যেভাবে সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র

৭ মার্চ ১৯৭১: ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

ভীষণ অনিশ্চয়তায় কেটেছে ২৬ মার্চ। সেদিনের মতো এতটা রক্তমাখা সূর্যোদয় হয়তো কখনো দেখেনি এ দেশের মানুষ। তবু এ এক নতুন ভোর। নতুন সূর্য। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সূর্য। আর তাই একাত্তরের ২৬ মার্চ এক কঠিন বৈরী পরিস্থিতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র একটি অস্থায়ী বেতার সম্প্রচার স্টেশন। একাত্তরের ২৬ মার্চ এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ স্বাধীনের পর এ কেন্দ্রের নাম হয় বাংলাদেশ বেতার।

সাতচল্লিশে দেশভাগের পর থেকেই এ অঞ্চলের মানুষ বুঝতে পারে যে সত্যিকার অর্থে পূর্ব বাংলা স্বাধীন হয়নি। সেই থেকেই অধিকার আদায়ের আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সংগ্রামের সূচনা। ২৫ মার্চ রাত থেকে বাংলার জনপদে চলতে থাকে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। নিরস্ত্র বাঙালির লাশের ওপর দাঁড়িয়ে সামরিক জান্তা মৃত্যুর মিছিলকে করেছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।

এদিকে বেলাল মোহাম্মদরা নিরাপত্তা ঝুঁকির জন্য চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র চালু করতে পারেননি। ভাবেন বিকল্প উদ্যোগের কথা। প্রতিটি বেতার কেন্দ্রের একটি ইমার্জেন্সি স্টুডিও থাকে। তখন কালুরঘাট ছিল চট্টগ্রাম বেতারের ইমার্জেন্সি স্টুডিও। বেলাল মোহাম্মদ ও তাঁর সহকর্মীরা এটি ব্যবহারের চিন্তা করেন।

তখন তাঁরা আওয়ামী লীগের কর্মী আনোয়ার আলীর গাড়িতে ওঠেন। রওনা হন কালুরঘাট। আনোয়ার আলী বেলাল মোহম্মদকে একটি সাইক্লোস্টাইল প্রচারপত্র দেন। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।

তখন গাড়িতে আরও ছিলেন চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি কলেজের সহ-অধ্যক্ষ আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, আবদুল্লাহ আল-ফারুক ও ঘোষক কাজী হোসনে আরা। পথ থেকে ওঠেন কবি আবদুস সালাম, ফজল হোসেন, সুলতানুল আলম, মোসলেম খানসহ আরও অনেকে।  

সবাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কালুরঘাট ইমার্জেন্সি স্টুডিওতে আসেন। কালুরঘাট পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। কিন্তু কীভাবে শুরু করা হবে, বেতারের কী নাম হবে, এর কোনো কিছুই ঠিক নেই। লক্ষ্য শুধু একটাই আর সেটা হলো স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা। তবে শুরুতে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের নাম দেওয়া হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। প্রায় সারা দিন চলে যায় প্রস্তুতি শেষ করতে। একাত্তরের ২৬ মার্চের ঘড়ির কাঁটায় তখন সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিট। শুরু হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানের কোরআন তিলাওয়াত করেন চট্টগ্রামের গীতিকার ও কবি আবদুস সালাম। আবদুল্লাহ আল ফারুক পড়েন ইংরেজি খবর। সে অনুষ্ঠানে এম এ হান্নানসহ কয়েকজন  স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। অনুষ্ঠান চলে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। চট্টগ্রাম বেতারের সম্প্রচার ক্ষমতা ছিল ১০ কিলোওয়াট। কালুরঘাট ইমার্জেন্সি স্টুডিও ব্যবহারের সময় ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতাই ব্যবহার করা হয়। পরদিন সকাল সাতটায় পরবর্তী অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ঘোষণা দিয়ে শেষ করা হয় সেদিনের পর্ব।

২৭ থেকে ২৯ মার্চের মধ্যে বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ ও আবদুল্লাহ আল ফারুকের সঙ্গে যুক্ত হন সৈয়দ আবদুস শাকের, রাশিদুল হোসেন, আমিনুর রহমান, শারফুজ্জামান, মুস্তফা আনোয়ার রেজাউল করীম চৌধুরী ও কাজী হাবিব উদ্দীন। এই ১০ জন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী ও পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত। ২৬ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত  এ কেন্দ্রের প্রায় ১৩টি অধিবেশন সম্প্রচার হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে ১০ জন প্রত্যক্ষভাবে সার্বক্ষণিক যুক্ত ছিলেন। কিন্তু সেদিন তাঁদের সঙ্গে আরও অনেকেই সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা-কর্মী, চট্টগ্রাম বেতারের সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক আবদুল কাহার, বেগম মুশতরী শফী, ডাক্তার মোহাম্মদ শফী, চট্টগ্রাম বেতারের আঞ্চলিক প্রকৌশলী মির্জা মনির উদ্দিন, বার্তা সম্পাদক সুলতান আলী, বেতার প্রকৌশলী আবদুস সোবাহান এ ছাড়া দেলোয়ার হোসেন, মাহমুদ হোসেন, আবদুস শুকুর, সেকেন্দার হায়াত খান, হারুন অর রশীদ খান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্নজন বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করেছেন। সেই অবরুদ্ধ সময় বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত প্রায় সবাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। যুগে যুগে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকবে তাঁদের জন্য।

স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের শুরুতে অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় কিছুটা সময় লেগেছে। তাই ঘোষণার সময় প্রথম দিকে অনেকে বলেছেন, বাংলা বেতার, বিপ্লবী বেতার ইত্যাদি।

একটা বেতার কেন্দ্রে যে ধরনের নিরাপত্তা দরকার, তার প্রায় কিছু ছিল না। যাঁরা বেতার প্রকৌশলী মেকানিক ছিলেন, তাঁদের এক অনিশ্চিত জীবনের মুখে পড়তে হয়েছে। যিনি যখন পেরেছেন প্রকৌশলী এনে ট্রান্সমিটার চালু করেছেন, অনুষ্ঠান প্রচার করেছেন। ট্রান্সমিটার ভাবনে এসেছেন। কাজ শেষে দ্রুত চলে গেছেন। কিন্তু সবার লক্ষ্য একটা। সেই মুহূর্তে দেশের জন্য কিছু একটা করা। পরে সৈন্যরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে সবার মধ্যে একধরনের স্বস্তি আসে। এভাবে শুরুতে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র নামে সম্প্রচার চলেছে।

  • লেখক: আশফাকুজ্জামান, লেখক ও সংগঠক