রমজানে বাজারের বাজারে উত্তাপ কমান
পবিত্র মাহে রমজান কাল শুক্রবার থেকে। রমজান মাস গোটা বিশ্ববাসীর জন্য নিয়ে আসে শান্তির বার্তা। কিন্তু সংযমের এ মাসেও এ দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের লোভাচ্ছন্ন ও অসংযমী আচরণে নিত্যপণ্যের বাজার হয়ে উঠে অসহনীয়। নাজাতের মাস পরিণত হয় অস্থিরতার মাসে। অথচ ইসলামে অতিরিক্ত মূল্য আদায় কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। ইসলামের আত্মসংযমের শিক্ষাকে মসজিদ থেকে বের করে এনে আমাদের প্রাত্যাহিক জীবন রাঙাতে পারি না। তাই যদি না হবে, তবে প্রতিটি রমজান এলেই দেশের নিত্যদ্রব্যের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির আগুন জ্বলে কেন? কারা সৃষ্টি করে এসব কৃত্রিম সংকট? যাঁরা এসবের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা তো আর ভিনগ্রহের কেউ নন। তাঁরাও কিন্তু রমজান মাসে মসজিদে যান!
পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত দেশ এমনকি ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো রমজানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ব্যবসায়ীরা তাঁদের পণ্যের মূল্যকে সহনীয় রাখেন৷ শুধু তা–ই নয়, ওইসব দেশে রমজান এলেই নিত্যপণ্যের ওপর ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার উৎসব চলে৷ আর আমাদের দেশে পুরো উল্টো চিত্র! রমজান এলেই দেশে নিত্যদ্রব্যের দামের আগুনে ঝলসে যায় মধ্য ও নিম্নবিত্তের প্রাণ! বাংলাদেশের এই দৃশ্য নতুন নয়, রমজান এলেই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য যেন সংযমের কোনো বাধাকেই মানতে নারাজ। বাজারে এমন অস্থিরতার পেছনে ডলার সংকটে এলসি না খুলতে পারা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে সংকটসহ নানা অভিযোগ করা হয়। এসব অভিযোগ যেমন সত্য তেমনি কৃষক তাঁর পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, কৃষিজমিতে উৎপাদিত পণ্য বিভিন্ন মাধ্যম হয়ে বাজারে আসার পর বর্ধিত মূল্যে বিক্রি করতে হয়, এসবও সত্য। অর্থাৎ, দ্রব্যমূল্যের যে আগুনে ভোক্তাদের পুড়তে হয়, তার উপযুক্ত লভ্যাংশ কিন্তু কৃষক পান না। পণ্যবাহী ট্রাক নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সময় পথিমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। বছরের পর বছর এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে কেন সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে না? পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির এসব সুস্পষ্ট কারণ কি সরকারের দৃষ্টগোচর হয় না? তা ছাড়া বাড়তি মূল্য পাওয়ার আশায় পণ্য মজুত করে রাখার মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। এসব কৃত্রিম সংকট তৈরি কে বা কারা করে, তা কি সরকার জানে না? যে চক্রই মানুষের তথা সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন পেটের আহারে অমানুষিক পন্থায় লাথি মারে তাদের এসব কর্মকাণ্ড ভণ্ডুল করার চ্যালেঞ্জ সরকারকে নিতেই হবে৷ সরকারকে মনে রাখতে সাধারণ মানুষের পেটের ক্ষুধা মিটাতে ব্যর্থ হলে হাজারো উন্নয়নও সফল হবে না।
বাজারে অগ্নিমূল্যের পেছনে দৃশ্যমান কারণ হিসেবে সিন্ডিকেট চক্র দায়ী হলেও ক্রেতাসাধারণেরও কিছু দায় থেকে যায়। অনেকে সারা মাস বাজারে না গিয়ে রমজানের আগেই সব বাজার একসঙ্গে করে ফেলার মানসিকতা রাখেন৷ এতে করে বাজারের ওপর চাপ বাড়ে৷ আর আপনার একসঙ্গে পুরো মাসের বাজার করার সুযোগটিই নেয় মজুতদার চক্র। যেহেতু তারা অল্পসময়ে অধিক পণ্য বিক্রির গ্যারান্টি পেয়ে যায়, সেহেতু তারাও পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে এই সুযোগে মজুতকৃত পণ্যগুলো বাজারে ছাড়ে। এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দিন এনে দিন খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষগুলো। একজন ক্রেতা হিসেবে অন্য ক্রেতার কথা চিন্তা না করে আপনিও যে সিন্ডিকেটের সহযোগী হয়ে যাচ্ছেন, ভেবেছেন কখনো? সংযমী হওয়ার এই মাস নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের শিক্ষা দেয়। কিন্তু দীর্ঘ রমজানজুড়ে আমরা সংযমের যে শিক্ষা গ্রহণ করি, তার প্রভাব দেশের বাজারে কেন পড়ে না? এক সময় কোনো একটি পণ্যের দাম বছরে কিংবা ছয় মাসে একবার বাড়ত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে নিত্যদ্রব্যের দাম মাসভিত্তিকও আর বাড়ছে না। এখন নিত্যদ্রব্যের দাম প্রতি সপ্তাহ, প্রতিদিন, এমনকি সকালের দাম সন্ধ্যায়ও বাড়েছে। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, চিনি, খেজুর, বিভিন্ন বিদেশি ফল, মাংসসহ দাম বাড়েনি এমন পণ্য পাওয়াই এখন দুষ্কর। গরু কিংবা খাসির মাংস নিম্নবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তেরও নাগালের অনেক বাইরে৷ পোলট্রি মুরগির মাংসের দাম ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলছে৷ পোলট্রি মুরগির মাংস এ দেশের মানুষের আমিষ পূরণের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল ছিল৷ সেটিও এখন ২০০-২৪০ টাকায় উঠা নামা করছে! গরু-খাসির মাংস ১০০ গ্রাম, ১৫০ গ্রাম, ২৫০ গ্রাম করে ভাগা দিয়ে বিক্রি হচ্ছে। বাজারদর কতটা বেসামাল হলে এসব দৃশ্য এখন বাস্তবতা হয়ে উঠেছে, ভাবা যায়! সব মিলিয়ে রমজান শুরু হওয়ার আগেই নিত্যদ্রব্যের বাজারের আগুনে সাধারণ ক্রেতাদের ত্রাহি অবস্থা৷ এই যদি নতুন করে রমজান কেন্দ্রিক সিন্ডিকেট চক্র দামের ওপর ঘি ঢালার পাঁয়তারা করে, তাহলে সাধারণ মানুষের রমজানের সিয়াম সাধনা যে বিভীষিকায় পরিণত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ এই ত্রাহি অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় সরকারের হাতে কি নেই?
পরিশেষে বলব, মাহে রমজান শুধু আত্মশুদ্ধির মাসই নয়, সঙ্গে সঙ্গে আত্মসংযমেরও মাস। দীর্ঘ ১১টি মাস কীভাবে সংযমের সঙ্গে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনে পূর্ণতা লাভ করা যায়, তারই প্রশিক্ষণ দেয় এই রমজান মাস। তাই রমজানের শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্রকে হতে হবে জনকল্যাণমুখী আর ব্যক্তিকে হতে হবে পরার্থের জন্য নিঃস্বার্থ প্রাণ৷
*লেখক: তৌহিদ বিল্লাহ, সাবেক শিক্ষার্থী, নরসিংদী সরকারি কলেজ