বিশ্ব যুব উৎসবে রাশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা-১

ইতিপূর্বে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমজাতীয় একাধিক একাডেমিক ও ইয়ুথ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের আবেদন করে কোনোটাতে যখন নির্বাচিত হলেও পূর্ণ বৃত্তি জোগাড় করতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম আবার কোনোটিতে সরাসরি প্রত্যাখ্যাত, ঠিক সেই সময়ে ঢাকার রাশিয়ান হাউসের ফেসবুক পেজ থেকে জানতে পারি ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ ফেস্টিভ্যাল বা বিশ্ব যুব উৎসবের কথা। এবার হবে না তাই প্রবল অনাগ্রহ নিয়ে প্রথম ধাপের আবেদন সম্পন্ন করি। অতঃপর স্বভাবতই সময়ক্ষেপণ করতে করতে একদম শেষের দিকে কীভাবে যেন একটু মোটিভেশন নিয়ে শুরু করলাম দ্বিতীয় ধাপের আবেদন অর্থাৎ নির্দিষ্ট ফরম্যাটে পোর্টফোলিও সম্পাদনের একঘেয়ে কাজ। প্রথম ধাপে ব্যক্তিগত বিস্তারিত ও সিভি লিখেছিলাম। এবার লিখতে হবে নির্ধারিত ছয়টি থিমের ওপর ভিত্তি করে ইংরেজি অথবা রুশ ভাষায় একটি প্রশ্নের (আপনার কাছে ‘বিশ্ব যুব উৎসব’ প্রত্যয়ের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ও নিকটবর্তী অর্থ কী?) রচনামূলক উত্তর সঙ্গে নিজের অবস্থান ও সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন। প্রথমেই সমস্যা হিসেবে হাজির হলো কোন থিমে লেখা যায়। প্রতিটি থিমের পক্ষে-বিপক্ষে মনে মনে যুক্তিতর্ক দাঁড় করাতেই দুই দিন শেষ! অবশেষে থিতু হলাম লিখব ‘মাল্টি এথনিক ইউনিটি’ বা বহুজাতিক ঐক্য থিমের আলোকে। খসড়া লিখলাম মনের মাধুরী মিশিয়ে কয়েক পাতা।

অতঃপর বাধল আরেক বিপত্তি, যা এতক্ষণে খেয়াল করিনি যে নির্দেশনায় বলা হয়েছে লিখতে হবে স্পেসসহ মাত্র ১৫০০ ক্যারেক্টারে! আবার নিশ্চিত হয়ে নিলাম ১৫০০ ওয়ার্ড নয়, ক্যারেক্টারই বলা হয়েছে এবং এর ঊর্ধ্ব সিস্টেম অনুমোদন করবে না। লেখালেখির যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা জানেন বড় লেখাকে ছোট করা কতটা বিরক্তিকর ও কষ্টসাধ্য কাজ। বিগত শ্রম পণ্ড হবে এই ভেবে অবশেষে অনেক চেষ্টায় মূলকথা ঠিক রেখে লেখাটাকে লিমিটের মধ্যে আনা গেল। দ্বিতীয় ধাপের আবেদন শেষ। টুইস্ট কিন্তু একটা রয়ে গেছে। তৃতীয় ধাপ নামে ঐচ্ছিক একটি ধাপও আছে অ্যাপ্লিকেশন পোর্টালে, যা এক্সট্রা স্কোর যোগ করবে। এখানে একটি ভিডিও ধারণ করতে হবে সর্বনিম্ন ৩০ সেকেন্ড থেকে সর্বোচ্চ ১ মিনিটে যাতে ইংরেজি বা রুশ ভাষায় দিতে হবে তিনটি প্রশ্নের উত্তর, যথা ক. আপনার দেশ এবং রুশ ফেডারেশনের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার কী কী সম্ভাবনা দেখেন?, খ) কী জ্ঞান ও দক্ষতা আপনি উৎসবের অন্য অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে ভাগ করতে পারেন? এবং গ. এমন একটি বই (রুশ বা অন্য ভাষার) সম্পর্কে বলুন, যা আপনার জীবনদর্শনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। এই ধাপের উত্তর দিতে তেমন কোনো সমস্যা হলো না বরং এটা উপভোগ করলাম।

চেবুরাস্কা হাতে রুশ ভলান্টিয়ারের সঙ্গে
ছবি: সংগৃহীত

এসব চলল ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত, এরপর অপেক্ষা। ২০২৪–এর জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন দেশের সিলেকশন রেজাল্ট দেওয়া শুরু হলো। বাংলাদেশের ফলাফল দেওয়া শুরু হলো জানুয়ারির শেষের দিকে। অতঃপর সেই কাঙ্ক্ষিত ই–মেইল পেলাম ২৩ জানুয়ারি বিকেলে, যেখানে লেখা রুশ সরকারের পূর্ণ অর্থায়নে ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত হয়েছি। আহ! স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মনে পড়ল ‘ফরেস্ট গাম্পের’ সেই বিখ্যাত উক্তি ‘Life is like a box of chocolates. You never know what you’re gonna get.’ সেই বইয়ের পাতায় পড়ে আসা রুশ সাম্রাজ্য, আইভ্যান দ্য টেরিবল, পিটার দ্য গ্রেট, বলশেভিক বিপ্লব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের পরাজয়, রেড স্কয়ার, লেনিন-স্তালিন থেকে শুরু করে আজকের পুতিন অধ্যায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির আরও কতশত ব্যাপার এ দেশটার সঙ্গে সম্পর্কিত…রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে যেন একটু বেশিই রোমাঞ্চকর অনুভূতির অপেক্ষা করছিলাম। অবশেষে পুরোদমে প্রস্তুতি শুরু হলো পূর্ণ অর্থায়িত-আংশিক অর্থায়িত মোট ৯৫ জনের বাংলাদেশ ডেলিগেশনের ঢাকায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট অডিটরিয়ামে ৯ ফেব্রুয়ারির প্রস্তুতিমূলক মিটিংয়ের মাধ্যমে। সেখানে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের ন্যাশনাল প্রিপারেটরি কমিটির সভাপতি ফারহান তারেক ও সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন হায়দার ভাইসহ অন্যরা বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে কী করতে হবে।

এরপর ভিসা চূড়ান্ত হলে ২৯ ফেব্রুয়ারি সকাল সাতটার ফ্লাইটে টার্কিশ এয়ারলাইনের একটি বিমানে চড়ে শুরু হলো আকাঙ্ক্ষিত সেই যাত্রা। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে পৌঁছে ছয় ঘণ্টার যাত্রাবিরতি, অতঃপর পরদিন বেলা দুইটায় মস্কোতে পৌঁছানো। মস্কোর ভানুকভো বিমানবন্দর থেকে ওই দিনই মেইন ফেস্টিভ্যালের ভেন্যু সোচিতে যাত্রা। সোচিতে পৌঁছে হোটেলে চেক–ইন। পেলাম কৃষ্ণসাগরের কাছেই ‘বারখাত্নি সেজোনি’ নামের হোটেলে থাকার বরাদ্দ। সারি সারি বিভিন্ন নামের হোটেল আর ফেস্টিভ্যালে আসা নানা দেশের মানুষে যেন গোটা এলাকা মুখর। আর এ গোটা এলাকা পরিচিত ‘সিরিয়াস ফেডারেল টেরিটরি’ নামে যা মূলত ২০১৪ শীতকালীন অলিম্পিক উপলক্ষে নির্মিত অবকাঠামোর সঙ্গে আরও ব্যাপকভাবে সংযোজন করে নির্মিত এখন এক বিশেষ পর্যটন এলাকা। ফেস্টিভ্যাল মূল ভেন্যু হোটেল থেকে কাছেই। পরদিন সকালে শাটল বাসে করে অলিম্পিক পার্কে (মূল ভেন্যু) পৌঁছে দেখি এলাহী কাণ্ড। সারা বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশ থেকে আসা ১০ হাজার অংশগ্রহণকারী সঙ্গে ১০ হাজার রুশ অংশগ্রহণকারী এবং স্বেচ্ছাসেবী ও অন্যান্য লোকজন মিলে এই মহাকর্মযজ্ঞ দেখে মনে হলো এ হয়তো রাশিয়ার পক্ষেই সামাল দেওয়া সম্ভব। ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে গোটা ভেন্যুকে নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ সিটি’। যার একেক প্রান্তে একেক আয়োজন। ফেস্টিভ্যাল পাস ও কিট কালেকশন পর্ব শেষে ওই দিন থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম কোথায় কী চলছে সে রহস্য উদ্‌ঘাটনে। চারদিকে লাল-হলুদ নানা ইউনিফর্মে লেখা ‘এভরি লাইভস ম্যাটার’ আবার কোনোটায় ‘উই আর টুগেদার’।

২ মার্চ ইনডোরে বিরাট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হলো উদ্বোধন। যেখানে রাশিয়ার সেরা আর্টিস্টদের পারফরম্যান্স দেখার সুযোগ হলো। ইংরেজি ট্রান্সলেশনের ব্যবস্থা থাকায় একনজরে জানার সুযোগ হলো রাশিয়ার অতীত ও বর্তমান। বাইরে এসে দেখি একদিকে বিরাট মঞ্চে নানা জনরার রুশ মিউজিক সঙ্গে ডিজেতে মুখর। সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় হলো আয়োজকদের সবার চাহিদার প্রতি ন্যায়বিচার করা অর্থাৎ ধরা যাক আপনার মিউজিক বা ড্যান্স ভালো লাগছে না আপনি চাইলেই যেতে পারেন আপনার আকর্ষণের জায়গায়। রাশিয়ার ৪৬টি অব্লাস্ট (রাজ্য সদৃশ প্রশাসনিক অঞ্চল), ২১টি স্বায়ত্তশাসিত রিপাবলিক ও আরও কিছু ফেডারেল অঞ্চলের কোনো না কোনো প্রতিনিধিত্ব এখানে আছে। বিভিন্ন স্টলে ঘুরে তাদের ব্যাপারে জেনে, তাদের সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা দেখি আর অবাক হয়ে ভাবি কি বিচিত্র পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দেশ। বিশেষ করে তাতারস্তান, দাগেস্তান, বাশকোরতোস্তান, চেচনিয়া, মরদোভিয়া, ইয়াকুতিয়া ইত্যাদি রিপাবলিক সম্পর্কে জেনে মনে হয় এ যেন দেশের ভেতর আরেক দেশ! নিজেদের আলাদা পতাকা, আলাদা জাতীয় সংগীত, অনেক স্বশাসন কিন্তু দিন শেষে সবাই লাল-নীল-সাদা রুশ পতাকা নিয়ে গর্বিত। আর এ জন্যই রাশিয়া হলো ফেডারেশন। চলবে...

* আগামীকাল পড়ুন: বিশ্ব যুব উৎসবে রাশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা-২

* লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]