পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কণ্ঠস্বর—স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-৭
বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
প্রবাদ আছে, ‘গোলাপকে যে নামেই ডাকি না কেন, সে মিষ্টি গন্ধই দেবে।’ সত্যিকার অর্থে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ আর ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’—এ দুটো নামের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দুটো নামই ওই গোলাপের মতো। দুটো নামের মধ্যেই ছিল বাঙালি জাতির অস্তিত্ব। প্রতিরোধের আগুন। ঘুরে দাঁড়ানোর স্পর্ধা। দুটো নামেরই উদ্দেশ্য এক।
১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পটিয়ায় ছিলেন। বেতারকর্মীদের অনুরোধে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। নিজেও আসেন। ২৮ মার্চ লে. শসশের মোবিন একটি প্রস্তাব করেন। সেটি হলো স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে ‘বিপ্লবী’ শব্দটা বাদ দেওয়া যায় কি না। এ শব্দটা বাদ দেওয়ার জন্য তিনি মেজর জিয়াকে অনুরোধ করেন। মেজর জিয়া ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেন।
২৮ মার্চ দুপুরের অধিবেশন থেকে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি চিরতরে বাদ যায়। এ দুপুর থেকে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ হয়ে গেল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। তারপর যুদ্ধের পুরো সময়টা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এর নাম ছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।
এ কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন ঘোষণা প্রচারিত হতে থাকে। এর মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার মানবসভ্যতার ভয়াবহতম গণহত্যার খবর দেশ-বিদেশের মানুষ জানতে পারে। জানতে পারে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা। প্রচারিত হয় বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার সংবাদ। আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিবাহিনী গঠনের আগেই এ কেন্দ্রে মুক্তিবাহিনী গঠনের খবর প্রচারিত হয়েছে।
বিশ্বের গণমাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিভিন্ন ঘোষণা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। তাই বিদেশি গণমাধ্যম থেকেও মানুষ স্বাধীনতার সূচনা পর্বের কথা জানতে পেরেছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একটি প্রিয় গান ছিল ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’। গানটি মানুষের কাছে ছিল অত্যন্ত আবেগ ও ভালোবাসার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের মানুষকে গানটি ভীষণভাবে প্রেরণা দিত।
প্রথম দিকে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা সংগীত হিসেবে প্রচারিত হতো। ২৯ মার্চ থেকে অনুষ্ঠানের শুরু ও শেষে অংশবিশেষ বাজানো হতো। যেকোনো অনুষ্ঠান শেষে আরও থাকত, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তখনই একটি জাতিকে সাহায্য করেন, যখন সে জাতি নিজেকে সাহায্য করে।’
২৮ মার্চ বেতারকর্মীরা ট্রান্সমিটার ভবনে থাকা শুরু করেন। পাশের গ্রাম থেকে খাবার আসত। এখানে মোহরা নামে একটি গ্রাম আছে। এ গ্রামে ছিল দুই ভাই সেকান্দার হায়াত খান ও হারুন অর রশিদ খান। সর্বস্ব দিয়ে তাঁরা সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে সহযোগিতা করেন। এসব মানুষের কথা মনে রাখা প্রয়োজন।
স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের আয়ু ছিল মাত্র দুই দিন। ২৬ ও ২৭ মার্চের অধিবেশনেই শুধু ‘বিপ্লবী’ নামটি ছিল। ২৮ মার্চ ‘বিপ্লবী’ শব্দটা বাদ দেওয়া হয়। এদিন থেকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের নতুন নাম হয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।
সূচনা পর্বের দুঃসাহসী অভিযাত্রী
১৯৭১ সাল। ২৫ মার্চ। এ জনপদের মাটিতে স্মরণকালের ভয়াবহ গণহত্যা। গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার। গ্রেপ্তারের আগে স্বাধীনতার ঘোষণা। একটার পর একটা ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটছে। মানুষ দিশাহারা। স্তম্ভিত। এদিকে ইপিআরের ওয়্যারলেসে রাতেই স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রাম পৌঁছে গেছে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা চট্টগ্রাম ছাড়া সব বেতার কেন্দ্রের দখল নিয়েছে। সকাল থেকে বেতারকেন্দ্রগুলোতে সামরিক আইনের ঘোষণা হচ্ছে। তখন চট্টগ্রামের বেতারকর্মীরা কাজ বন্ধ করে দিলেন। বিদ্রোহ করলেন। বেরিয়ে এলেন বেতার কেন্দ্র থেকে। প্রায় সবাই আগ্রাবাদ জাম্বুরি মাঠের টিঅ্যান্ডটি কলোনির এক সভায় মিলিত হন। কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন আবদুস শাকের। অন্য সবাই ছিলেন বেতারকর্মী। সভায় সিদ্ধান্ত হয়। কালুরঘাট বেতার থেকে কার্যক্রম চলবে। পরবর্তী সময়ে সবকিছু যে ঠিকভাবে হয়েছে, তা হয়তো নয়। তবে সেদিন যাঁরা এ সভায় বসেছিলেন, সবার উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে কিছু করতে হবে। এদিকে চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ, বেতারকর্মী, ছাত্র-জনতা—সবাই প্রায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার খবর জেনে গেছেন। এমন একটা দুঃসময়ে কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু সেটা কী? সবাইকে সংগঠিত করতে হবে। বেলাল মোহাম্মদ ও চট্টগ্রামের কয়েকজন বেতারকর্মী ও স্থানীয় রাজনীতিবিদ বেতার সম্প্রচারের কথা ভাবলেন। প্রথম দিকে বেলাল মোহাম্মদসহ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন বেতারকর্মী কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে সম্প্রচারের উদ্যোগ নিলেন।
* আশফাকুজ্জামান: লেখক ও সংগঠক