দ থেকে পূর্ব তীরের (পুডং) লুজিয়াজুই স্কাইলাইনের রাতের আলোকোজ্জ্বল দৃশ্য
ছবি: লেখকের পাঠানো

জুয়েল ভাই কোনো সুযোগ হাতছাড়া করেন না, পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতে ঢুকে গেলেন, ওনার দেখায় অন্যরাও। নিরুপায় হয়ে সবাই দাঁড়িয়ে আছি, পাবলিক টয়লেটের পরিচারিকাও ঝাড়ু হাতে দাঁড়িয়ে। এমন সময় বিওয়াইডি গাড়ি চালিয়ে এক চীনা লোক এলেন টয়লেট ব্যবহার করার জন্য। পরিচারিকা তাঁকে কিছু বললেন, ভদ্রলোক নির্বিকার ভেতরে গিয়ে কাজ সেরে ফিরে এলেন। পরে অবশ্য আমাদের ঠিকানা দেখে দিক নির্দেশ করলেন। ভাঙা ইংরেজি আর ভাবভঙ্গিতে বুঝে নিয়ে আমরা আবার হাঁটা ধরলাম। হাজার বছর ধরে আমরা পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে...দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন! বনলতা সেন নয়, আমাদের আরোধ্য হোটেল। এখন অবশ্য হাঁটছি উল্টো পথে। যে পথটুকু আমরা বড় রাস্তা ধরে হেঁটে এসেছি, এখন গলির রাস্তা ধরে সেই পথে ফিরে যাচ্ছি। কেমন একটা গোলকধাঁধায় পড়ে গেলাম! আমাদের গুগল ম্যাপের কী যে হয়ে গেল!

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

‎ঐতিহ্যবাহী চীনা ধারণা ‘স্বর্গ গোলাকার, পৃথিবী বর্গাকার’। চীন আসলে আমারও মাঝেমধ্যে মনে হয় পৃথিবী বর্গাকার! গুগল ম্যাপও সাংহাই এসে গোলাকার পৃথিবীর ম্যাপ থেকে বর্গাকার পৃথিবীর ম্যাপ হয়ে গেল মনে হয়। এতে অবশ্য আমাদের তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই; হোটেল পাওয়া গেলেই হলো। আমাদের ট্যুর লিডার রিপন সাহেব এক্সট্রিমলি মিডল ক্লাস মাইন্ডসেটে ট্যুর অপারেট করেন। উনি যথেষ্ট উচ্চবিত্ত; কিন্তু ভ্রমণকালে বিশেষ কোড অনুসরণ করেন—‘সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি। দর্শনীয় যা আছে সব দেখে ফেলতে হবে। কোনো কিছু যেন বাদ না পড়ে। এত টাকাপয়সা খরচ করে এসে বিশ্রামে সময় নষ্ট করা যাবে না। আমরা এখানে ঘুমাতে আসি নাই!’

অবশেষে তাকে পাওয়া গেল, নির্দিষ্ট বিল্ডিংয়ের রিসেপশনে আমরা হাজির হয়ে অনলাইন বুকিং কপিটি দেখাতেই ওরা কাকে যেন ফোন করল, চীনা ভাষায় ‘নি হা, কিংবুদো, শী ষী’ কত কথা। পাঁচ মিনিট পরই চায়নার বনলতা সেন এসে হাজির, আমাদের নিয়ে গেল ৪০ তলা বিল্ডিংয়ের ষষ্ঠ তলায়। আসলে হোটেল না, এটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। রান্নার চুলা, ওভেন, ওয়াশিং মেশিন সবকিছু দেওয়া আছে। প্রায় তিন শ বর্গফুট শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রুমে দুটি ডাবল বেড-খাট পাতানো। আমি, সুফিয়ান, মঞ্জু আর আমিন—আমরা চারজন থাকব এই রুমে। অন্য চারজন জুয়েল, রিপন, মোশারফ আর জুবায়েরের জন্য আমাদের রুমের ঠিক ওপরে সপ্তম তলায় একই রকম আরেকটি রুম দেওয়া হলো। ভদ্রমহিলা দরজার ও ওয়াই–ফাইয়ের পাসওয়ার্ড দিয়ে তাঁর উইচ্যাটে (চায়নার যোগাযোগ অ্যাপ) আমাদের সুদর্শন সুফিয়ান ভাইকে যুক্ত করে বিদায় নিলেন, মঞ্জু ভাইও অবশ্য ভদ্রমহিলার উইচ্যাটে যুক্ত হওয়ার সুযোগ ছাড়লেন না।

জুয়েল, রিপন আর জুবায়ের রন্ধনশিল্পে বেশ দক্ষ হওয়ায় ওখানেই রান্নার আয়োজন হলো। খাওয়ার সময় একরুমে আটজন একত্র হলে একটু গাদাগাদি হয়ে যায়; কিন্তু তাতে কি? আমরা তো সবাই সুজন, তেঁতুলপাতায় নয়জনও হচ্ছে না। মাত্র আটজন। জুবায়ের বয়সে আমাদের সব থেকে ছোট, তার হোটেল ব্যবসা আছে। আমাদের রন্ধনপ্রক্রিয়ার মধ্যমণি হয়ে সে চমক দেখাতে লাগল। নেয়ে খেয়ে শান্ত হয়ে আমরা সবাই শক্তি সঞ্চয় করছি, ‘সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি। দর্শনীয় যা আছে সব দেখে ফেলতে হবে। কোনো কিছু যেন বাদ না পড়ে।’ সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। আমাদের মোসারফ ভাই যাকে সন্ধ্যার পর পাওয়া যায় না, যিনি কিনা আরব শেখদের মতো নির্ঝঞ্ঝাট আয়েসি জীবন পছন্দ করেন। উনিও লেগে গেলেন এই উক্তির সার্থকতা বাস্তবায়নে, আমি আর অন্যরাও তার ব্যতিক্রম করলাম না।

হুয়াংপু নদীর তীরে ওয়াক ওয়েতে তেজি ষাঁড়ের ভাস্কর্যের সামনে আমি, পেছনে কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা
ছবি: লেখকের পাঠানো

হোটেল থেকে নেমে দিলাম হাঁটা, গন্তব্য পিপল স্কয়ার। আমরা আছি সাংহাইয়ের হুয়াংপু জেলায় পিপল স্কয়ারের পাশেই। পিপল স্কয়ার সাংহাইয়ের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি বিশাল পাবলিক প্লেস এবং এই শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক। ১৯৪৯ সালের আগে, পিপল স্কয়ার এবং এর সংলগ্ন পিপলস পার্কের এলাকাটি ছিল একটি বিখ্যাত ঘোড়দৌড়ের মাঠ, ১৯৫১ সালে সাংহাই মিলিটারি কন্ট্রোল কমিশন এলাকাটি পুনরুদ্ধার করে। এটিকে পিপল স্কয়ার এবং পিপলস পার্কে রূপান্তরিত করে। এটি শহরের ঔপনিবেশিক অতীত থেকে আধুনিক মহানগরীতে উত্তরণের একটি প্রতীক। পিপল স্কয়ার স্থানীয় ও পর্যটক উভয়ের জন্যই একটি প্রাণবন্ত স্থান, যেখানে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবেরা একত্র হন এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কার্যকলাপ উপভোগ করেন। স্কয়ারের কেন্দ্রে আছে একটি বড় গোলাকার মিউজিক্যাল ফোয়ারা। সাংহাইয়ের অন্যতম প্রধান কেনাকাটার রাস্তা নানজিং রোড স্কয়ারের উত্তর দিকে অবস্থিত। এখানে সাংহাই গ্র্যান্ড থিয়েটারে নান্দনিক শিল্পের প্রদর্শনী হয়। ‎স্কয়ার এবং এর আশপাশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে সাংহাই মিউজিয়াম। জাদুঘরটিতে প্রাচীন চীনা শিল্পকলার বিস্তৃত সংগ্রহ রয়েছে। ‎পিপল স্কয়ারের মোট আয়তন প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার বর্গমিটার।

পিপল স্কয়ারের ঠিক পাশে শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি সবুজ এবং শান্ত পরিবেশের জনপ্রিয় স্থান পিপলস পার্ক। পার্কটি ‘ম্যারেজ মার্কেট’–এর জন্য খুবই বিখ্যাত। প্রতি শনি ও রোববার, সন্তানেরা নিজেদের সঙ্গী খুঁজে নিতে ব্যর্থ হলে তাদের মা–বাবা বা দাদা-দিদিরা এখানে এসে তাঁদের সন্তানের জীবনবৃত্তান্ত (CV) ছোট পোস্টারে লিখে ঝোলান এবং অন্য অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেন, যেন তাঁরা তাঁদের সন্তানদের জন্য উপযুক্ত পাত্র–পাত্রী খুঁজে বের করতে পারেন। এটি সাংহাইয়ের একটি অনন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা। আমাদের মধ্যে জোবায়ের একমাত্র অবিবাহিত। তার বিষয়ে করণীয় কী আছে, আমরা একটু ভেবে দেখলাম। কিন্তু সে তাতে রাজি না। দেশের ছেলে দেশেই ঠকবে।

আমরা হেঁটে চলেছি নানজিং ইস্ট রোড ধরে। বিশ্বের দীর্ঘতম এবং ব্যস্ততম কেনাকাটার রাস্তাগুলোর মধ্যে এটি একটি। এই অংশটি পায়ে হাঁটার রাস্তা, যা পিপল স্কয়ার থেকে শুরু হয়ে বুন্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। বুন্দ হুয়াংপু নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ওয়াটারফ্রন্ট এলাকা। এটি বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত আর্কিটেকচারাল ডিসপ্লে। বুন্দ পর্যন্ত হাঁটাপথে এখানে বিশ্বের বহু পুরোনো ঐতিহ্যবাহী এবং আধুনিক ব্র্যান্ডের শোরুম রয়েছে। চীনের সবচেয়ে বড় অ্যাপেল স্টোর এখানে আছে। নানজিং ওয়েস্ট রোড  পিপল স্কয়ারের পশ্চিম দিকে অবস্থিত এবং এখানে মূলত আন্তর্জাতিক বিলাসবহুল ব্র্যান্ড, হাই-এন্ড মল এবং বড় করপোরেট ভবন রয়েছে। পুঁজিবাদী সমরাজ্যের ব্র্যান্ডগুলো নিয়ে সমাজতান্ত্রিক চীনাদের আগ্রহ বেশ প্রবল, তা প্রতিটা ব্র্যান্ড স্টোরের উপচে পড়া ভিড়ের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। অ্যাপল স্টোরে মানুষের উপচে পড়া ভিড়, ফিলা, নাইকি বা অ্যাডিডাসের মতো শোরুমগুলোর বেচাকেনার বাহার দেখলে সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

তবে আমার কাছে চীনা সরকারের উদার নীতিটা ভালো লেগেছে, কোনো ব্র্যান্ডকে নিষিদ্ধ করে জনগণের মনে কষ্ট দেয়নি। জনগণের যাদের ক্রয়ক্ষমতা আছে, তাদের স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে পছন্দের জীবনযাপনে। চীনাদের আধুনিক জীবনযাত্রায় আমি মুগ্ধ।
‎নানজিং রোডের হাসিখুশি মানুষের ভিড় আর আলো ঝলমল পরিবেশ আমাদের পর্যটক মনকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। হাঁটার সঙ্গে আমাদের ক্যামরাও ছবি বন্দী করছে প্রাণবন্ত এই পরিবেশকে। ছোটখাটো শপিং চলছে, চলছে মানসিক বিনোদন। অন্তহীন আলোকিত তোরণের মধ্য দিয়ে চলেছি আমরা। পথের দুই ধারে রকমারি পণ্যের দোকান থেকে ছুটে আসা উষ্ণ আলো, যেন কোনো বড় একটা অভ্যর্থনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। যাত্রাপথের শেষ দিকে একটু ঝিম ধরে যায়৷ আমিন বলে: কিরে ভাই, পথের যে আর শেষই হয় না। আমাদের মধ্যে কেউ আবার কোন শোরুমে হারিয়ে যায়, বাকিরা একে অন্যকে খুঁজে নিই। চারদিকে যেমন একটা মেলা মেলা ভিড়, হারিয়ে গেলে দোষ দেওয়া যায় না। তবে পথের শেষে আমরা একসঙ্গেই নদীর কাছে গেলাম।

সাংহাই স্টেডিয়ামের সামনে আমরা সবাই
ছবি: লেখকের পাঠানো

নদীটা বেশ বাড়বাড়ন্ত, স্রোতে তেজ আছে বোঝা যায়। নদীর ওপর পর্যটক নিয়ে ভেসে চলেছে ছোট ছোট জাহাজ। নদীর এই পাড়ে বিশাল শানবাঁধানো রাস্তা। অসংখ্য মানুষ ছবি তুলছে, ভিডিও করছে, টিকটক রিল বানাচ্ছে। সেই এক মহা উৎসব,  আনন্দের জোয়ার বয়ে চলছে। আমরাও সেই জোয়ারে গা ভাসালাম। নদীর অন্য পাড়ে পুডং এলাকায় গড়ে তোলা বিশাল ভবনগুলোর আলোকসজ্জায় নদীর রূপটায় যেন ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। মানুষের গড়া কৃত্রিম সৌন্দর্যের আলোয় ডুবে আমরা আস্ত নদীটাকেই হারিয়ে ফেললাম। নদীর পাড়ে শান বাঁধানো রাস্তাটা প্রায় দেড় কিলোমিটারের, কোনো কিছুই বাদ দেওয়া যাবে না, পয়সা খরচ করে আমরা দেখতে এসেছি—মনে করিয়ে দিলেন রিপন ভাই। আমরা পুরো পথটুকু হাঁটলাম, ক্লান্ত হলে বিশ্রাম নিলাম। বিশাল এই রাস্তা শুধু পর্যটকদের জন্য। মাঝে বসে জিরানোর জন্য পাথরের বেদি তৈরি করা আছে। চারপাশে বাগান করা আছে। আমরা বেশ আনন্দে সময় পার করছি, ক্লান্তি আমাদেরকে থামাতে পারেনি। কোনো হকার আমাদের বিরক্ত করেনি। আমাদের চারপাশে সাংহাই মহাশহরের আলোঝলমলে রাত, মাথার ওপর অগ্রহায়ণের আকাশ আর শরীরজুড়ে মাঘ মাসের শীত।

পরদিন সকালে আমরা শহর ঘুরতে বের হলাম। সুফিয়ান ভাই বললেন, রাস্তাঘাটে মানুষজন এত কম কেন? জুয়েল ভাই উত্তর দিলেন—মানুষজন বেশির ভাগই মাটির নিচ দিয়ে চলাচল করে (মেট্রোরেলে)। এখন বাজে ১১টা সবাই অফিস, ফ্যাক্টরি আর স্কুল–কলেজে ব্যস্ত। আশপাশে লক্ষ করেন বেশির ভাগ মানুষ বয়স্ক। আসলেই অনেকটা তাই। আমরা মাটির ওপর ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করলাম। এখানকার বাসগুলো দুই টাকাতেই সব স্টেশন ঘুরিয়ে আনে, যদিও বাসের নম্বর অনুযায়ী শহরের চৌহদ্দি ভাগ করা। কোন বাস কোথায় যায়, তা চীনা ভাষা থেকে খুঁজে নেওয়া অসম্ভব আর ইংরেজি জানা কোনো চীনা পাওয়াও দুষ্কর, আমরা পরিকল্পনা করলাম কোনো একটি বাসে উঠে পড়ার। ভাষাগত যোগাযোগ এক বিশাল সমস্যা চীনজুড়ে।

বাসস্টপেজে দাঁড়ানো সামনের বাসে চেপে বসলাম সবাই। বাসজুড়ে নেই কোনো ভিড়, ঠেলাঠেলি, শীতাতপযন্ত্র নিরবচ্ছিন্ন কাজ করছে। বাইরের রাস্তাগুলোও বেশ সুন্দর, প্রশস্ত, পরিচ্ছন্ন বাগান আর গাছপালায় সুসজ্জিত করে রাখা। জ্যাম নেই, হর্ন নেই, নেই কোনো জীর্ণ ভাঙা গাড়ি পুরো রাস্তাজুড়ে। বেশির ভাগ গাড়ি চায়নার তৈরি ইলেকট্রিক ভেহিকেল; এমনকি আমাদের এই বাসটাও। তবে নামীদামি ব্র্যান্ডের অভাব নেই রাস্তায়। টেসলা, পরশে, বিএমডব্লিউ, রোলস রয়েস—সবই আছে চীনাদের। রাস্তার পাশে প্রশস্ত ফুটপাত। মোশাররফ ভাই বলেন চায়নার আকাশটাও অন্য রকম, আসলেই চীনের সবকিছুই অন্য রকম—ওদের গোলাকার স্বর্গ আর চতুর্ভুজ পৃথিবীর মতো। ওদের চতুর্ভুজ পৃথিবীজুড়ে যা খুশি তাই করে চলেছে—সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। পৃথিবীর বড় বড় স্থাপনা, অট্টালিকা, ব্রিজ ও রাস্তা তৈরির রেকর্ড চীনাদের খাতায়। ইলেকট্রনিকস, কম্পিউটার আর এআই নিয়ে তাদের সফলতা প্রতি পদে আমরা অনুভব করছি।

২০–২৫ মিনিট ঘুরে বাসটি টার্মিনালে এসে থেমে গেল, আমরা যে বাসে উঠি, সেটি তার গন্তব্যের শেষ প্রান্তে ছিল। বাস ডিপোটিতে সারি দিয়ে অনেক বাস দাঁড়িয়ে। একেক বাসের একেক নম্বর। পাশের বোর্ডে যাত্রাপথ উল্লেখ করা আছে, যদিও তা চীনা ভাষায়। আমরা দুই টাকা দিয়ে আরেক বাসে চাপলাম। আমাদের নিয়ে ছুটে চলল বাস, গন্তব্য অজানা। আমরা বাউল হয়ে ঘুরব সাংহাইয়ের পথে পথে। মঞ্জু ভাইয়ের নতুন রোগ চেপেছে গানের, সারা দিন সারা পথ অনলাইন আর অফলাইনে গুনগুন করছেন। কখনো বাংলা, কখনো হিন্দি, কখনো সুরে, কখনো বেসুরে। আমরাও বেশ ইনজয় করছি এই বয়সে তার গান নিয়ে চর্চা, জুয়েল আছে উসকে দেওয়ার জন্য; আমরাও কম কিসের। সময় আর আমাদের নিয়ে বাসটিও পাড়ি দিয়ে চলছে মাঠ, ঘাট, দালান, প্রান্তর। দালানগুলো ছোট হয়ে এলে আমাদের মন হলো আমরা শহরের বাইরে এসে গেছি। সামনেই চোখে পড়ল সাংহাই স্টেডিয়াম। সবাই নেমে পড়লাম, কিছু সময় হাঁটাহাঁটি আর খুনসুটি, ছবি তোলা গল্প বলা। কথা বলতে থাকি নানা প্রসঙ্গ নিয়ে, যেন আমাদের কোথাও যাওয়ার কথা ছিলই না কখনো। যেন এইভাবেই একটা আড্ডার জন্যই এসেছি আমরা।

এবার ঠিক হলো মাটির নিচ দিয়ে ঘুরে বেড়াব। কাছেই মেট্রোরেলের স্টেশনে ঢুকে পড়লাম। সেভেন ইলেভেন থেকে হালকা নাশতা করতে করতে সবাই স্থির করার চেষ্টা করছি কোথায় যাওয়া উচিত। আমাদের গন্তব্য হওয়া উচিত নদীর পূর্ব তীর পুডং। যেখানে চীনারা বিশাল বিশাল ভবন গড়ে তুলেছে, গত রাতে যাদের আলোঝলমলে সৌন্দর্য নদীকে তুচ্ছ করে দিয়েছিল। সবাই একমত ওই ভবনগুলো কাছে গিয়ে দেখব। মেট্রোর যে লাইনটিতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তার ম্যাপ খুলে দেখছি পুডং যেতে হলে কোন লাইনে ট্রান্সফার হতে হবে? ম্যাপ দেখে আবিষ্কার হলো এই লাইনটি এয়ারপোর্টে গিয়ে শেষ হয়েছে এবং যে স্টেশনে আমরা দাঁড়িয়ে তার থেকে মাত্র দুই ষ্টেশন পরেই আছে ডিজনিল্যান্ড!  তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত হলো আমরা ডিজনিল্যান্ড যাচ্ছি। এখন বাজে দুপুর ১২টা। মধ্যবিত্তের চড়কিবাজি বিদেশ ভ্রমণ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি। দর্শনীয় যা আছে সব দেখে ফেলতে হবে। কোনো কিছু যেন বাদ না পড়ে। এই সূত্রের সঠিক প্রয়োগের তবে কী হবে? রিপন ভাই ভেটো দিলেন। কিন্তু কাজ হলো না। আমাদের শিশুমন চাইছে ডিজনিল্যান্ড যেতে।

বিশাল লেকের কোল ঘেঁষে দক্ষিণ মুখে চলেছি। আমাদের বাঁয়ে লেকের স্বচ্ছ জল ধূ-ধূ করছে, তার শেষ সীমায় শিরশির করে কাঁপছে দিগন্তরেখা। লেকের এই পাড় থেকে বোটে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্য পাড়ে। সেই পাড়ে ডিজনি ক্যাসল স্টাইলের দালান দেখা যাচ্ছে, থাকার রিসোর্ট সম্ভবত। আমাদের বাঁ পাশ দিয়ে কৃত্রিম অরণ্য, মাঝেমধ্যে বসার জায়গা। অগ্রহায়ণের পরিষ্কার নীল আকাশ, তার গাজুড়ে কুঞ্জ কুঞ্জ সাদা মেঘ। আমাদের শরীরে মাঘ মাসের শীত। বিশাল বিস্তীর্ণ আর পরিপাটি করে সাজানো–গোছানো জায়গাটা। মানুষজন অনেক কিন্তু ভিড়ভাট্টার চিহ্ন নেই। প্রশান্তির আদর বুলানো, আনন্দের ছোঁয়ায় গড়ে উঠেছে শিশু স্বর্গ যার পুরোপুরি ভাগ পেতে হলে টাকা খরচ করতে হবে। নিঝুম বিশাল কার্টুন অরণ্যের পেটের ভেতরে ঢুকে এসেছি আমরা—যে অরণ্য শিশুকালে যেমন ছিল, এখনো তাই আছে। মানুষের মন বুঝি বুড়ো হতে চায় না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল ডিজনিল্যান্ড বন্ধ হওয়ার সময় এসেছে, সবার খিদে পেয়েছে। বের হয়ে মেট্রোরেল স্টেশনের মুখে সেভেন ইলেভেনের খাবার আর কফি কিনলাম। গল্পে আড্ডায় সময় কীভাবে চলে যাচ্ছে! আমরা পুডং যাওয়ার জন্য মেট্রোরেলে চড়ে বসি। এক স্টেশনে ট্রান্সফার হয়ে অন্য লাইনে উঠি, এই মেট্রো নদীর তল দিয়ে পার করে আমাদের নিয়ে এল পুডং। রাত নেমে এসেছে অন্ধকার নিয়ে। আমরা যেখানে আছি, এলাকাটা আলোঝলমলে। আলোর সঙ্গে মানুষগুলো ঝলমল করছে। সবার চোখেমুখে আনন্দের হাসি, আমরাও ব্যতিক্রম না। বিশাল আলোঝলমলে দালানগুলো সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের সৃষ্ট। আমরা সবাই এই কৃতিত্বের ভাগীদার। তাই আমরা উদ্‌যাপনে মেতেছি, আনন্দ উৎসবে ডুবে গেছি।

লেখক ও পেছনে সাংহাই ওয়ার্ল্ড ফাইন্যান্সিয়াল সেন্টার ও জিন মাও টাওয়ার
ছবি: লেখকের পাঠানো

পুডংয়ের স্কাইলাইনের আইকনিক স্থাপনা পার্ল টাওয়ারের সামনে ভিড় জমালাম। চীনা লোককথার ‘মুক্তো’ দ্বারা অনুপ্রাণিত নকশায় নির্মিত ওরিয়েন্টাল পার্ল টাওয়ার মুক্তা হয়ে ফুটে আছে। টাওয়ারের প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকেই আমার একটু আশ্চর্য হয়ে গেলাম, সৌদি আরবের একটি প্রদর্শনী চলছে এখানে। ভেতরে ঢুকতেই সৌদির ঐতিহ্যবাহী গাওয়া পান করিয়ে আমাদের অভিবাদন জানাল। যেহেতু আমরা সবাই মুসলিম, তাদের সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় হলো। কথাবার্তা ইংরেজিতে চলছিল। সৌদি ছেলেমেয়ে একসঙ্গে প্রদর্শনীতে কাজ করছে। তাদের কথাবার্তা ও কার্যকলাপ আমাদের যেন একটা মেসেজ দিল, সৌদি আরব হতে যাচ্ছে পৃথিবীর একটি জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন। তাদের এই আয়োজন মূলত আসন্ন বিশ্বকাপ ফুটবল ঘিরে। তাদের প্রদর্শনীর সার্বিক দিক চমৎকার মনে হয়েছে, প্রদর্শনীর শেষ প্রান্তে একটি ডায়েরি আর ব্যাগ দিয়ে আমাদের সৌদি আরব জেদ্দা বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলো।

এরপর আমরা চলে এলাম সাংহাই টাওয়ারের পাদদেশে। এটি বর্তমানে চীনের সবচেয়ে উঁচু ভবন এবং বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভবন। একে একে সাংহাই ওয়ার্ল্ড ফাইন্যান্সিয়াল সেন্টার, জিন মাও টাওয়ার কাছে থেকে যতটুকু দেখা যায় দেখে নিয়ে লুজিয়াজুই স্কাইলাইন ভ্রমণ শেষ করলাম। লুজিয়াজুই স্কাইলাইন বলতে হুয়াংপু নদীর পূর্ব তীরে আকাশচুম্বী অট্টালিকা এবং অন্য সুউচ্চ স্থাপনাগুলোর সমষ্টিগত দৃশ্যকে বোঝায়। রাত বাড়ছে ফিরতে হবে এবার, মেট্রোরেলে ফিরে এলাম পিপল স্কয়ার স্টেশনে। এবার মেট্রোরেল স্টেশন থেকে হোটেলের দূরত্ব যে এক শ মিটারের কম আর কোনো সন্দেহ রইল না। মোশাররফ ভাই ভিপিএন দিয়ে গুগল ম্যাপ চালু করে প্রমাণ করলেন চীনের পৃথিবীটাও গোল, চতুর্ভুজ নয়। প্রথম দিন মেট্রোরেল স্টেশন থেকে বের হয়ে বড় রাস্তা ধরে সোজা হাঁটা দেওয়ায় গুগল ম্যাপ দীর্ঘ পথ ঘুরিয়ে বেদিশায় ফেলে দেয়। মেট্রোরেল স্টেশন থেকে বের হয়ে ডানের রাস্তা ধরে এগোলেই আমাদের হোটেল এক শ মিটারের মধ্যেই! বড় বড় শহরে এমন ছোট ছোট ভুল হতেই পারে। আগামীকাল ভোরে আমরা রওনা হব ইউ শহরে, নতুন শহর ও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হোলসেল মার্কেট ঘুরব। সেই গল্প জমা থাকল অন্য সময় বলার জন্য।

  • লেখক: মুহম্মদ কামরুল হাসান সিদ্দিকী, তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা