পানকৌড়ি-১

আনোয়ার হোসেনের তোলা এই ছবিটি হয়ে উঠেছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের প্রতীক। ১৯৭১–এ এটি তোলা হয়েছিল ঢাকার দোহারের একটি গ্রাম থেকে

শীতের মাঝামাঝি। বেশ জাঁকিয়ে পড়ছে শীত এবার। ইট-কাঠের শহরে তেমনটা বুঝতে না পারলেও গ্রামে এসে বেশ কেঁপেই উঠল ভুবন। কতই-বা আর লাগবে ঠান্ডা! এ মনোভাবে পাতলা ব্লেজারটাই শুধু এনেছে সে। ফলস্বরূপ কাঁপাকাঁপির জোয়ার উঠল তার শরীরজুড়ে। অসহ্য ঠান্ডায় অনভ্যস্ত ভুবনের প্রথম রাতটা শীতের রাতের থেকেও দীর্ঘই হলো।

ভোরে যখন সূর্যের আগমনী গানে কুয়াশা কাটতে লাগল, তখনও জবুথবু হয়ে রইল ভুবন। বেলা গড়িয়ে রোদে যখন তেজ ফিরল, তখনই কেবল নড়েচড়ে মানুষ হলো ভুবন। ব্যস্ত কাজের সূচি বাদ দিয়ে গঞ্জের বাজার থেকে মোটা কাপড়ের সোয়েটার আর হাতের কাজ করা চাদর কিনে চিন্তা কমাল। নিজের সঙ্গে কথা দিয়ে আবহাওয়াকে মানিয়ে নেওয়ার দুঃসাহস মন থেকে মুছে ফেলল।

মেহেরাজ উল্লাহ। ভুবনের প্রাতিষ্ঠানিক নাম। প্রাতিষ্ঠানিক কাজেই এ গ্রামে এসেছে ভুবন। স্বনামধন্য একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের ছাত্র। পাশাপাশি সামাজিক অনেক কাজের সঙ্গে জাতীয় এক দৈনিকে খণ্ডকালীন কাজ করে ভুবন। সেই পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার এক প্রবন্ধ তৈরির তথ্যসূত্র সংগ্রহে এ গ্রামে এসেছে ভুবন। উঠেছে নন্দীপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুল মান্নানের বাড়িতে।

চল্লিশোর্ধ্ব আবদুল মান্নান প্রায় ১৫ বছর ধরে শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন এ বিদ্যালয়ে। কোনোমতে টিকে থাকা বিদ্যালয়টিতে শিক্ষক বলতে তাঁকে ঘিরে ওই দু–চারজনই। শত চাহিদার এ যুগে কলুর বলদই–বা কজন খাটে! মহান কাজে হলেও–বা কী! তাই তো গ্রামবাসীর বেশ কষ্টের অল্প আয়োজনে মান্নান সাহেবের মতো মুখ চেপে এই কয়জনই আছেন শুধু। তবু খুশি যে স্কুল তো চলছে। কথায় বলে না—নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালো!

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭১
ফাইল ছবি

নন্দীপুর গ্রাম। নদী উপকূলের অখ্যাত এক গ্রাম। প্রায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন এ গ্রামে বাস করে শ পাঁচেক মানুষ। নদী সংযোগের স্পর্শে অধিকাংশ মানুষের জীবিকা মাছ ধরা। বাকি অল্প কিছু নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে হাল চাষে জীবন চালায় টেনেটুনে। শান্তির এক গ্রাম এই নন্দীপুর। চাহিদার স্বল্পতার ফলে শান্তি প্রচুর। মিলেমিশে সবাই এখানে সবার। যার ফলে অভাব ঘরে এলেও তা ফেরে হাসিমুখে। কেননা নন্দীপুরে সূর্য হাসে সুখের ঝিলিকে।

শীতের জড়তা কাটতেই গ্রামভ্রমণে বের হলো ভুবন। হাসিমুখের মানুষজনের সঙ্গে গ্রামটাও ঝলমল করে হাসছে। পটে আঁকা এক গ্রাম। প্রকৃতি উজাড় করে ভরছে এর রূপভান্ডার। মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেল ভুবনের মন ও মননে। সরল স্রোতে সহজেই জনজীবনে মিশে গেল ভুবন। সখ্য হলো উত্তরপাড়ার বয়োবৃদ্ধ রমেশ পালের সঙ্গে।

বয়সের ভারে নুয়ে পড়া রমেশ স্মরণশক্তিতে এখনো বেশ চনমনে। ভুবনের সঙ্গে বেশ ভাব হলো রমেশের। জীবনপাড়ের ভাঙা–গড়ার গল্প বলছিল রমেশ। বলছিল অনেক গল্প। কষ্টের, আনন্দের কিংবা অনেক কিছুর বা হতাশারও। মনোযোগী ভুবন গেঁথে নিচ্ছিল সব অন্তরজুড়ে। গল্পের পথচলায় উঠে এল জীবনের কথা, যৌবনের কথা। উঠে এল উত্তাল সাগরঘেঁষা এ অজপাড়াগাঁয়ে আছড়ে পড়া স্বাধীনতার উত্তাল ঢেউয়ের কথা। আবেগের উত্তাপ ছড়িয়ে সময়ের গল্প বলে যাচ্ছিল রমেশ পাল...

বুঝলে দাদুভাই, সময় তখন গরমের পর। বর্ষা এসে তখনো পৌঁছায়নি। গ্রামজুড়ে সবাই তখন মাছ ধরার আয়োজনে ব্যস্ত। আমাদের জেলেপাড়া তখন অনেক বড়। পাড়ার সবই ছিল কর্মব্যস্ত। বর্ষা মানে মাছের ভরা মৌসুম। আর এ সময়টা কেউ হেলায় ছাড়তে চায় না। ফলে প্রতিটি ঘরে ছিল প্রস্তুতির মহাব্যস্ততা। এমনই এক দিন ছিল সেটা। হালকা বৃষ্টি ছিল সকাল থেকে। আমরা এক বোটের সবাই তখন জাল ঠিক করছিলাম পুবের মাঠে। হঠাৎ হাঁপাতে হাঁপাতে এল নিতাই মজুমদারের মেজ ছেলে অর্জুন। বড় বড় চোখে বর্ণনা করল বিশাল জাহাজের। জেলেপাড়ার সবারই মোটামুটি চেনা থাকে সব ধরনের জলযান। ওর কাছে জাহাজের খবরে স্তব্ধতা নেমে আসে পাড়াজুড়ে। তত দিনে নন্দীর কারণে দেশের খবরাখবর সবার জানা।

ফাইল ছবি

রোজ সন্ধ্যায় হরিশংকরের দাওয়ায় বসে নন্দীর সদ্য আনা রেডিওতে সবাই শোনে স্বাধীনতার কথা। ঝিম মেরে বসে থাকে সবাই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচারের বর্ণনায় কেঁদে ওঠে তো আবার মুক্তিবাহিনীর সাফল্যে আনন্দে নেচে ওঠে। সবাই বোঝে, একটা কিছু হচ্ছে। পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের বর্বরতার চিত্র তত দিনে তারা জেনে গেছে। মানুষ রূপে এ হায়েনারা যে সব অর্থে জঘন্য, তা জানে জেলেপাড়া। নন্দী পাড়ায় পাড়ায় হেঁটে জাগিয়ে তুলেছে সবাইকে। শুধু জেলেপাড়া নয়, পুরো গ্রামের সবাই এখন মনেপ্রাণে মুক্তি। উদয়নগর তখন উদ্দীপ্ত মুক্তির সূর্য। ও হ্যাঁ, তোমাকে তো বলতে ভুলে গেছি, আমাদের গ্রামের নাম তখন ছিল উদয়নগর।

আমাদের ছোট্ট উপকূলে ভিড়ল জাহাজ। গিজগিজ করে নামল হানাদার। উদয়নগরের সূর্য সেদিন মেঘে ঢেকে গেল। বুলেটে ঝাঁজরা হয়ে গেল গ্রামের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। ঝড়ের বেগে পাল্টে গেল চিত্র। মুক্তির উদ্দীপ্ত সূর্য হঠাৎ মলিন হয়ে পড়ল। জেলেপাড়ার জোয়ান ছেলে প্রায় সবাই মারা পড়ল। গ্রামের বেশ কিছু মানুষকে বেশ তেলতেলে হাসিতে পাকিস্তানি মেজরের সঙ্গে ঘুরতে দেখা গেল। রহিম শেখ, ইব্রাহীম আলী, জোয়ান মর্দ, হরিশংকর, জীবন মণ্ডলসহ গ্রামের অনেকের জোয়ান মেয়ের আত্মবিলাপে কেঁদে উঠল উপকূল।

বিধবা মমতার একমাত্র কিশোরী কন্যা ফাতেমা। ভয়ে আধমরা মেয়েটাকে মমতা লুকিয়ে রেখেছিল গোয়ালঘরে। বাড়ির পাশের রাজ্জাক আলী সেদিন দেখতেই বিলাপ উঠল বিধবা মমতার। সেদিন সন্ধ্যায় ফাতেমার চিৎকার ভেসে এল উপকূল থেকে। রাজ্জাক আলী ছিলেন পাকিস্তানি মেজরের সঙ্গে তেলতেলে হাসি দেওয়া অন্যতম একজন। উদয়নগরকে কেন্দ্র করে চলতে লাগল হানাদারদের ধ্বংসলীলা। জাহাজের পাশাপাশি বেশ কিছু নৌকা নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল তারা উপকূল। গ্রামের বেঁচে থাকা মানুষগুলো বেঁচে রইল মানবেতরভাবে। তার মধ্যে ছিলাম আমি অধমও!

চলবে...

আগামীকাল পড়ুন: পানকৌড়ি-২

নাগরিকে লেখা পাঠতে পারেন [email protected]