২৫ মার্চ রাতে শুরু হয় ইতিহাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। শহরে ২৬ মার্চের প্রভাত, মধ্যাহ্ন, সায়াহ্ন অপরাহ্ণ—সবই ছিল শূন্যতা, হাহাকার ও বিষাদে ভরা। সব যেন শোকের কালো পর্দায় ঢাকা। বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন কি ২৫ মার্চের রাতের পর চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাবে? এ জাতির তো ভুলে গেলে চলবে না যে তারা সূর্য সেন, কাজেম মাস্টার, সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের পতাকাবাহী। আর আসাদ, জোহা, মতিউরের রক্ত শপথে বলীয়ান।
প্রায় দেশজুড়ে যুদ্ধের ভয়াবহতা। কোটি বাঙালি উন্মাতাল স্বাধীনতার জন্য। সবাই দিশাহারা। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআরের তরুণেরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মৃত্যুর ঝুঁকি নিচ্ছে। ঠিক এমনি এক বিপর্যস্ত সময় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র জন্ম নিল ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র।’ সেখান থেকে প্রথম যে বাক্যটি ভেসে আসে তা হলো, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’ সেদিনের এ ভেসে আসা কণ্ঠস্বর ছিল চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি কলেজের উপাধ্যক্ষ আবুল কাশেম সন্দ্বীপের।
তারপর ঘোষক কাজী হোসনে আরও ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ থেকে বলছি বলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। এরপর সব প্রস্তুতি শেষে করে ৭টা ৪০ মিনিটে বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে অনুষ্ঠান শুরু হয়। শুরুতে কোরআন তেলাওয়াত করেন চট্রগ্রামের গীতিকার ও কবি আবদুস সালাম। এরপর তাঁর বীর কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ‘আসসালামু আলাইকুম। প্রিয় বাংলার বীর জননী বিপ্লবী সন্তানেরা। স্বাধীনতাহীন জীবনকে ইসলাম ধিক্কার দিয়েছে। আমরা আজ শোষক প্রভুত্ব লোভীদের সাথে সর্বাত্মক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি। এই গৌরবোজ্জ্বল স্বাধিকার আদায়ের যুদ্ধে, আমাদের ভবিষ্যৎ জাতির মুক্তিযুদ্ধে মরণকে বরণ করে জানমাল কোরবানি দিচ্ছি, কোরআন কারিমের ভাষায় তাঁরা মৃত নহে অমর। দেশবাসী ভাইবোনেরা আজ আমরা বাংলার স্বাধীনতাসংগ্রাম করছি। নাসরুম মিনাল্লাহে ওয়া ফাতহুন ক্কারিব। জয় বাংলা।’
আবুল কাসেম সন্দ্বীপ দ্রুত একটা বুলেটিন তৈরি করলেন। ফজল হোসেন ছিলেন ঘোষক। তাঁর কণ্ঠ চট্টগ্রামে খুব পরিচিত। তিনি ঘোষণা করলে তাঁর পরিবারের জন্য বিপদ হতে পারে। তাই তিনি ঘোষণা থেকে বিরত থাকেন। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে আবুল কাসেম সন্দ্বীপের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’ সেই কঠিন মুহূর্তে এ ঘোষণা শোনামাত্র আত্মবিশ্বাসে জেগে ওঠে বাংলার মানুষ। শত্রুর ওপর আঘাত হানার প্রেরণা পায় বীর বাঙালি।
৩০ মিনিটের মতো এ অনুষ্ঠান চলেছিল। এ অধিবেশনে এম এ হান্নানসহ আরও কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেছিলেন। কবি আবদুস সালাম পড়েছিলেন—কারও নির্দেশে নয়, কারও প্ররোচনায় নয়, সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমরা শুরু করলাম স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে। রাত সাড়ে ১০টায় বেলাল মোহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীরা মুশতারী লজে ফিরে এলেন। গভীর রাত পর্যন্ত চলল পরের দিনের প্রস্তুতি। সে কাজে সাহায্য করেছিলেন বেগম মুশতারী শফীর ছোট ভাই খন্দকার এহসানুল হক আনসারী। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি সেনারা চিকিৎসক শফী ও বেগম মুশতারীর ছোট ভাই আনসারীকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁরা আর কোনো দিন ফিরে আসেননি।
স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে শহীদ হন এই দুজন। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ৭টা ৪০ মিনিটে আবার কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রে অধিবেশন শুরু হয়। আবুল কাশেম সন্দ্বীপ স্বাধীনতার ঘোষণা আবার পড়েন।
*লেখক: আশফাকুজ্জামান, লেখক ও সংগঠক