সাতচল্লিশে দেশভাগ। তারপর পূর্ব বাংলায় দুঃশাসনে কেটে গলে ২৪ বছর। নিরন্তর সংগ্রাম। তবু ফিরে আসে না শান্তি। তারপর এল ১৯৭০ সাল। এই প্রথম পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। আকাশছোঁয়া বিজয় আওয়ামী লীগের। জাতীয় পরিষদে অধিবেশনের তারিখ ঠিক হলো ৩ মার্চ। সেটা স্থগিত করা হলো ১ মার্চ। এটা ছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত। বিক্ষোভে জ্বলছে বাংলার মানুষ। বঙ্গবন্ধু তখন ঢাকার মতিঝিলে পূর্বাণী হোটেলে সভা করছিলেন। জনসমুদ্রে পরিণত হলো এর চারদিক। উত্তেজিত জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিলেন বঙ্গবন্ধু। ২ মার্চ ঢাকায় হরতাল। ৩ মার্চ সারা দেশে। বঙ্গবন্ধু ডাক দিলেন অসহযোগ আন্দোলনের। আর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণের কথা বললেন। সেখানে ঘোষণা করবেন পরবর্তী কর্মসূচি।
বিক্ষুব্ধ জনতা কোনো কিছুই মানছে না। প্রচণ্ড স্লোগানে কেঁপে কেঁপে উঠছে চারপাশ। পূর্বাণী হোটেলের পাশে ছিল পাকিস্তান এয়ারলাইনসের অফিস। উত্তেজিত জনতা ভেঙে ফেলে এর সাইনবোর্ড। সেখানে তারা লিখে দেয় ‘বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।’ স্লোগান দিতে দিতে যায় গুলিস্তান চত্বর। সেখানে ছিল ‘জিন্নাহ অ্যাভিনিউ।’ সেটাকে করে দেয় ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ।’ সংগ্রাম, ভাঙচুর চলছেই।
সে সময় দেশে ছিল ৬টি বেতারকেন্দ্র। সব কটি বেতার অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। তখন ঢাকার বেতারকেন্দ্র ছিল শাহবাগে। এর নাম ছিল রেডিও পাকিস্তান। ৪ মার্চ এর নাম পরিবর্তন করা হয়। নতুন নাম দেওয়া হয় ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ এদিকে প্রতিদিনই পরিস্থিতি যায় খারাপের দিকে। ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসে সেনাবহিনী। গুলিতে মৃত্যু হচ্ছে মানুষের। ভীষণ অনিশ্চয়তায় কাটছে সময়।
চারদিক থেকে সরে যাচ্ছে আশার আলো। এভাবে এল ৭ মার্চ। সবার কৌতূহল, এদিন কী বলেন বঙ্গবন্ধু। লাখ লাখ মানুষ সেই ভাষণ শোনার অপেক্ষায়। ঢাকা বেতারের কর্মীদেরও দারুণ উৎসাহ।
সরাসরি এ ভাষণ সম্প্রচারে তাঁদের ব্যাপক আয়োজন। এ বিষয়ে বারবার ঘোষণা হচ্ছে বেতারে।
ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দেবেন বঙ্গবন্ধু। তখন বেলা ৩টা ২০ মিনিট। মঞ্চে এলেন বঙ্গবন্ধু। সামনে প্রায় ১০ লাখ মানুষের বিশাল জনসমুদ্র। সেই লাখো জনতার কণ্ঠ থেকে ভেসে আসছে—
তোমার আমার ঠিকানা
পদ্মা মেঘনা যমুনা।
শেখ মুজিবের পথ ধরো
বাংলাদেশে স্বাধীন করো।
বিশাল জনতাকে দুহাত তুলে অভিবাদন জানালেন বঙ্গবন্ধু।
ঠিক সেই সময় এমন একটি ঘটনা ঘটে, যার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। বাংলার মানুষও কল্পনা করতে পারেনি যে এমন কিছু ঘটতে পারে। তখন সামরিক জান্তার এক গণমাধ্যম কর্মকর্তা ছিলেন। এই কর্মকর্তা ছিলেন পাকিস্তান আর্মির এক মেজর। নাম সিদ্দিক সালিক। হঠাৎ তাঁর ডিউটিরুমের টেলিফোন বেজে ওঠে। কর্তব্যরত এক অফিসারকে সিদ্দিক সালিক ইংরেজি ভাষায় একটি বার্তা পড়ে শোনান, যার অর্থ, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ভাষণ বেতারে প্রচার করা যাবে না।
তখন বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক ছিলেন আশরাফ-উজ-জামান। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি সম্প্রচারের জন্য সে সময় তিনি মঞ্চে ছিলেন। আশরাফ-উজ-জামানকে ঢাকা বেতার থেকে হটলাইনে দ্রুত বার্তাটি পড়ে শোনানো হলো। এদিকে শুরু হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। আশরাফ-উজ-জামান একফাঁকে খুব সন্তর্পণে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলেন। ভাষণ প্রচারের নিষেধাজ্ঞার কথা জানালেন। বঙ্গবন্ধু তখনই বেতার ও টেলিভিশনের কর্মীদের উদ্দেশে বললেন, ‘তারা (পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ) যদি আমাদের কথা না শোনে, তাহলে আপনার কেউ রেডিও, টেলিভিশন স্টেশনে যাবেন না।’ বেতারকর্মীরা হটলাইনে আশরাফ-উজ-জামানের কাছ থেকে এ ঘোষণা শুনলেন। এরপর কর্মীরা বেতার থেকে বেরিয়ে যান। তখন কিছু বেতারকর্মী বক্তৃতা মঞ্চে ছিলেন। তাঁরা একটি ছোট মেশিনে সম্পূর্ণ ভাষণ রেকর্ড করেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর শেষ উচ্চারণ ছিল—
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
প্রতিটি বেতারে আলাদা ট্রান্সমিটার বা প্রেরণকেন্দ্র থাকে। কোনো কারণে মূল বেতার থেকে অনুষ্ঠান।
সম্প্রচার করা সম্ভব না হলে প্রেরণকেন্দ্র থেকে সেটা প্রচার করা যায়। তখন সাভার ছিল ঢাকা বেতারের প্রেরণকেন্দ্র। সাভার থেকেও যেন কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করতে না পারে, সেটিও বন্ধ করতে হবে। কিন্তু সে সময় সরাসরি টেলিফোন যোগাযোগ ছিল না। এদিকে ৪টা ৩০ মিনিটে বিকেলের অধিবেশন। মাত্র ১৫ মিনিট সময় আছে। শেষমেশ ট্রাঙ্কলে সাভারের আঞ্চলিক পরিচালককে জানানো হলো, তিনি যেন অধিবেশন চালু না করেন। এভাবে অধিবেশন শুরুর মাত্র পাঁচ মিনিট আগে সাভার থেকেও সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছিল।
সাভারের কর্মীদের বলা হয়েছিল, তাঁরা যেন আবাসিক কোয়ার্টার ছেড়ে চলে যান। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা সে নির্দেশ পালন করেন। সে সময় ঢাকা বেতারকেন্দ্রের বিকেল, সন্ধ্যা ও রাতের সব অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বাঙালি জাতিসহ সারা পৃথিবীর মানুষ দুপুরের পর থেকে ৭ মার্চের পরিস্থিতি জানতে পারেননি।
পাকিস্তান সরকার তখন ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। সে সময় এ অঞ্চলের সেনাপ্রধান ছিলেন রাও ফরমান আলী। দ্রুত তাঁকে ঢাকা বেতার কেন্দ্র চালুর নির্দেশ দেওয়া হয়। তখন খোঁজ করা হয় বেতারকর্মীদের। অনেক চেষ্টার পর রাত ১০টায় পাওয়া যায় আঞ্চলিক পরিচালককে। তাঁকে বেতার চালু করতে বলা হয়।
পরিচালক জানান যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করতে হবে, তা না হলে কর্মীরা বেতারকেন্দ্রে যাবেন না।
রাও ফরমান বুঝতে পারলেন যে কোনো উপায় নেই। তিনি প্রস্তাবে রাজি হলেন। তখন পরিচালক বললেন যে রাতে সবাইকে পাওয়া যবে না। তা ছাড়া অনেক কিছু ঠিক করতে হবে। এর চেয়ে ভালো হয়, ভোর থেকে ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা। এটাও মেনে নিলেন রাও ফরমান। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বেতারকর্মীদের এভাবে যুদ্ধ করতে হয়েছিল।
স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে তখন এটা ছিল প্রথম বিজয়। চলবে..
আশফাকুজ্জামান : লেখক ও সংগঠক