বিশ্ব যুব উৎসবে রাশিয়া ভ্রমণ অভিজ্ঞতা-২
পরদিন ৩ মার্চ সকালে ভেন্যুতে গিয়ে প্রথমেই পৌঁছালাম ডব্লিউওয়াইএফ বিমানবন্দর, যা মূলত সিরিয়াস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এবং ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে এটাকে একটি বিমানবন্দরের আদলে সাজানো হয়েছে। এর ভেতরে ঢুকে তো চক্ষু চড়কগাছ! কী নেই এখানে। রোসাটম থেকে গ্যাজপ্রম, রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বেসরকারি কোম্পানি, এনজিও ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবারই আছে কোনো না কোনো আয়োজন। ছিল বিভিন্ন গেম আর পুরস্কার জেতার সুযোগ। একই সঙ্গে চলছিল বিজ্ঞান, কলা, প্রযুক্তি, অর্থনীতি আর ভূরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নানা বিষয়ে প্যারালাল সেশন। আমাকে আকৃষ্ট করল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-বিষয়ক আয়োজনগুলো। আমি রাশিয়ান জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি আয়োজিত একটি জিওগ্রাফিক্যাল ডিকটেশন কুইজ প্রতিযোগিতায় জিতেছি। এ ছাড়া মস্কো স্টেট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস (এমগিমো বিশ্ববিদ্যালয়) কর্তৃক আয়োজিত কূটনীতির ওপর আরেকটি কুইজে অংশগ্রহণ করেছিলাম এবং পুরস্কার হিসেবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি-সম্পর্কিত একঝাঁক অমূল্য বই, ব্যাজ ও নোটবুক পেয়েছি।
এদিন বিকেলে একাই ঘুরতে বের হলাম কৃষ্ণসাগরের তীরে। দেশের কাউকে ওই মুহূর্তে না পাওয়ায় একজন স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে বলতেই ঘুরে দেখাতে রাজি হলো। ওর নাম ম্যাক্সিম। আমার সমবয়সী। আর দশজন জেন-জি রাশিয়ানের মতো ও ভালো ইংরেজি জানে। তাই নানা বিষয়ে আলাপ চালাতে অসুবিধা হলো না।
পরদিন ৪ মার্চ আর্ট মলোডস্ট এক্সিবিশন সেন্টারে গিয়ে দেশের স্টলসহ নানা দেশের স্টল ঘুরে ঘুরে তাদের আর্ট, কুটিরশিল্পসহ বিভিন্ন পণ্যের দেখা মিলল। পাশেই চলছে বিভিন্ন দেশের কালচারাল পারফরম্যান্স, যার মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর নৃত্য দেখেছি মেক্সিকান ও সিরিয়ান দলের। হাঁটতে হাঁটতে দেখি, এক চোখজুড়ানো দৃশ্য যেখানে ভারত এবং পাকিস্তানের তরুণেরা একসঙ্গে গাইছে-নাচছে অথচ নোংরা রাজনীতি পাশাপাশি এই দুই দেশকে কী অচ্ছুৎই না করে রেখেছে! এদিন বিকেলের আকর্ষণ ‘ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ প্যারেড’ যেখানে বিভিন্ন দেশ তাদের সংস্কৃতি উপস্থাপন করে প্যারেড করে যাচ্ছে। সগৌরবে বাংলাদেশের পতাকা উঁচিয়ে সঙ্গে বিভিন্ন দেশপ্রেমমূলক সংগীত গাইতে গাইতে আমরাও প্যারেড করেছিলাম আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নানা দেশের মানুষের হাততালি আর উৎসুক মুখ দেখে কার না ভালো লাগে! সন্ধ্যা থেকে ইনডোর-আউটডোর কনসার্ট উপভোগ করে রাত ১২টার পর হোটেলে ফেরা হলো সেদিন।
৫ মার্চ ছিল টিম বাংলাদেশের জন্য বিশেষ একটি দিন। আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এদিন আমরা আমাদের কালচারাল পোশাক পরব। তো সকাল সকাল পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে পড়লাম। ভেন্যুতে গিয়ে ছেলেদের পাঞ্জাবি আর মেয়েদের শাড়িতে দেখতে অসাধারণ লাগছিল। তোলা হলো একগাদা গ্রুপ ফটো। একজন হাসিখুশি (বয়স ষাটোর্ধ্ব) রাশিয়ান ভলান্টিয়ার আমাদের দিকে এগিয়ে এল ফেস্টিভ্যালের অফিশিয়াল মাস্কট ‘চেবুরাস্কা’ নিয়ে ছবি তুলতে। রুশদের প্রাণশক্তি দেখেই অবাক হই!
৬ তারিখে পরিকল্পনা মোতাবেক টিমের ছোট ভাই শাহরিয়া ও জুবায়ের, বড় ভাই আমান মিলে দেখা হলো ডব্লিউওয়াইএফ এয়ারপোর্টের প্রতিটা কোনাকানা। অভিজ্ঞতা হলো ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটিতে আর্কটিক ভ্রমণের ও ট্রেন চালানোর এবং কার রেসিং গেমের রোমান্সের। এক্সট্রিম পার্ক এরিয়ায় পেশাদার কোচের তত্ত্বাবধানে শেখা হলো স্কেটিংয়ের হাতেখড়ি। এমগিমো ইউনিভার্সিটির আরেকটি সেশনে দেখা হলো এবং কথা হলো রুশ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতাবিষয়ক এজেন্সি ‘রসোট্রাডনিসেস্টভো’-এর উপপ্রধান পাভেল সেভটসভের সঙ্গে। সন্ধ্যায় ঘুরলাম চেচনিয়া, তাতারস্তানসহ কয়েকটি প্রজাতন্ত্রের প্যাভিলিয়ন। এ ফাঁকে বাইরে রাখা ২০১৮ রাশিয়া ফিফা বিশ্বকাপের মাস্কটের সঙ্গেও নিয়ে নিলাম একটি ছবি। এদিনই যেহেতু ছিল মেইন প্রোগ্রামের শেষ দিন, তাই অনেক রাত পর্যন্ত ইনডোর-আউটডোর নানা কালচারাল উপস্থাপনা উপভোগ করতে লাগলাম। যার মধ্যে একটি আমার কাছে সবচেয়ে স্মরণীয়, যেখানে সিআইএসভুক্ত দেশগুলোর শিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনা চলছিল। কাজাখ নৃত্য আমার কাছে ছিল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এর মধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মেইন ফেস্টিভ্যাল ভেন্যু থেকে শেষবারের মতো হোটেলে ফিরলাম।
রিজিওনাল প্রোগ্রামে মস্কোর উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে ৭ তারিখ ছিল বিশ্রামের দিন। গত রাতে দেরিতে ঘুমানোয় এদিন দেরিতে উঠে দুপুরের দিকে একাই ঘুরে এলাম কাছের সোচি পার্ক। সেখানে গিয়ে ভয়ানক কিছু রাইডে চড়ার পর আমার অবস্থা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’!
৮ তারিখ সকালে সোচির অ্যাডলার স্টেশন থেকে শুরু হলো আমার রিজিওনাল প্রোগ্রাম মস্কো ও মস্কো ওব্লাস্ট অভিমুখে টানা ৩৭ ঘণ্টার রেলযাত্রা। উল্লেখ্য, এই রিজিওনে আমরা বাংলাদেশি ছিলাম মাত্র দুজন। বিশাল ট্রেনে আমাদের কামরায় বাংলাদেশি আমরা দুজন সঙ্গে একজন পাকিস্তানি ও একজন ইথিওপিয়ান। ট্রেন অথোরিটি স্যুভেনির ও ওয়েলকাম স্নাকসের মাধ্যমে আমাদের স্বাগত জানাল। ট্রেন চলতে লাগল কৃষ্ণসাগরের উপকূল বেয়ে কোথাও দ্রুত আবার কোথাও ধীরগতিতে। বরফে ঢাকা জনবসতিহীন প্রান্তর, মাইলের পর মাইল পাইনের জঙ্গল, জমে যাওয়া নদী, কোথাও আবার যেন জর্জ অরওয়েলের অ্যানিমেল ফার্মের সেই ফার্মহাউস! জানালা খুলে বোঝার চেষ্টা করলাম বাইরের তাপমাত্রা। ভয়ানক ঠান্ডা যাকে বলে। ট্রেনে হিটার চলে, তাই টের পাইনি এতক্ষণ। এদিকে প্রায় সব সময়ই মোবাইল নেটওয়ার্কবিহীন। তাতে অবশ্য ভালোই হলো একদিক দিয়ে যে ততক্ষণে কামরায় গানের আসর জমে উঠেছে। অন্য কামরা থেকেও কেউ কেউ এসে যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। পাকিস্তানের বাসারাত, জাওয়াদ আর বাংলাদেশের আরজু ও মুক্তাদির ভাই মিলে মাতাচ্ছে বলিউডি গানের তালে। চলল বাংলা ও উর্দু গানও। সঙ্গে তাল মিলাচ্ছি আমি আর ইথিওপিয়ার গিতাচু। এভাবে রাত-দিন একাকার করে জীবনের দীর্ঘতম রেলভ্রমণ শেষে কাঙ্ক্ষিত মস্কো।
মার্চ ৯-১১ আপাতত ঠিকানা মস্কো অব্লাস্টের সলনেশ্নোগরস্ক নামক শহরে। সেখানকার সেনেজ ম্যানেজমেন্ট ল্যাব ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হবে কিছু কাঠখোট্টা ও মজাদার ইভেন্ট। ১০ তারিখে অনুষ্ঠিত হলো ব্রিকস ইয়ুথ ফোরাম যেখানে উঠে আসে বিশ্বরাজনীতিতে ও মাল্টিপোলার পৃথিবী নির্মাণে ব্রিকস জোটের ভবিষ্যৎ ও যুবসমাজের ভূমিকা। টানা চলতে থাকে গালা পার্টি ও রাশিয়ান আপ্যায়ন ও রুশ ঐতিহ্য ও ক্রীড়ার নানা প্রদর্শনী ও অংশগ্রহণের সুযোগ। শেষের দিন ১১ তারিখে চলে রুশ কুটিরশিল্প ও প্রথাগত নৃত্যের মাস্টারক্লাস। এই পর্ব শেষ হয় প্যান কেক প্রদর্শনী ও ‘ম্যাস্লেনিস্তা’ নামক কাকতাড়ুয়া পোড়ানোর মাধ্যমে, যা মূলত রুশ লোকসংস্কৃতিতে শীতের বিদায় ও বসন্তের আগমনের প্রতীকী রীতি। এদিনই আমাদের পরবর্তী এবং সর্বশেষ ধাপের প্রোগ্রামগুলোর উদ্দেশে যাত্রা। চলবে...
আগামীকাল পড়ুন: বিশ্ব যুব উৎসবে রাশিয়া ভ্রমণ অভিজ্ঞতা-৩
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]