পবিত্র রমজানেও কি বাজারদরে আগুন লেগেই থাকবে

বাজারদর

পবিত্র রমজান মাস সিয়াম সাধনার মাস। এ সময় নানাবিধ পবিত্র আয়োজন শুরু হয়, শেষ হয় ঈদ আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে। সারা দিন রোজা রেখে ইফতার ও ভোররাতের সাহ্‌রির খাবারদাবার—সবকিছু খুবই যত্নসহকারে ঠিকঠাক রাখতে চান মুসলমানরা। এ জন্য দরকার ক্রয়সীমার মধ্যে নিত্যপণ্যের দরদাম। এখন চাল থেকে শুরু করে আলু, ডাল পর্যন্ত এত দাম হাঁকিয়ে বসে আছেন আড়তদার, মধ্যস্বত্বভোগী ও খুচরা বিক্রেতারা, সেখানে জনগণ যেন পাঁঠার বলি হচ্ছে সর্বদা।

যতটা না আয়-রোজগার বেড়েছে, তার ৯ গুণ বেড়েছে জীবনযাত্রা চলাচলের ব্যয়। এ দায় কে বা কারা নেবে?  সবাই যেন নির্বিকার। দেখেও দেখে না আর শুনেও যেন শোনে না। কোনো ভেতরকার সমস্যা শনাক্ত না করে উচ্চ মহলে শোনা যায়, পৃথিবীতে যুদ্ধের দামামায়, মহামারির কারণে এ নাকাল অবস্থা। কিন্তু তার আগেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির রেসের ঘোড়ার দৌড় কোনো অংশে কম ছিল না। সরকারি তদারকি, দায়িত্বশীলতার অভাবে প্রতিনিয়ত তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

উপরন্তু অন্যান্য সেক্টরেও একটা মধ্যম আয়ের দেশে নেই গাড়ি ভাড়ার কোনো নির্দিষ্ট নিয়মকানুন, থাকলেও তা মানা হয় না ৯০ শতাংশই। ডিজেল, অকটেন, পেট্রল, এলপি গ্যাস—সবকিছুর দাম এখন আকাশছোঁয়া। ডলারের দাম বাড়ছে, যেন পুরো পৃথিবীটা ডলারই নিয়ন্ত্রণ করছে। একপেশে রাজনীতির মতো অর্থনৈতিক বিষয়গুলোও যেন এককাতারে চলতে শুরু করেছে। আইনকানুন হয়, কিন্তু তা মানার বালাই নেই। ১ টাকা দিলে ‘হ্যাঁ’ বলে আর ১০ টাকা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ‘হ্যাঁ’কে ‘না’ বলে দিতে কোনো দ্বিধা-সংকোচ করে না এ দেশের একশ্রেণির নিম্নরুচির মানুষের।

এদিকে আবার শহর ও গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মানের বৈষয়িক বিষয়াবলি ভিন্নতর। গ্রামের মানুষের হয়তো বাসাভাড়া লাগে না, নিজ ঘরে প্রায়ই মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই পায়। কিন্তু শহরের মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা অস্থায়ী বাসায় প্রতি মাসে ভাড়া গুনতে হয় আকাশছোঁয়া। গ্রামে লেখাপড়ার খরচ, খাবারদাবার, চিকিৎসাসহ অন্যান্য খরচ কম, এখন সেটাও নাগালের বাইরে। কেবল নিজ বাড়িতে বিনা খরচে থাকার নিশ্চয়তাটুকু আছে।

শহরে বসবাসকারীদের ভাড়া বাসা থেকে নিত্যদিনের খাদ্যদ্রব্য জোগাড় করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করতে নিদারুণ হিমশিম খেতে হচ্ছে। আট সদস্যবিশিষ্ট পরিবারে মাসিক ৫০ হাজার টাকা বেতনেও যেন সংসার চলে না। বেতন তো বাড়ে না, কিন্তু খরচ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের আর্থিক ও মানসিক চাপ থাকে প্রচুর। তারা না পারে কাউকে কিছু বলতে বা চাইতে, অন্তত চাল, ডাল, ডিম, সবজি, ছোলা ও মুড়ির দাম কমালেও তাদের রোজা পালন করা অসুবিধা হয় না। মাছ, মাংস, ফলফলাদি ও দুধের কথা বাদই দিলাম। গরিবদের এত পুষ্টির খাবারের গন্ধও যেন নিতে নেই।

সরকারি তদারকি ও দায়িত্ব এখন নিম্নবিত্ত, দিনমজুর ও মধ্যবিত্তের জন্য রেশনিং পদ্ধতি চালু করা। এটি হতে হবে জাতীয় নীতিমালার একটি শক্তশালী পদক্ষেপ। এতে কোনো আপস নয়। সরকার যখন প্রান্তীয় পর্যায় থেকে ধান, চাল, ডাল কিংবা কৃষিজ উৎপাদিত দ্রব্যাদি কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে কিনে নিয়ে স্টক করবে, তখন আড়তদার কিংবা মধ্যস্বত্বভোগীরা আর কোনো বাড়তি সুযোগ নিতে পারবে না। এতে খুচরা বাজারও নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে।

প্রতিটি দোকান, বাজারে নির্দিষ্ট বিক্রয়মূল্যের তালিকা ঝুলিয়ে দিতে হবে, যা হবে শহর কিংবা গ্রামে এক ও অভিন্ন। বাড়তি মজুতের খরচ সরকারি অর্থসহায়তা বা ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে সামঞ্জস্য করতে হবে। বন্যা, খরা কিংবা অতিবৃষ্টি, মহামারি পরিস্থিতি, বিশ্বের নানা জায়গা, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করলেও সততাসংবলিত নীতিতে অটল থাকলে তা একটি দেশের জনগণকে সুখে-শান্তিতে রাখতে সহায়তা করে। সমস্যা থাকবে,  তবে তার সমাধানও আছে। কিন্তু সমস্যাকে আশকারা দিয়ে জনগণকে চাপে ফেললে তা জাতীয় উন্নয়নকে চরম বাধাগ্রস্ত করে।

গণতান্ত্রিক দেশে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। তারা সুখের দেখা পেলে অরাজকতা, দলাদলি আর বৈষম্য অনেকটা কমে যাবে। নির্ভাবনায় অল্প খেয়েপরে চলেও এ দেশের মানুষ শান্তির পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে। তাহলে কি এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের অধিকার নেই যে সামনের রোজার দিনগুলো সাধ্যসীমার মধ্যে অল্প খরচে জীবন যাপন করার?

ঈদ এলে কি ইচ্ছা হয় না যে নতুন জামাকাপড় কিনে দিয়ে সন্তান, মা-বাবা, ভাই-বোনদের মুখের প্রশান্তির হাসি দেখার? বিষয়গুলো খুব সাধারণ এবং তা ক্রয়সীমার মধ্যে থাকলে কেন দেশের মানুষ শান্তি পাবে না? এতটুকু আশা করা কি এ দেশের মানুষের অন্যায্য, অন্যায় চাওয়া?

দ্রব্যমূল্যের অচিরেই দাম কমানো হোক। শান্তিতে মানুষ পবিত্র রমজানসহ সারা বছর সুখে থাকুক। বিশ্বের অন্যান্য দেশে রমজান এলেই প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যছাড় দেওয়া হয় মহান আল্লাহর কৃপা ও সওয়াবের উদ্দেশ্যে। এ দেশেও যেন এই মহৎ মানবিক সংস্কৃতির চালু হয়, এ কামনা করি।

লেখক: পারভীন আকতার, শিক্ষক, কবি