ভিপি সাদিক কায়েম: রাজনীতিতে জামায়াতের বয়ান!
পতিত লীগের এত ভোট কোথায় গেল? যদি বলি ছাত্রশিবির পেয়েছে, আকাশ থেকে পড়বেন? আওয়ামী লীগ তার এক নম্বর শত্রু বানিয়ে রেখেছে বিএনপিকে। এর অনেকগুলো কারণ, জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা ও ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা অন্যতম। গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ জামায়াত শিবিরকে বুকের ভেতর আগলে রেখে হেলমেটে মুড়িয়ে ক্যাম্পাস শাসন করতে দিয়েছে। অনেক শিবির সদস্যও সেটা স্বীকার করেছেন এবং তাঁদের নেতৃত্ব এটাকে বলছে মজলুমের টিকে থাকার কৌশল। অধুনা এনসিপি নেতা হাসনাত-সারজিসের পুরোনো ফেসবুক পোস্ট এখনো মুজিবপ্রেমের সাক্ষ্য বহন করে। আগে মুজিবপ্রেম থাকলে পরে মুজিববাদ মুর্দাবাদ হতে পারবে না—এমনটা নয়।
আওয়ামী লীগ ওপরে দেখিয়েছে তারা জামায়াত শিবিরকে কোণঠাসা করে রাখছে। মুক্তিযুদ্ধের বয়ানের মধ্যে দেদার দুর্নীতি, লুটপাট ও গণতন্ত্র হরণ করে গেছে। বস্তুত আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক কোনো রাজনীতি করেনি। ধর্মনিরপেক্ষতার নামও মুখে নেয়নি গত ১৫ বছর। নিজেদের বানানো সংবিধানকে তারা তেজপাতার বাইরে আর কিছু ভাবেনি। তাদের একমাত্র কাজ ছিল বিএনপিকে দৌড়ের ওপর রাখা ও রাইট উইং নিয়ে নানামুখী টুইস্ট খেলা। এই ফাঁকে জামায়াত আপনমনে তাদের রাজনীতির মাঠ গুছিয়ে গেছে। গোছানো ওই দলটি গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগকে দলবলসহ দেশছাড়া করে দিয়েছে এবং বাংলাদেশের রাজনীতির আঁতুড়ঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিএনপিকে গতকাল মঙ্গলবার বিগ জিরো উপহার দিল। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে দেশের বড় দুই দলকে ক্ষমতা দেখাল জামায়াত শিবির। যারা মুক্তিযুদ্ধকে মনে করে ভারতের চাপিয়ে দেওয়া দেশভাগের ষড়যন্ত্র। অপরদিকে দেশছাড়া আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে আর কাউকে দেখে না। গতকালের পরাজিত দল বিএনপি একাত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে মেজর জিয়া ছাড়া আর কাউকে ক্রেডিট দেয় না।
গত বছর গণ-আন্দোলনে পর আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তদের তৈরি করা লোকালিটির মানি মেকিং পয়েন্টগুলোতে আধিপত্য ও দখলদারত্ব কায়েম করতে গিয়ে বদনাম কুড়িয়েছে বিএনপি। এই সুযোগে জামায়াত এখন বিএনপিকে টেম্পোস্ট্যান্ডের দল বলে নিন্দামন্দ করতেও ছাড়ে না।
আওয়ামী লীগের অপকর্মের ধূম্রজালে পড়ে অধিকাংশ লীগ সমর্থক, অনুসারী ও কর্মী ধর্মনিরপেক্ষতা শিকেয় তুলে রাইট উইংয়ের স্রোতে গা ভাসিয়েছে।
বিএনপি-আওয়ামী লীগের হার্ডকোর থিঙ্কিংয়ের বাইরে এসে জামায়াত গণমানুষকে তাদের নিজস্ব ধর্মভিত্তিক ন্যারেটিভের অনুবর্তী করতে পেরেছে। বাংলাদেশের মানুষ বহুধা বিভক্ত, তারা ভারতের তরফ থেকে আসা পলিটিক্যাল হেজেমনিও মেনে নেবে না। জেন-জিরা একাত্তরকে বড় করে না দেখে জুলাই বিপ্লবকে স্বাধীনতা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।
বস্তুত এর ফলাফলই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ডাকসুতে শিবিরের ভিপি প্রার্থী মো. আবু সাদিককে (কায়েম) ভোট দিয়েছেন। অনেকেই বলছেন, এতে করে একাত্তরের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়ে গেল। এমনকি নির্বাচনে এই বয়ানও দেওয়া হয়েছিল যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ২৫ মার্চ ও ১৪ ডিসেম্বর ৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের পৈশাচিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে—তাদের উত্তরসূরিদের যেন না ভোট দেওয়া হয়। এই কথা কেউ শোনেনি। সব বয়ান পেরিয়ে দলে দলে সাদিক কায়েমদের ভূমিধস বিজয় উপহার দিয়েছে ঢাবিয়ানরা।
কিন্তু এর দায় কার? অতি অবশ্যই আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিবদমান রাজনীতিই জামায়াতের হাতকে ভীষণভাবে শক্তিশালী করেছে। যে সময় বিএনপি জিয়াকে নিয়ে এবং আওয়ামী লীগ মুজিবকে নিয়ে পড়ে রয়েছে, সে সময় জামায়াত বিপুলসংখ্যক মানুষকে তাদের ধর্মীয় ভাবাদর্শে দীক্ষিত করে নিয়েছে। এবং ওই ভাবাদর্শে দীক্ষিতরা জানবাজি রেখে ১৫ বছরের শক্ত রেজিমকেও হটিয়ে দিয়েছে। এবং এই জানবাজ হিসেবে জামায়াত সমাজের সবচেয়ে মেধাবী অংশকে হাতের মুঠোয় রেখেছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র ও সেরা শিক্ষকেরাই হলো জামায়াত ঘরানার গর্বিত সদস্য।
এখন এসব বুদ্ধিমানের রাজনৈতিক ন্যারেটিভ টেক্কা দিতে পারে এমন লোক আছে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, গণ অধিকার পরিষদ বা সিপিবির? এক কথায় উত্তর হলো নেই। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পোস্ট শিবিরের কাছে গেলে এমনকি পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে জামায়াত সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আপনাদের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক বয়ান যদি জেন-জির হৃদয় স্পর্শ না করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল টপ টু বটম সবখানে দেখতে বাধ্য থাকবেন। কেউ ভারতে বসে আফসোস করবেন। আর কেউ–বা সামান্য টেম্পোস্ট্যান্ড নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবেন। আমরা বরং সাদিক কায়েমদের অভিনন্দন জানিয়ে সামনে জামায়াতের শাসন একবার হলেও পরখ করি। যারা রবি ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত চায় না, তারা দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীদের নেতৃস্থানে দেখতে চায় না।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]