প্রকৃ‌তিকন‌্যা বাকৃ‌বি ৬৪ বছ‌রের স্বপ্নযাত্রা

শিক্ষা মানু‌ষের অন্ত‌র্নিহিত শ‌ক্তি‌কে জা‌গি‌য়ে কুসংস্কারমুক্ত শি‌ক্ষিত জা‌তি গঠ‌নে সাহায‌্য ক‌রে।

অন‌্যদি‌কে দেশ‌কে উন্নয়‌নের বিকাশ চলমান র‌ে‌খে উদ্ভুত সমস‌্যালব্ধ ফলাফ‌লের মাধ‌্যমে বিশ্বের মডেল হ‌তে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বাংলা‌দেশ কৃ‌ষিপ্রধান দেশ। এ দে‌শের প্রায় সিংহভাগ লোকজনের রু‌টি‌রোজগার সরাস‌রি কৃ‌ষির ওপর নির্ভরশীল। বি‌শেষ ক‌রে গ্রামীণ জনপ‌দের লোকজনের কৃ‌ষিকে কেন্দ্র ক‌রেই তাঁদের জীবন ও জী‌বিকা। ফলশ্রু‌তি দেশের কৃষির উন্নয়ন, গবেষণা ও শিক্ষা  উন্নয়‌নের জন‌্য মানসম্মন কৃ‌ষি‌বিদ, প্রাণিবিজ্ঞানী, প্রযু‌ক্তি‌বিদ এবং প্রকৌশলী তৈরি করার জন‌্য ১৯৬১ সা‌লে ১৮ আগস্ট ময়মন‌সিং‌হের ব্রহ্মপু‌ত্রের কোল ঘেঁষে পশ্চিম তীরে ১ হাজার ২০০ একর জায়গায় প্রতি‌ষ্ঠিত হয় বাংলা‌দেশ কৃ‌ষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃ‌বি), যার মোট ছয়টি অনুষদে ৪৩টি বিভাগ রয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ‌্যালয় থে‌কে ৮টি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত ৫৫ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীকে ডিগ্রি দিয়েছে। বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ৬ হাজার ১৯৯ জন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ৫৮৭ জন র‌য়ে‌ছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছেলেদের ৯টি ও মেয়েদের ৬টি আবাসিক হল র‌য়ে‌ছে।

টাইমস হায়ার এডু‌কেশন এশিয়ার বিশ্ববিদ‌্যালয়গু‌লোর তা‌লিকায় বাকৃ‌বির অবস্থান ৩৫১-৪০০তম। এ ছাড়া ও‌য়েবমে‌ট্রিকস বিশ্ববিদ‌্যাল‌য়ের তা‌লিকায় বাকৃ‌বির অবস্থান ১৮৪৩তম। বিশ্ববিদ‌্যাল‌য়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থে‌কেই দে‌শের কৃ‌ষিবিজ্ঞান ও কৃ‌ষি গ‌বেষণার ক্ষে‌ত্রে উল্লেখযোগ‌্য অবদান রে‌খে চল‌ছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি নানা চ্যালেঞ্জ ও সুযোগের সম্মুখীন হলেও বর্তমানে এটি কৃষিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হ‌য়ে উঠেছে। দক্ষ কৃ‌ষি‌বিদ‌দের অক্লান্ত প‌রিশ্রমে বাংলা‌দেশ আজ খাদ‌্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জনসংখ‌্যা বৃ‌দ্ধির সঙ্গে খাদ‌্য উৎপাদন বে‌ড়ে‌ছে ক‌য়েক গুণ। সম‌য়ের সঙ্গে তৈরি হ‌য়ে‌ছে অধিক উৎপাদনশীল ফস‌লের বীজ, প‌রি‌বেশবান্ধব কীটনাশক, লবণাক্ত স‌হিষ্ণু ফসল, প্রা‌ণিজ ভ‌্যা‌কসিন, উন্নত সংকরণ প্রাণী, রোগ প্রতি‌রোধক্ষম উৎপাদনশীল মাৎস‌্য, জি‌নোম সি‌কো‌য়েন্স, কৃ‌ষি প্রযু‌ক্তিসম্পন্ন আধু‌নিক যন্ত্রপা‌তি এবং আধু‌নিক কৃ‌ষি নী‌তিমালা ইত‌্যা‌দি। বর্তমা‌নে বাকৃবির হাজারো দক্ষ কৃ‌ষি‌বিদেরা কৃ‌ষি খাতে নি‌জে‌দের সম্পৃক্ত ক‌রে দে‌শে কৃ‌ষি উন্নয়‌নে কাজ ক‌রে যা‌চ্ছেন। ১৮ আগস্ট বাংলা‌দেশ কৃ‌ষি বিশ্ববিদ‌্যালয় (বাকৃ‌বি) ৬৩তম প্রতিষ্ঠাবা‌র্ষিকী। একই সঙ্গে ৬৪তম প্রতিষ্ঠা দিবস।

বিশ্ববিদ‌্যাল‌য়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছয়টি অনুষদের সাম্প্রতিক সম‌য়ে গবেষণা কার্যক্রমের কিছু সাফল্য তুলে ধরা হ‌লো, যা দেশের কৃষি খাতের ওপর ব‌্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বাংলা‌দেশ কৃ‌ষি বিশ্ববিদ‌্যালয় উৎপাদনশীল, রোগ প্রতি‌রোধক্ষম, লবণাক্ত ও খরাস‌হিষ্ণু এবং জলবায়ু সহনশীল ধান, শর্ষে, কুল, সয়াবিন, আলু, আম, লিচু, কচুর মুখিসহ বেশ কিছু ফসলের কয়েকটি করে উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। এর ম‌ধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাউধান-৬৩, বাউধান-২, বাউধান-৩; বাউকুল: সম্পন্ন ও সম্বল; শর্ষে: বাউ- এম/৩৯৫, বাউ-এম/৩৯৬; অল্টারনারিয়া ব্লাইট রোগ প্রতিরোধী বাউ-শর্ষে-৪, বাউ শর্ষে-৫, বাউ-শর্ষে-৬; সয়া‌বিন: ডেভিস, ব্র্যাগ, সোহাগ, জি-২ ও বিএস-৪; আলুর জাত: কমলা সুন্দরী ও তৃপ্তি; কচুর মুখি: লতিরাজ, বিলাসী ও দৌলতপুরী জাত; কলা ও আনারস উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি,  মি‌ষ্টি আলু: বাউ মিষ্টি আলু-৪, বাউ মিষ্টি আলু-৫, বাউ মিষ্টি আলু-৬; রাইজোবিয়াল জৈব সার উৎপাদনে প্রযুক্তি, সয়েল টেস্টিং কিট, সৌরতাপের সাহায্যে পাট ও ধান বীজের ফাংগাস আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, অ‌্যা‌রো‌বেক পদ্ধ‌তি‌তে ধান চাষ প্রযুক্তি, শুক‌না পদ্ধ‌তি‌তে বো‌রো ধান চাষ, অঙ্গজ প্রজনন এবং জিন সংরক্ষণ পদ্ধ‌তি প্রভৃ‌তি। এ ছাড়া বাকৃ‌বির গ‌বেষকেরা অন‌্যান‌্য প্রতিষ্ঠা‌নের সঙ্গে গ‌বেষণা ক‌রে ব্রি-ধান, ব্রি-গম, ব্রি-আলু, ব্রি-ট‌মে‌টো ইত‌্যা‌দি আবিষ্কার ক‌রে‌ছে। সাম্প্রতি অধ্যাপক মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন দেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের মাটির স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য নতুন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে, যা মাটির পুষ্টি উপাদানের স্তর উন্নয়ন এবং বিভিন্ন সারে মাটির প্রতিক্রিয়ার গবেষণার লব্ধ ফলাফল কৃষককে সঠিক পদ্ধতিতে সারের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবে, যা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করবে এবং কৃষির টেকসই উন্নয়ন সাধনে সহায়ক হবে। প্রা‌ণিসম্পদ উন্নয়‌নের জন‌্য বাকৃ‌বি গ‌বেষকরা আবিষ্কার ক‌রে‌ছে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউক্যাসল রোগের টিকা, ফাউল ক‌লেরার টিকা, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন, প্রাণীর সাশ্রয়ী মানসম্মত পু‌ষ্টিকর খাদ‌্য প্রস্তুত, কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তির উন্নয়ন, ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন এবং ক্লোনিং প্রযু‌ক্তি, গবাদিপশুতে অ্যান্টিবায়োটিকের পরিবর্তে প্রোবায়োটিক উন্নয়ন, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য জেনেটিক মডিফিকেশন এবং ক্রস-ব্রিডিং প্রযু‌ক্তি, রোগ নির্ণয়ের জন‌্য ডায়াগন‌স্টিক কীট ও জে‌নে‌টিক টে‌স্টিং প্রযু‌ক্তি, পরজী‌বী নিয়‌ন্ত্রণের জন‌্য প‌্যারাসাইটিক কীট, অ‌্যা‌ন্টিভাইরাল ওষ‌ুধের উন্নয়ন, ম‌লিকুলার পদ্ধ‌তি উন্নয়ন, গো-খা‌দ্যের মোলা‌সেস ব্লক আবিষ্ক‌ার, গরুর ওলান ফুলা রোগ প্রতি‌রোধ পদ্ধ‌তি, হাওরাঞ্চ‌লে হাঁস পালনের পদ্ধ‌তি ইত‌্যা‌দি।

মৎস‌্য উন্নয়‌নের জন‌্য বাকৃ‌বির গ‌বেষকেরা দে‌শি মা‌ছের কৃ‌ত্রিম প্রজনন পদ্ধ‌তি, জাত উন্নয়ন, হাইব্রিড তেলা‌পিয়া ও মাগুর মাছ আবিষ্কার, কার্প মা‌ছের বংশবিস্তার পদ্ধ‌তি, প‌রি‌বেশবান্ধব পদ্ধ‌তি‌তে মাছ চাষ, জি‌নোম সি‌কো‌য়েন্স আবিষ্কার, টিকা আবিষ্কার, জিন সংরক্ষণ, খাঁচায় মাছ চাষ পদ্ধ‌তি, মিশ্র পদ্ধ‌তি মাছ চাষ, পাঙা‌শের কৃ‌ত্রিম প্রজনন পদ্ধ‌তি, ধান খে‌তে মাছ চাষ পদ্ধ‌তি, শুক্রাণু সংরক্ষণ, ম‌লিকুলার পদ্ধ‌তি, মা‌ছের খা‌দ্যের জন‌্য ব্লাক সোলজার চাষ, র‌টিফায়ার পদ্ধ‌তি‌তে পোনা চাষ, মা‌ছের জিন প‌রিবর্তন ইত‌্যা‌দি আবিষ্কার ক‌রে‌ছেন। বাকৃ‌বি কৃ‌ষি অর্থনী‌তি গবেষকেরা কৃ‌ষি অর্থনী‌তি ও খাদ‌্যনিরাপত্তা নী‌তিমালা প্রণয়ন, জলবায়ু প‌রিবর্তন মোকা‌বিলায় কৃষি উপ‌যোগী নতুন কৌশল ও প্রযু‌ক্তি উদ্ভাবন, কৃষ‌কের জন‌্য কৃ‌ষিঋণ ও বীমা ব‌্যবস্থাপনার গ‌বেষণা ইত‌্যা‌দি।

উল্লেখ‌্য, বাকৃ‌বি‌তে গ‌বেষণার কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ১৯৮৪ সালের ৩০ আগস্ট বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাউরেস উদ্ভাবিত উন্নত কৃষি প্রযুক্তিগুলো সম্প্রসারণের জন্য ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণ কেন্দ্র। এ সম্প্রসারণ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিশ্বাবদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে রয়েছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটি, ইনস্টিটিউট অব অ্যাগ্রিবিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ভেটেরিনারি ক্লিনিক, দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর, উপমহাদেশের প্রথম মৎস্য জাদুঘর এবং প্রায় সাড়ে চার হাজার বৃক্ষসমৃদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেন রয়েছে। এ ছাড়া সা‌ড়ে ১১ হাজার ফলদ, ঔষধি প্রজা‌তির বৃক্ষসমৃদ্ধ এক‌টি জার্মপ্লাজম সেন্টার র‌য়ে‌ছে, যা বি‌শ্বে দ্বিতীয় এবং বাংলা‌দে‌শে প্রথম।

বাকৃ‌বির প্রতিষ্ঠাবা‌র্ষিকী উপল‌ক্ষে ভে‌টে‌রিনা‌রি অনুষ‌দের শিক্ষার্থী বাইজিদ আলম জানান, ‌বিশ্ববিদ‌্যাল‌য়ে অধ‌্যয়নরত অধিকাংশ শিক্ষার্থী মধ‌্যবিত্ত প‌রিবার থে‌কে আসা। তাঁদের পড়া‌শোনার খরচ চালা‌নোর জন‌্য টিউশ‌নির পাশাপ‌া‌শি ছোটখা‌টো কাজ কর‌তে হয়। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের সুব্যবস্থা ও শিক্ষাবৃ‌ত্তি চালু থা‌কে। তাহ‌লে শিক্ষাজীবন অনেক সহজ হয়। বর্তমান বি‌শ্বে চতুর্থ শিল্পবিপ্ল‌বের স‌ঙ্গে উপ‌যোগী হ‌য়ে উঠার জন‌্য ব‌্যবহা‌রিক খাতায় চিত্রাঙ্কন থে‌কে বের হ‌য়ে শ্রেণিকক্ষ এবং ব‌্যবহা‌রিক রু‌মের আধু‌নিকায়ন করা জরু‌রি।

মো রিয়াজ হোসাইন
শিক্ষার্থী, বাংলা‌দেশ কৃ‌ষি বিশ্ববিদ‌্যালয়

**নাগরিক সংবাদে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]