একটি বেতার ও যুদ্ধ জয়ের স্বপ্ন

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
ফাইল ছবি

বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক। সাতচল্লিশে দেশভাগ। একই সঙ্গে স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণ, কিন্তু সত্যিকার স্বাধীনতা আসে না। জীবনে নেমে আসে অন্ধকার, অভিশাপ। পাকিস্তানি শাসকের সীমাহীন অত্যাচার। দুর্বিষহ জনপদের জীবন জীবিকা। সভ্যতার ইতিহাস শোষণ-বঞ্চনার, আন্দোলন-সংগ্রামের। এর কঠিন অভিঘাতে জর্জরিত না হলে মুক্তি আসে না। আর তাই বাঙালি নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখে। মুক্তির আশায় নেমে আসে রাজপথে। তারা একত্রিত হয়। মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। সামনে ভেসে উঠে অনাগত বাংলাদেশের সুন্দরতম মানচিত্র। কিন্তু ক্ষমতালোভী চক্র উপহাস করে সেই মানচিত্রকে।

তারপর একাত্তর পর্যন্ত জুলুমের ইতিহাস। এভাবে একদিন আসে মার্চের সেই ভয়াল রাত। সেটা ছিল একাত্তরের ২৫ মার্চ। সেনানিবাস ছেড়ে শহর অভিমুখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। শুরু করে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যা। এদিকে গ্রেপ্তার হয়ে যান বঙ্গবন্ধু। তবে গ্রেপ্তারের আগেই তিনি বাংলাদেশে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। ২৬ ও ২৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বারবার এ ঘোষণা প্রচার হতে থাকে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, ছোট্ট একটি নাম, কিন্তু কী দুর্বিনীত শক্তি ছিল এই নামের। স্বাধীনতার আজ এত বছর পর সেটা কল্পনা করাও কঠিন। এই কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান শোনামাত্র অনেকে অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি। সে অশ্রু ছিল আনন্দের। গৌরবের। গভীর আত্মবিশ্বাসে উঠে দাঁড়ানোর। এই বেতার দিয়েছিল শত্রুর ওপর আঘাত হানার প্রেরণা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার এক অনন্য ঘটনা। মানুষের মননজগতে সেদিন এই বেতার আলোড়ন তুলেছিল। এক সূত্রে গেঁথেছিল বাঙালির হৃদয়। দেখিয়েছিল ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়। বেতার থেকে ভেসে আসা বাণীতে ছিল মুক্তির আশা।

ভয়াবহ দুঃসময়। সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী বাঙালি। তাদের মনোবল রাখতে হবে অক্ষুণ্ন। তখন এ বেতার ছিল আলোকবর্তিকা। এর এক একটি শব্দ যেন এক একটি বুলেট হয়ে বেরিয়েছে।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ছিল নানা সৃষ্টিশীল অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানমালা স্বপ্ন বুনেছে মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে। সাহায্য করেছে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি এগিয়ে নিতে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখে সাহস জুগিয়েছে এক হার না-মানা অধ্যায় রচনার।

এ কেন্দ্র ছিল যুদ্ধের প্রথম সাংগঠনিক উদ্যোগ। পাকিস্তানিরা ভেবেছিল, যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারবে। তাদের প্রতিরোধ করার যেন কেউ নেই। কিছুই করতে পারবে না বাঙালিরা। কিন্তু সেদিন এই কেন্দ্র প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে হাজির হয়েছিল তাদের সামনে। এখান থেকেই পৃথিবীর মানুষ জেনেছিল বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা। যে ঘোষণা জাতিকে দিয়েছিল এক সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশনা।

ইয়াহিয়া খান লেলিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে। তারা নির্বিচারে হত্যা করছে মানুষ। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি দিশাহারা। চারদিক অন্ধকার। এ যেন মৃত্যুর মুখে নীরব দর্শক। এমন একটা পরিস্থিতিতে পথ দেখিয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।

পাকিস্তানি বাহিনী সব কটি বেতারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। নিতে পারেনি শুধু চট্টগ্রাম কেন্দ্রের। তখন আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রের কর্মী ও স্থানীয় লোকজন মিলিত হন। তাঁরা এক দারুণ সাহসী পদক্ষেপ নেন। সেদিন তাঁরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে দুর্নিবার সাহস ও বীরত্ব দেখিয়েছেন। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতারের অবিনশ্বর ভূমিকার কথা কোনো দিন ভোলা যাবে না। এ দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সেদিন সবার ভাবনা এক করে দিয়েছে। যেকোনো মূল্যে স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

এবার ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে যুদ্ধে। জাতিকে সংগঠিত করা অত্যন্ত জরুরি। বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই মুহূর্তে দিশাহীন বাঙালি সংগঠিত হতে থাকে।

তখন সময় ছিল এমন যে, অনেক খবরই জানা যেত না। আবার জানলেও, অনেক সময় চলে যেত। এমন একটি কঠিন সময় এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। তারপরও সেদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের খবর দ্রুত দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়েছিল। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নির্লজ্জ মিথ্যাচার করত। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এ কেন্দ্র বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পরই বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ পৃথিবীর বহু বেতার কেন্দ্র এই সংবাদ প্রচার করেছিল। এসব কেন্দ্রে থেকে বলা হয়েছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান একটি ‘একটি গুপ্ত/ গোপন বেতার’ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণ করেছেন। সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন ইত্যাদি। সেদিনের সেই গুপ্ত ও গোপন বেতার হলো ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।’ এই বেতার কেন্দ্র তখন দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্বাধীনতাসংগ্রামের পুরো সময় ধরে প্রতিরোধ আর প্রতিশোধের শক্তি জুগিয়েছে বাংলার নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধাদের। ২৫ মার্চ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল এ কেন্দ্র। প্রথম এই বেতারই পাকিস্তানি স্বৈরশাসককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। এর কণ্ঠযোদ্ধারা প্রচণ্ডভাবে ভেঙে দিয়েছিলেন ইয়াহিয়ার দম্ভ। একই সঙ্গে পৃথিবীকে আহ্বান জানিয়েছিলেন বাংলাদেশকে তাৎক্ষণিক সমর্থন, স্বীকৃতি ও সহযোগিতা দিতে।

স্বাধীনতাযুদ্ধের নয় মাস ধরে যুদ্ধ জয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিল এই বেতার কেন্দ্র। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা অমর হয়ে থাকবে। মানবসভ্যতায় আর কোনো বেতার কেন্দ্র এত বড় ভূমিকা রেখেছে বলে জানা নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে এর ভূমিকা।

  • আশফাকুজ্জামান, লেখক ও সংগঠক