বাকৃবির জীর্ণ দেয়াল ফিরে পেল প্রাণ, ২৪-এর বিজয় স্লোগান আর গ্রাফিতি
শ্রাবণের ঘন কালো মেঘ যখন মাথার ওপর জমেছে, মুষলধারে বৃষ্টিতে আমলকীর চিরল পাতায় জলধারা ঝরছে। বৃক্ষের কাণ্ডের শিখরে কচি পাতার রং হয়ে উঠেছে গাঢ় সবুজ। শ্রাবণের সিক্ত বাতাসে মধুর কণ্ঠে পাখিরা গান গায়। এমন পরিবেশে একদল মানুষ পুরোনো গানের সুরে আয়েশে ব্যস্ত গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে। অন্যদিকে আরেক দল সাহসী তরুণ দেশগঠনের অঙ্গীকারে সবকিছু উপেক্ষা করে রংতুলিতে ব্যস্ত রহস্যময় স্বপ্নলিপিতে বিশ্ববিদ্যালয় সাজাতে। যাঁরা কিছুদিন আগেও ছিলেন মোবাইলে আসক্ত, ডাকা হতো অপদার্থ, আজ তাঁদের হাতে স্বপ্ন বুননের রংতুলি। বলছি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) চিত্রাঙ্কন এবং ক্যালিগ্রাফিপ্রেমী শিক্ষার্থীদের কথা।
রংতুলিতে তাঁরা আঁকছেন বুকের ভেতর জমে থাকা বিজয়ের গল্প, দেশ সংস্কারের বিপ্লবী স্লোগান, সূর্যোদয়ের বাংলাদেশ এবং আবু সাঈদের সাহসী বুক। পুরোনো দেয়ালে রঙের মিশ্রণে ফুটে ওঠা সাহসী স্লোগানে বিকেলের আবির মেখে প্রকৃতিকন্যা বাকৃবি সেজেছে চিরচেনা অপরূপ যৌবনে, যা বেশ মনোমুগ্ধকর।
কিছুদিন আগেও যে দেয়াল ছিল নোংরা, নানা পোস্টারে ছিল প্রাণহীন, আজ তা ঘষে-মেজে ফুল, পাখি, সাম্য, প্রতিবাদ ও বিপ্লবী স্লোগান এবং সূর্যোদয়ের ছবিতে ফিরে পেয়েছে তার জৌলুশ। নিঃসন্দেহে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। এ ধরনের চিত্রকর্ম আমাদের উজ্জীবিত করে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্বিগুণ শক্তি জোগায়। মূলত এটি ছাত্র-জনতার সংগ্রামের বিজয়ের গল্পকে প্রতিনিধিত্ব করে। স্মরণ করিয়ে দেয় বৈষম্যহীন দেশগঠনের কারিগর আবু সাঈদ, আদনান, রাফি, মুগ্ধসহ শহীদ বীরদের মুখ।
পথিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে কখনো বিপ্লবী স্লোগান দেখে শিকল ভেঙে উল্লসিত হয়ে পানি পান করতে চাইবেন, কখনো ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে গিয়ে ছাদে হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ হবেন। হয়তোবা ছেলেহারা মায়ের আর্তনাদ শুনে নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেলবেন। বলছি হাজবেন্ড্রি করিডর, কামাল রণজিৎ মার্কেট এবং কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির পার্শ্ববর্তী ভবনজুড়ে থাকা বিজয়ের নানা গ্রাফিতি ও ক্যালিগ্রাফির কথা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে হাজবেন্ড্রি করিডরে দেয়ালে লেখা হয়েছে ‘৩৬শে জুলাই’, যা মূলত ৫ আগস্টকে ইঙ্গিত করে। এ ছাড়া সেখানে শোভা পাচ্ছে ‘আমার বাংলায় সাম্প্রদায়িকতার ঠাঁই নাই,’ ‘মুগ্ধের ভারী বার্তা—পানি লাগবে, পানি?’ বিজয়ের প্রতীক মুষ্টিবদ্ধ হাতের চারপাশে লেখা, ‘৫২ দেখিনি, ২৪ দেখেছি’।
এবার একটু হেঁটে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের সম্মুখে প্রিয়তমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে চোখ আটকে যাবে দেয়ালের গ্রাফিতিতে। চিরসবুজ বাংলায় শহীদ মিনারের পেছন দিয়ে উদীয়মান নতুন সূর্যের সাক্ষী হতে সুউচ্চ স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা হাতে এক যুবক, তাঁর পাশে ছয়জন বিবেকবান শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর চোখ বাঁধা লাল ফিতায়।
এখান থেকে একটু সামনের দিকে এগিয়ে গেলে দেখতে পারবেন হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে নিহত শিশু যোবিয়াত হোসেন ইমনের নির্মম মৃত্যুর দৃশ্য, যা আপনার বুকে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করবে। তার পাশেই রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রের ভেতর এক যুবকের হাতে উড়ন্ত বাংলার পতাকা, ‘Free Palestine’ , শিকল ভাঙার গ্রাফিতি এবং একজন পুলিশ সদস্যের জনতার দিকে গুলি ছোড়ার ভঙ্গিতে তাঁর পাশে লেখা, ‘গুলি করি মরে একটা, একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না’।
কয়েক দিন আগেও যেখানে আরবি ক্যালিগ্রাফি করা নিষিদ্ধ ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার্স পরিষদের ভবনে শোভা পাচ্ছে একজন পথচারীকে আকৃষ্ট করার ভঙ্গিতে দৃষ্টিনন্দন ক্যালিগ্রাফি। ওই ক্যালিগ্রাফি করেছেন মো. সিয়াম আহম্মেদ। ‘এ ধরনের চিত্রকর্ম আমাদের সংগ্রাম এবং ভয়কে জয় করার প্রতীক। এবারের আন্দোলনে আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি, স্বৈরাচারীদের এ দেশে কোনো জায়গা নেই। রাজপথে আপনি বন্ধুহীন নন, যাঁদের আপনি দেখেন, তাঁরাই আপনার আসল সহযোদ্ধা,’ জানান মো. সিয়াম আহম্মেদ।
*লেখক: মো. রিয়াজ হোসাইন, শিক্ষার্থী
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]