বাংলায় ফুলের ব্যবহার ও ধরন: দ্বিতীয় পর্ব
১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত সাময়িকী ‘কৃষক’–এ ফুল বিক্রিসম্পর্কিত চমকপ্রদ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। কলকাতায় কালীঘাটের মতো বিভিন্ন দেবালয়ের নিকট জবা, গন্ধরাজ, মল্লিকা, গাঁদা, স্থলপদ্ম, পদ্ম, চাঁপা প্রভৃতি ফুল বিক্রি হতো তখন। ফুল বিক্রিতে লাভ হতোো যথেষ্ট। বেল ও জুঁই ফুল বিক্রয়ের প্রধান স্থান ছিল ‘মেচুয়া বাজার’, যা পরবর্তীকালে ‘জোড়াসাঁকো’ নামে পরিচিতি পায়। মালি ও পাইকাররা তখন বাগানমালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে বাগানের ফুল কিনতেন। পরবর্তী সময়ে তাঁরা রাস্তায় ফেরি করে শৌখিন ক্রেতাদের নিকট তা বিক্রি করতেন। মৌসুমের শুরুতে অর্থাৎ ফাল্গুনের প্রথম দিকে বেলি ফুল ছয় থেকে আট টাকা সের বিক্রি হতো। গোলাপ, রজনীগন্ধা, শ্বেতচাঁপা, ম্যাগনোলিয়াজাতীয় ফুল ও বিলেতি মৌসুমি ফুলের প্রধান বিক্রয়স্থল ছিল সাহেবের বাজার। কলকাতা করপোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান স্টুয়ার্ট হগের নামে বাজারের এই নামকরণ। সরকারিভাবে এর নাম ‘স্টুয়ার্ট হগ মার্কেট’ হলেও পরবর্তীকালে কলকাতাবাসীর নিকট তা ‘নিউমার্কেট’ নামে পরিচিতি পায়। হগ সাহেবের বাজারের ফুল ব্যবসায়ীরা উন্নতমানের যেসব গোলাপ প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করতেন, তার সঙ্গে কলকাতার গোলাপ পাল্লা দিয়ে পারত না।
ফুল খাতের বিভিন্ন সমস্যা ও গবেষণায় কাজ করত কৃষি বাগিচা সমিতি। কীভাবে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞের সহযোগিতায় পরিচিত ফল, ফুল ও সবজির উন্নতি সাধন করা যায়, সে লক্ষ্যেই কাজ করত সমিতি। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে সমিতি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন পার্শি ল্যাঙ্কেস্টার। বাগিচাসংক্রান্ত কাজে বিশেষত বর্ণ সংকর উৎপাদনে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল লক্ষণীয়। উৎপন্ন ফুল ও ফসলের নৈর্ব্যক্তিক উপস্থাপনা ও প্রসারে বিজ্ঞাপন বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বাগান পরিচর্যা, বীজ, চারা ও ফুল চাষসম্পর্কিত বিজ্ঞাপনের দেখা মেলে ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত ‘মিসেস টেম্পল রাইটস ফ্লাওয়ার্স অ্যান্ড গার্ডেনস ইন ইন্ডিয়া’ (Mrs Temple-Wright’s Flowers and Gardens in India) গ্রন্থে।
ফুল ও চারাসংশ্লিষ্ট নানাবিধ সেবা প্রদানের বিষয়ে ক্যালকাটার সাটন অ্যান্ড সন্স, দেওঘরের পি ভট্টাচার্য অ্যান্ড সন এবং ঘুঘুডাঙ্গার হাবি অ্যান্ড কোং–এর বিজ্ঞাপন সামাজিক ইতিহাসের এক অনন্য উপকরণ হয়ে আছে আজও। উদ্যানসংশ্লিষ্ট খাতে ইন্ডিয়ান গার্ডেনিং অ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা সবজি ও মৌসুমি ফুলের বীজ বপনের সময় নিরূপণ তালিকা প্রকাশ করত। মূল্য ছিল এক আনা। দেড় আনার ডাকটিকেট পাঠালেই তা সংগ্রহ করা যেত (কৃষক, পৌষ ১৩১১)। ভিক্টোরিয়া, এমপ্রেস, কসিপোর ইত্যাদি ছিল সেকালের বাংলার প্রধান নার্সারি।
বিশ শতকের মাঝামাঝি ঢাকায় ফুল–বাণিজ্যের দেখা মেলে মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুমের ‘ঢাকার ইতিবৃত্ত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে। তাঁর বর্ণনামতে, ঢাকায় বিয়ে উপলক্ষে সেকালে ফুলের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। বরের বাড়ি থেকে কনের বাড়িতে ডালা পাঠানো হতো। কাঁচা কাঁঠালপাতা দিয়ে তৈরি এই সাজির ভেতর থাকত কনের জন্য তৈরি ফুলের হার, চুড়ি, মালা ইত্যাদি গয়না। তবে ব্যাপক আকারে ফুলের চাষ তখন ছিল না এবং ফুলের দোকানও সর্বত্র নজরে পড়ত না। চকবাজার ও শাঁখারী বাজারের মোড়ে মালাকারেরা ফুলের পসরা সাজিয়ে বসতেন। জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরী ৩৪ বছরের অপার মমতায় গড়ে তুলেছিলেন জীবন্ত উদ্ভিদের জাদুঘর বলধা গার্ডেন। দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিরা এই বাগান দেখতে আসতেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বলধায় এসে ক্যামেলিয়া ফুলের বাহারি রূপে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন—
‘কাঁটাতে আমার অপরাধ আছে,
দোষ নাহি মোর ফুলে।
কাঁটা, ও গো প্রিয়, থাক্ মোর কাছে,
ফুল তুমি নিয়ো তুলে।’
বলধার গোলাপবাগানে ছিল প্রায় ২০০ জাতের গোলাপ। সৈয়দ আলী আহসানের ‘ষাট বছর আগের ঢাকা’ বইতে এই গোলাপ বিক্রির খোঁজ মেলে। তিনি লিখেছেন, খুব সকালে বলধা গার্ডেনের ফটকের বাইরে বড় আকারের লাল গোলাপ বিক্রি হতো। ছোট হলেও আরেকটি ফুলের বাজার সম্পর্কে জানা যায় মিজানুর রহমানের ‘ঢাকা পুরাণ’ গ্রন্থে। এটা ছিল বাবু বাজার ফাঁড়ির কাছে। এদের ক্রেতা ছিলেন মূলত কুমারটুলীর অভিযাত্রীরা। দেহপসারিণীদের গলার শোভা বাড়াতেই ছিল এখানকার ক্রেতাদের যত আয়োজন!
গঙ্গাজলি ও সাঁচিবন্দর পতিতালয়ে ঢোকার মুখে ইসলামপুর রোডে আর বাদামতলী, ওয়াইজ ঘাট পতিতালয়ের সামনেও ফুলের দোকান বসত। মোহাম্মদ মাহবুব আলমের ‘আদি ঢাকার আদিবাসী বিলুপ্তপ্রায় উর্দুভাষা ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থ থেকে এ তথ্য জানা যায়। লেখক জানান, ফুল চাষ বা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত অনেক পরিবার বংশপরম্পরায় আজিমপুর এতিমখানা দক্ষিণের এলাকায় বাস করত, যা লালবাগ কেল্লার দেয়াল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ঢাকা কেন্দ্রের পরিচালক মোহাম্মদ আজিম বখশ ফুলের বাজার সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জানান, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পর থেকে পূর্ববঙ্গে ফুলের প্রচলন বেশ খানিকটা বেড়ে যায়। হাইকোর্ট মাজারকে কেন্দ্র করে নিকটবর্তী বটতলায় গড়ে ওঠে ফুলের ব্যবসা। বৃহস্পতিবার রাতে এখানকার ফুলের চাহিদা থাকত সবচেয়ে বেশি। প্রভাতফেরির ফুল সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাবেক কূটনীতিক ও সাংবাদিক আবু মুসা হাসান লিখেছেন, ‘আমাদের সময় ফুলের প্রধান উৎস ছিল নিউমার্কেটের পার্ক। নিউমার্কেটের ঠিক মাঝখানে ছিল একটি সুন্দর পার্ক। আর ফাল্গুন মাসে রংবেরঙের ফুলে ভরে থাকত ওই পার্ক। ফুলের আরও উৎস ছিল নিউমার্কেটের পার্শ্ববর্তী পার্টি হাউস বা সদস্য ভবন (পাকিস্তান আমলের এমপি হোস্টেল) এবং রমনা পার্ক। ঢাকা কলেজেও ছিল সুন্দর বাগান।’ ফুলের নির্যাস সংগ্রহ করে সেকালে ঢাকায় সুগন্ধিও তৈরি হতো। গান্ধী নামের এক ব্যক্তি এই সুগন্ধি তৈরি করতেন বলে গলির নামই হয় ‘গান্ধী গলি’। বিশেষ শোধনপদ্ধতির মাধ্যমে চম্পা, বেলি, জুঁই ইত্যাদি নাম দিয়ে সুগন্ধি তৈরি করতেন তিনি। ফরাসি সৌরভের মতো অতটা মন উচাটন করা না হলেও এই সুগন্ধি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং বাজারে সমাদৃত হয়। গোলাপের আতর, গোলাপজল ইত্যাদিও তৈরি করতেন তিনি। নাজির হোসেনের লেখা ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ বইতে এই সুগন্ধি প্রস্তুতের বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।
অলকানন্দা প্যাটেলের আত্মজীবনী ‘পৃথিবীর পথে হেঁটে’ গ্রন্থে ফুটে উঠেছে বিংশ শতাব্দীর ত্রিশ-চল্লিশ দশকে ঢাকা নগরের ফুলবাগানের চিত্র। সে সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমার প্রথম স্মৃতি পুরানা পল্টনের ৫ নম্বর বাড়িকে ঘিরে। নিরিবিলি পাড়া, অনেকটা জমি নিয়ে বেশির ভাগ একতলা বাড়ি। কুন্দ, দোলনচাঁপা, মাধবীলতা, জুঁই-কাঞ্চন ছাড়া অনেক বাড়িতে ছিল মৌসুমি ফুলের বাগানও। আমার বাবার বাগানের শখ এত বেশি ছিল যে চন্দ্রমল্লিকার diameter ঢাকাতেও মাপতেন, শেষ জীবনেও মাপ নিয়ে ১২ ইঞ্চি বা ১৪ ইঞ্চি হলো, তা জানিয়ে উৎফুল্ল হয়ে আমাদের কাছে চিঠি দিতেন। বাগানের শখ মেটাতে অনেকেই বাইরে থেকে বীজ আনিয়ে বিদেশি ফুল ফোটাতেন। ...শীতকালে ৫ নম্বরে বেড়ার সঙ্গে বাঁশ আঁকড়ে চড়ে যেত সুইট পি ফুলের লতা। ছোট ছোট ফুল মিটমিট করে তাকিয়ে থাকত। ন্যাস্টারসিয়াম, ফ্লক্স, পিটুনিয়া ছড়িয়ে দিত পাঁচমিশালি গালিচা। এ ছাড়া থাকত পূজার ফুল—গাঁদা, টগর, লাল গোলাপ, জবা, বিশেষ করে পঞ্চমুখী আর সুগন্ধি রজনীগন্ধা, বেল ফুল, কুন্দ, কাঞ্চন। আমার প্রিয় ছিল মাধবীলতার গুচ্ছ, ঝুমকোলতা আর সবুজ ঘাসের ওপর ছড়ানো শিউলি ফুল। ...আর শিউলি ফুল মানেই তো শরতের নরম সোনালি রোদ, দুর্গাপূজার ঢাকের ধ্বনি, উৎসবের ডাক, আনন্দ। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে নানা এলাকার বেশির ভাগ বাড়িতে সুন্দর বাগান ছিল। নীলক্ষেতের বাগান ছিল বিখ্যাত। বিশেষ করে প্রফেসর সত্যেন বোসের বাগান, সেখানে উনি পায়চারি করতেন। আমার বাবার মতো। মালি কাজ করলেও গৃহস্বামী নিজেই বাগানের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতেন।’
দেশ-বিদেশের নানা জাতের গোলাপগাছ সংগ্রহ করে ঢাকার জমিদার হৃষিকেশ দাস গড়ে তুলেছিলেন সমৃদ্ধ ‘রোজ গার্ডেন’। গোলাপের সেই ঘ্রাণ কবি শামসুর রাহমানকে আচ্ছাদিত করেছে বহুকাল পরও। পুরান ঢাকার বেসামাল এক মানুষের জবানিতে ‘এই মাতোয়ালা রাইত’ কবিতায় তিনি লিখেছেন—
‘এহনবি জিন্দা আছি
এহনবি এই নাকে আহে গোলাপ ফুলের বাস
মাঠার মতো চান্নি দিলে নিরালা ঝিলিক মারে।’
অখণ্ড সেই বাংলা আজ আর নেই। কালের পরিক্রমায় ঔষধি ফুল ও ফুলগাছের স্থান দখল করেছে শোভাবর্ধনকারী ফুল ও ফুলের গাছ। বাগান বলতে সেকালে যা ছিল শুধু শিল্প ও বিজ্ঞান, একালে এসে তা বৃহৎ শিল্পে রূপ নিয়েছে। ইত্যবসরে ফুলের সতেজতা ও স্থায়িত্ব বেড়েছে অনেকখানি। বিভিন্ন বাণিজ্যিক ফুলের রং ও ধরনে এসেছে বৈচিত্র্য। ফুলের তোড়া সাজানোয় এসেছে যথেষ্ট নান্দনিকতা ও বৈচিত্র্যময়তা। সহজে ও স্বল্প পুঁজিতে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির কারণে এতদঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের চাষ ও ব্যবহার বেড়েছে। ফুল বাণিজ্যের অপরিহার্য অংশ হিসেবে ফুলের চারা ও ফুলসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপকরণের চাহিদাও বেড়েছে। বিভিন্ন দিবস প্রতিপালনে ফুলের ব্যবহার হয়ে উঠেছে অত্যাবশ্যক। বিয়েশাদি তো বটেই, অন্যান্য জাতীয় অনুষ্ঠান যেমন মাতৃভাষা দিবস, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, পহেলা বৈশাখ, ইংরেজি নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন, পূজা-পার্বণ এবং সামাজিক জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই বেড়েছে ফুলের ব্যবহার। তবে প্রাচীন বঙ্গে সুঘ্রাণযুক্ত যে ফুলের বর্ণনা পাওয়া যায়, তা আজ বিরল। ফুলের শোভা ও সৌন্দর্য আছে, কিন্তু সুঘ্রাণ নেই। গন্ধের সেই বৈচিত্র্যও নেই।
*লেখক: হোসাইন মোহাম্মদ জাকি, গবেষক
**নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারবেন [email protected]–এ