বাংলায় ফুলের ব্যবহার ও ধরন—প্রথম পর্ব

শ্রী নগেন্দ্রনাথ স্বর্ণকার সম্পাদিত কৃষিবিষয়ক সাময়িকী ‘কৃষক’ (১৩১২ বঙ্গাব্দ, ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ), ষষ্ঠ খণ্ড, প্রথম সংখ্যা, বৈশাখসংখ্যার প্রচ্ছদ।
উৎস: লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রাহাগার।

মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ফুলের ব্যবহার ও চাহিদা। আমাদের শিল্প-সাহিত্যের পরতে পরতে রয়েছে ফুল ব্যবহারের ইতিহাস। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের (৩৭৫-৪১৫) সভাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’ রচনায় অলকাপুরীর নারীরা চুল সাজাতে ব্যবহার করতেন কদম্ব ফুল। আর বাহুতে বহন করতেন গোলাপি পদ্ম। রাজা হর্ষবর্ধনের (৬০৬-৬৪৭) সভাকবি বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’-এ চম্পক, অশোক ও কদম্ব ফুলের সন্ধান মেলে। মোগল আমলে নগরের প্রায় সব পল্লিতেই ছিল বাগানের ছড়াছড়ি।

শাহবাগ, লালবাগ, গোলাপবাগ, হাজারীবাগ, মালিবাগ, মালিটোলা ও ফুলবাড়িয়ার মতো অজস্র এলাকা সেই পরিচয়ের অনন্য স্মারক। মোগল বাগানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো কুঞ্জলতা, গোলাপ, কার্নেশন, ড্যাফোডিল, লিলি, টিউলিপ ইত্যাদি বিদেশি ফুলের প্রবর্তন। কথিত আছে, মোগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান গোলাপের পাপড়ি থেকে আতর তৈরির সূত্র প্রথম আবিষ্কার করেন। ইংল্যান্ড ও অন্যান্য দেশ থেকে বিদেশি ফুলের গাছ আমদানি, কলকাতা বোটানিক গার্ডেন ও অ্যাগ্রিহর্টিকালচার সোসাইটি কলকাতার প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় ফুল গাছের সংকলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ আমলে ফুল শিল্পের গতি লাভ করে। বিলেতি মৌসুমি ফুলের গাছে চোখজুড়ানো রঙিন ফুলের পাশে ফুটে ওঠে মনভোলানো কামিনী, করবী, কাঞ্চন ও গন্ধরাজ!

বাংলার ব্যতিক্রমী এক ফুল এবং সেখান থেকে প্রস্তুত সুগন্ধীর কথা জানা যায় ‘ট্রাভেলস অব ফ্রে সেবাস্তিয়ান ম্যানরিক (১৬২৯-১৬৪৩)’ গ্রন্থে। লেখক এখানে ফুলটির নাম উল্লেখ করেননি। তিনি লিখেছেন, মেদিনীপুর রাজ্যের অধিবাসীরা এই ফুল ব্যবহার করত। সেই ফুল থেকে তেল তৈরি করা যেত। বিভিন্ন রাজ্যে তা রপ্তানিও হতো। বিশেষত, উচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তি ও সম্পদশালী পুরুষদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য গন্ধযুক্ত অতি মূল্যবান এই তেল পাঠানো হতো। সার্জন জেমস টেইলরের লেখা ‘A sketch of the topography & statistics of Dacca’ (১৮৪০) গ্রন্থ পর্যালোচনায় কুসুম ফুলের বিষয়ে জানা যায়। সাধারণত, কুসুম ফুলের পাঁচ সের বীজ থেকে এক সের পরিমাণ তেল পাওয়া যেত। শর্ষের তেল অপেক্ষা এই তেল ছিল সস্তা। কৃষকেরা শর্করা ও দুধের সঙ্গে মিশিয়ে এই বীজ খেত। এ ছাড়া কুসুমগাছের পাতা ও ডালপালার চূর্ণ কাপড়ের রং হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রতি বিঘা জমিতে আধা মণ পর্যন্ত কুসুম ফুল হতো। ঢাকা জেলার মতো এত ভালো মানের কুসুম ফুল ভারতবর্ষের আর কোথাও উৎপন্ন হতো না।

‘Notes on the Races, Castes and Trades of Eastern Bengal’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত।
উৎস: লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রাহাগার।

১৮৭৬ সালে প্রকাশিত ‘A Statistical Account of Bengal (Volume-III)’ থেকে মেদিনীপুর ও হুগলী জেলায় ৬১৫৬ জন মালি তথা উদ্যানরক্ষক ও ফুল বিক্রেতার কথা জানা যায়। এই বিপুল সংখ্যা দেখে ফুলের ব্যাপক ব্যবহার যে সেকালে ছিল, তা ধারণা করা যায়। উনিশ শতকের ষাটের দশকে জেমস ওয়াইজ ছিলেন ঢাকার সিভিল সার্জন। ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘Notes on the Races, Castes and Trades of Eastern Bengal’ গ্রন্থ থেকে উনিশ শতকে ফুলের ব্যবহার, ধরন ও মালিদের কার্যক্রম সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়। গ্রন্থটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, তখন ঢাকায় মুসলমান মালি ছিলেন অসংখ্য। ফুলের চারার পরিচর্যা করে বাজারে বিক্রি করতেন তাঁরা। বিভিন্ন জাতের জুঁই, চামেলি, বেলি, গাঁদা ও গোলাপের চারা উৎপাদন করতেন। এ ছাড়া মুসলিম নারীদের ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন রকমের ফুলের মালা, ফুলের বাজুবন্ধ, ফুলের ছড়ি প্রস্তুত করতেন। ফুলের তোড়া ছিল সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের অতি প্রিয়। পীর-দরবেশের মাজারে ফুলের প্রয়োজন পড়ত। ছিলেন হিন্দু মালাকারও। তাঁরা ফুল দিয়ে ঘরবাড়ি, দোকান ও নৌকা সাজিয়ে দিতেন। মন্দিরে ফুলের জোগান দিতেন। দেব-দেবীর প্রতিমায় যে ফুলের মালা দেওয়া হতো, তা সংগ্রহ করতেন মালাকারেরা। বিশেষ বিশেষ দেব-দেবীর জন্য বিশেষ বিশেষ ফুলের ব্যবহার ছিল। নৈবেদ্য দেওয়ার জন্য চম্পা, চামেলি, বেলি, গন্ধরাজের মতো সুগন্ধী ফুলের ব্যবহার হতো। দেব-দেবীর প্রতিমার গলায় যে ফুলের মালা দেওয়া হতো, তা সুতায় বাঁধা হতো না। তা বাঁধা হতো কলাগাছের ছিলকা দিয়ে। মালাকার ছাড়া অন্য কারও গাঁথা মালা পবিত্র বলে বিবেচিত হতো না। বিয়েতে কনের মাথার খোঁপা বাঁধার দায়িত্বও ছিল মালাকারদের। খোঁপার একদিকে থাকত বেলি ফুল আর অন্যদিকে থাকত গোলাপ।

শ্রী নিশিকান্ত ঘোষ সম্পাদিত ‘কৃষি সম্পদ’ (১৩১৭ বঙ্গাব্দ, ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ), দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, বৈশাখী পূর্ণিমা সংখ্যার প্রচ্ছদ।
উৎস: লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রাহাগার।

ফুলের ব্যবহার, বিপণন ও ফুল গাছের পরিচর্যা-সম্পর্কিত বিবিধ তথ্য প্রকাশিত হতো কৃষি সাময়িকীগুলোয়। শ্রী নিশিকান্ত ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো সচিত্র মাসিকপত্র ‘কৃষি-সমাচার’। ‘কৃষি-সমাচার’-এর অফিস ছিল ঢাকায়। পরে যার নাম রাখা হয় ‘কৃষি-সম্পদ’। পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর থেকে তখন প্রকাশিত হতো ‘কৃষিকথা’। বীরভূমের সিউড়ী থেকে ‘ভূমিলক্ষ্মী’, কলকাতা থেকে ‘প্রকৃতি’ আর ইন্ডিয়ান গার্ডেনিং অ্যাসোসিয়েশন, ১৬২ বউবাজার স্ট্রিট, কলকাতা থেকে শ্রী নগেন্দ্রনাথ স্বর্ণকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো ‘কৃষক’। এসব সাময়িকীতে সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পেত গোলাপ ফুলসম্পর্কিত বিষয়। গোলাপগাছের পরিচর্যা, বিশেষত সার ও রাসায়নিক সার কীভাবে দিতে হয়, তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা থাকত সাময়িকীগুলোয়। সে সময় বছরে অন্তত তিনবার ফুলের বিশেষ প্রয়োজন পড়ত। প্রথমত, হিন্দুদের দুর্গোৎসবে, দ্বিতীয়ত, খ্রিষ্টানদের বড়দিনে এবং তৃতীয়ত, মুসলমানদের ফাতেহা–ই–ইয়াজদাহমে। ১৯০১ সালে (পৌষ ১৩০৮, দ্বিতীয় খণ্ড, নবম সংখ্যা) প্রকাশিত সাময়িকী ‘কৃষক’ পর্যালোচনায় দেখা যায়, বড়দিনের সময়ে কলকাতা শহরে ফুলের বাজার বেশ চড়া থাকত। ক্রিসমাসের সন্ধ্যায় বাজারে ফুল তেমন দেখা যেত না। যেসব দোকানদার সন্ধ্যা পর্যন্ত ফুলের সরবরাহ অটুট রাখতে পারত, তারা একটি ফুল আট আনা থেকে এক টাকাতেও বিক্রি করতে পারত!

শ্রী সত্যচরণ লাহা সম্পাদিত সচিত্র বৈজ্ঞানিক পত্রিকা ‘প্রকৃতি’ (প্রথম বর্ষ ১৩৩১) সংখ্যার প্রচ্ছদ
উৎস: লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রাহাগার।

একই সাময়িকীতে (মাঘ ১৩০৮, দ্বিতীয় খণ্ড দশম সংখ্যা) ‘গোলাপ ফুলের মেলা’ শীর্ষক একটি খবর খুঁজে পাওয়া যায়। আলিপুর উদ্যানে অ্যাগ্রিকালচারাল সোসাইটির উদ্যোগে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সাময়িকীটির ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের এক সংখ্যায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩১২, ষষ্ঠ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা) পুষ্প প্রদর্শনীর কথা জানা যায়। শিলংয়ের এই ফুলমেলায় পদক ও পুরস্কারের ব্যবস্থা ছিল। এই পুষ্প প্রদর্শনী দেখার জন্য উৎসুক জনতার আগ্রহ এতটাই বেশি ছিল যে প্রদর্শনীর টিকিট কিনেছিলেন প্রায় ২৪০ জন! বাগানসংক্রান্ত নানা ধরনের যন্ত্র সেখানে প্রদর্শিত হয়। তখনকার দিনের এসব পুষ্প প্রদর্শনীতে শুধু ফুলই স্থান পেত না, সারি সারি ফল এবং সবজিও সাজানো থাকত। পাশাপাশি থাকত কিছু নতুন এবং দুষ্প্রাপ্য গাছ। কলকাতার গড়ের মাঠেও ফুলের মেলা আয়োজনের প্রমাণ পাওয়া যায়।

বিশ শতকের শুরুতেও ভারতবর্ষে ফুল বাণিজ্যের যে ততটা পসার হয়নি, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘ফুলের মূল্য’ গল্পে লেখকের স্বগতোক্তি থেকে তা অনুমান করা যায়। এটি প্রকাশিত হয় ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে। গল্পের মূল চরিত্র ব্রিটেনের এক দরিদ্র কিশোরী ম্যাগি। ভারতবর্ষে তার ভাইয়ের সমাধিতে ফুল দেওয়ার জন্য লেখককে সে যখন একটি শিলিং দেয়, তখন লেখকের স্বগতোক্তি ছিল, ‘ভাবিলাম, বালিকার এই বহু কষ্টার্জিত শিলিংটি ফিরাইয়া দিই। বলি, আমাদের দেশে ফুল যেখানে-সেখানে অজস্র পরিমাণে পাওয়া যায়, পয়সা দিয়া কিনিতে হয় না।’ শ্রী যতীন্দ্রমোহন রায়ের লেখা ‘ঢাকার ইতিহাস (১ম খণ্ড)’ (১৯১২) বইয়ে সেকালে ঢাকা জেলার বিভিন্ন স্থানে দেখা যেত—এমন সব ফুলের নাম পাওয়া যায়। গেন্দা, জুঁই, বেলি, মালতী, অপরাজিতা, জবা (শ্বেত ও লাল), বকুল, চাঁপা, ভুঁইচাঁপা, কনকচাঁপা, কাঁঠালচাঁপা, আকন্দ, করবী (রক্ত ও শ্বেত), ঝুমকা, পদ্ম, দ্রোণ, ঝিকটি, ভাইট, টুনী, হাজরা, নন্দদুলাল, টগর প্রভৃতি ফুলের উল্লেখ রয়েছে সেখানে।

কৃষিবিষয়ক সাময়িকী ‘কৃষক’-এর জ্যৈষ্ঠ ১৩০৮ সংখ্যায় প্রকাশিত বাগানের কার্যশিক্ষাবিষয়ক নিয়মাদি।
উৎস: লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রাহাগার।

কৃষি সাময়িকীগুলোর সম্পাদকদের কাছে নিজ নিজ ঠিকানা উল্লেখপূর্বক খোলা পত্র দেওয়ার চল ছিল সে সময়। পত্রে ফুল, ফল কিংবা কৃষি খাতে বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক অংশীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিনিয়োগ পরিবেশ ও সম্ভাবনা-সম্পর্কিত বিষয়াদি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হতো। এ ছাড়া ফুল, ফল বা অন্য কোনো কৃষিভিত্তিক বাগান কীভাবে গড়ে তুলতে হয়, সে বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থাও ছিল এই সাময়িকীগুলোয়। বাগানের কাজ শেখার এবং ছাত্র ভর্তির কতগুলো সুনির্দিষ্ট নিয়ম মানতে হতো। কোনো ছাত্রকে বাগানে পাঠানোর পূর্বশর্ত ছিল তার খাবারের ব্যবস্থা। মাসে ছয় টাকা হলেই একজন ছাত্রের খাবারের ব্যয় মেটানো যেত। বাগানের কাজ শেখার জন্য আলাদা করে কোনো বেতনাদির প্রয়োজন হতো না। প্রশিক্ষণার্থীর বয়স হতে হতো নিদেনপক্ষে ষোলো, তবে ত্রিশের বেশি নয়। তার বুদ্ধিমত্তা, ধারণক্ষমতা ও প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করে বাগানের কাজ শিখতে এক থেকে তিন বছর সময়ের প্রয়োজন হতো।

চলবে...

লেখক : হোসাইন মোহাম্মদ জাকি, গবেষক