পানকৌড়ি-২

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি সর্বাত্মক জনযুদ্ধফাইল ছবি

পাকিস্তানি সেনাদের হামলার প্রথম দিন থেকেই গ্রামে আর দেখা মিলল না নন্দীর। সবাই ভাবছিল, গণকবরে মনে হয় সে-ও ছিল। প্রায় দিনই তার বৃদ্ধ পিতা হরিশংকরের কান্না ভেসে আসত। মেয়েটাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে মিলিটারি, ছেলেটা নিখোঁজ। সব খুইয়ে একেবারেই দম হারিয়ে ফেলল বৃদ্ধ হরিশংকর। পাশিপাশি বাড়ি হওয়ায় ওর কষ্টটা আমাকে বেশ পীড়া দিত।

বর্ষা তখন ঘন হয়ে আসছে। অঝোরে বর্ষণ হচ্ছিল সেদিন। ভর সন্ধ্যায় দাওয়ায় উঠে এল নন্দী। তাকে দেখে হাসব না কাঁদব, তা–ই ভুলে গেছি। ‘কাকাই খাইবার দাও যা পারো, খিদেয় পেট চিড়ে যাবার লাগছে’—নন্দীর কথায় তন্দ্রা ভাঙল। ভরপেটে খেয়ে দাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়ল।

রাজ্যের প্রশ্ন নিয়ে পাশে বসে রইলাম। রাতের শেষ প্রহরে জেগে উঠল। জানাল এক অদ্ভুত কাহিনি। হামলার দিন কোনোমতে সরে পড়ে সে। গ্রামের শেষ মাথার বাঁশঝাড়ে রাত কাটল। ধ্বংসলীলা দেখে ভোরেই গ্রাম ছাড়ল সে। পথে তার মতো আরও বেশ কয়েকজনের সাক্ষাৎ হলো। সবাই মিলে ভারতের মেঘালয় থেকে অস্ত্র চালানো শিখে তারা এখন একটা দল। দলের নামও বেশ অদ্ভুত—পানকৌড়ি! পানকৌড়ি যেমন এখানে ডুব দিয়ে মুহূর্তে চলে যায় অন্যখানে, তারাও নাকি ঠিক তেমনি। নিজেদের স্থান পাল্টাই আক্রমণের মুহূর্তেই।

বেশ তাড়াহুড়োয় চলে গেল নন্দী। অনেক জিজ্ঞাসা মুখ চেপে তার চলে যাওয়ায় বোবা দৃষ্টি ফেললাম। তার বাবাকে আসার খবর ভুলেও না জানতে দিব্যি দিয়ে গেল। সব আগের মতোই চলছিল। ছুতো খুঁজে রোজ কাউকে না কাউকে নির্যাতনের বলি হতে হয়। বর্ষা গড়িয়ে শীতের বার্তা এল। ইদানীং বেশ সরগরম দেখে যায় উপকূলে। রোজ তাদের বড় জাহাজ থেকে ছোট ছোট নৌকায় এই চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল পাকিস্তানিরা। তবে অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করল দ্রুতই। প্রায় তারা টহলের সময়ে মানুষ আর বোট হারাতে লাগল।

আরও পড়ুন
আনোয়ার হোসেনের তোলা এই ছবিটি হয়ে উঠেছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের প্রতীক। ১৯৭১–এ এটি তোলা হয়েছিল ঢাকার দোহারের একটি গ্রাম থেকে

ভোজবাজির মতো হঠাৎ এসে পড়া গ্রেনেডে জ্বলতে আরম্ভ হলো তাদের নৌকাগুলো। সাঁতরে পাড়ে উঠতে গেলে মরতে হতো পাখির মতো। কোথায় থেকে গ্রেনেড আসে, কোথায় থেকে গুলি! পাগলা কুত্তার মতো অবস্থা হলো পাকিস্তানিদের। অদৃশ্য শক্তির ভয়ে তারা হামলে পড়ল উদয়নগরের ওপর। রোজ কারও না কারও বাড়ি জ্বালিয়ে তৃষ্ণা মিঠাতে আরম্ভ করল তারা। এর মধ্যে নভেম্বর এল।

নভেম্বরে শেষ দিকে। বেশ শীত তখন। কুয়াশার চাদরে গ্রাম ঢাকা থাকে প্রায় দিন। এমনি এক দিনে চুপিচুপি আমার বাড়িতে উঠে এল নন্দী। সাথে চার–পাঁচজন ছেলে। রোদের পোড়া চেহারা থেকে এখনো শিশুসুলভ মায়া যায়নি। নন্দীর মুখে শুনলাম তাদের গল্প। তারাই নাকি পানকৌড়ি। তিন মাস ধরে উপকূলের পাকিস্তানিদের নাস্তানাবুদ অবস্থা তারাই করছে। এখন এসেছে অন্তিম শয্যা তৈরি করতে তাদের। তবে এই কয় মাসের অতর্কিত সব আক্রমণে বেশ দমে গেছে হানাদারেরা। জাহাজ আর উপকূলে ফেলা ক্যাম্প ছেড়ে বের হয় না তারা।

আর রোজ সকালে জাহাজ থেকে গ্রাম ও আশপাশের চারদিকে কামান দাগে। কষ্টটা তাই আগের মতোই আছে উদয়নগরের। এই ভর রাতদুপুরে নন্দী আর তার পানকৌড়িকে দেখে মনের নিভে যাওয়া সব প্রদীপ জ্বলে উঠল। পানকৌড়ির খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করলাম। বেশ গল্প চলছিল তাদের। হানাদারদের দুই ভাগে বিভক্তি বেশ সমস্যার সৃষ্টি করছে তাদের। কীভাবে কী করবে, তার আলাপে রাত গভীর হলো। ক্লান্ত তারা বাকি রাত বেশ আয়েশ করে ঘুমাল।

সেদিন নতুন মাস শুরু হলো। বছরের শেষ মাস ছিল। ডিসেম্বরের প্রথম দিন। বেশ ভোর। কুয়াশায় মনে হচ্ছে তখনো রাত। দুই ভাগ হলো পানকৌড়ি। এক ভাগে দলের সবাই। তারা আক্রমণ করবে উপকূলের ক্যাম্প। আর নন্দী যাবে জাহাজে। কুয়াশাঢাকা নদীর ঢেউ সাঁতরে নিঃশব্দে জাহাজে উঠে মাইন পাতবে সে। বিশাল জাহাজে মাইন পোঁতা লাগবে অনেকগুলো। ধরা পড়ার ভয়ের পাশাপাশি বিস্ফোরণে প্রাণ যাওয়া প্রায়ই নিশ্চিত। ওদের বিদায় করে ঠাকুরঘরে ডুকলাম। নিজের সব সঁপে মায়ের কাছে আরজি জানালাম দেশমায়ের সত্যিকারের সন্তানগুলোর জন্য। কত সময় কাটল জানা নেই। হঠাৎ উপকূল থেকে ছুটে এল গুলোর শব্দ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭১
ফাইল ছবি

মুহূর্তে শুরু হলো কানফাটা আওয়াজ। আরও খানিক পর বেশ বিকট শব্দ এল নদীর বুক থেকে। কুয়াশা ভেদ করে লেলিহান অগ্নিশিখা আকাশ ছুঁতে লাগল। পুরো গ্রাম ছুটে এল পুবের মাঠে। সময় গড়িয়ে সূর্য উঠল আকাশে। কুয়াশা কেটে গেল। গ্রাম ভেঙে পড়ল উপকূলে। ক্যাম্প আছে আগের মতোই! শুধু পুরো এলাকাজুড়ে রক্তের গড়াগড়ি। চোখ ছুটে গেল নদীর বুকে। বিশাল রক্তচক্ষু করে দাঁড়িয়ে থাকা জাহাজের জায়গা ভাসছে তার পোড়া আর ভাঙা সব অংশ। এখানে–সেখানে ভাসছে পোড়া, আধা পোড়া সব লাশ। সে এক বীভৎস দৃশ্য! চারদিকে এ এক ধ্বংসের মহাযজ্ঞ! জীবন এখানে হিসাব মিলাল বিবর্ণ রূপে।

উদয়নগরে ১ ডিসেম্বরের সূর্য উঠল মুক্তির উত্তাপে। নন্দীর দেওয়ার দেশের পতাকাটা উড়িয়ে দিলাম পরম মমতায় বড় বাঁশের মাথায়। বাংলাদেশ শব্দে শ্বাস নিলাম প্রথমবারের মতো। বেলা গড়ার সাথে সাথে গ্রামে প্রাণ ফিরল পূর্ণ জোয়ারে। আমার বয়সী কয়েকজন মিলে নন্দীর সহযোদ্ধাদের খুঁজে বের করলাম। বেশ কয়েকজনকে নামিয়ে দিলাম নদীর কূলে, কয়েকজন নামল নৌকা নিয়ে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না নন্দীকে।

খোঁজায় ক্ষান্ত দিয়ে ফিরল সবাই। মন খারাপের ছায়াছবি সবার মুখজুড়ে। একসঙ্গে শুয়ে আছে পানকৌড়ির সবাই উদয়নগরের মাঠিতে। শুধু নেই সেই মাটির ছেলে নন্দী। উদয়নগরের মাটির ঘ্রাণমাখা নন্দীকে আশ্রয় দিতে না পেরে উদয়নগর তাই তো নিজেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আজ পরিচিত হচ্ছে নন্দীপুর নামে। চৌষট্টি হাজার গ্রামের প্রিয় মাতৃভূমির ভালোবাসায় এভাবে বেঁচে থাকবে নন্দীরা, সময়ের বহমান স্রোতজুড়ে; অস্তিত্বজুড়ে সুভাস ছড়াবে মাটির ভালোবাসার।

সূর্য বাড়ি ফিরেছে আরও অনেক আগে। রমেশ পালের দাওয়ায় বসে রাতের আহার সেরে তখনো স্মৃতিচারণায় মুগ্ধ ভুবন। নন্দীপুরে নন্দীর গল্পে সময় তখন মধ্যরাতের আরও পর। সেদিনের মতো বিদায় জানিয়ে রমেশ পালকে রেখে পথে নামল ভুবন। বাংলার পথ।

এ দেশের প্রতিটি পথ তৈরি হয়েছে লাখো নন্দীর রক্তে রাঙিয়ে। আঁধারে এ পথ হাঁটতে গিয়ে আজ তাই তো ভুবনের চোখ ভিজে ওঠে, মাথা নুয়ে আসে। এ নুয়ে আসা মাথা চিৎকার করে বলে, ভালো থেকো সব পানকৌড়িরা, সব নন্দীরা।

এই কয়েক দিনের আয়োজন ছেড়ে নীড়ের পথ ধরল ভুবন।

ভুবন এসেছিল মায়ের জন্য মাটির গল্প খুঁজতে। মায়ের জন্য এর চেয়ে আর ভালো কোনো মাটির গল্প হতে পারে...?

*নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected]