বদরুদ্দীন উমর একজন নিখাদ কমিউনিস্ট

বদরুদ্দীন উমরফাইল ছবি

২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় এক সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দীন উমর বলেছিলেন, ‘আমি যে একজন কমিউনিস্ট, সেটাই এখানকার লোকে জানে না। তারা আমাকে বুদ্ধিজীবী বলে। ভয় পায় এ কারণে যে আমি লোকের ভণ্ডামি, নির্বুদ্ধিতা, মূর্খতা, এসব প্রকাশ করি। আমি ঘটনা বিশ্লেষণ করি, ভুলত্রুটি নির্দেশ করি এবং অনেকের মুখোশ খুলে দিই। এটাই হচ্ছে আমার ওপর তাদের রাগের কারণ।’

প্রথম আলো আজ লিখেছে, বদরুদ্দীন উমর, লেখক-গবেষক ও বামপন্থী রাজনীতিক। ৯৪ বছর বয়সে ঢাকার একটি হাসপাতালে গতকাল রোববার তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিপিই ডিগ্রি নেন। দেশে ফিরে এসে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। গভর্নর মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন।

বদরুদ্দীন উমর—যে নামটি প্রগতিশীল চিন্তা, নির্ভীক উচ্চারণ আর তাত্ত্বিক গভীরতার সঙ্গে চিরকাল উচ্চারিত হবে। তিনি শুধু লেখক বা গবেষক নন, ছিলেন একজন বুদ্ধিজীবী; যিনি বারবার আমাদের ভাবতে শিখিয়েছেন নতুনভাবে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তিনি যেমন নথিভুক্ত করেছেন, তেমনি কৃষক-শ্রমিক ও নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামকেও দিয়েছেন এক তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ করে এক নতুন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের, তখনই তিনি গড়েছিলেন ‘মুক্তি কাউন্সিল’। যদিও রাজনৈতিক বাস্তবতার টানাপোড়েনে সেটি বড় হয়ে উঠতে পারেনি, তবু সেই প্রয়াস ইতিহাসে থেকে গেছে এক সাহসী স্বাক্ষর হিসেবে।

বদরুদ্দীন উমরের প্রয়াণে আমরা হারালাম এমন এক বুদ্ধিজীবীকে, যিনি সম্মান-সমালোচনা দুইয়ের মাঝেই ছিলেন অটল, কিন্তু যাঁর চিন্তার উত্তরাধিকার আমাদের প্রজন্মকে এখনো ভাবাবে, আলোড়িত করবে।

সাম্প্রদায়িকতা ও সাংস্কৃতিক সংকট, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, বাংলাদেশে জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থান, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন, মার্ক্সীয় দর্শন ও সংস্কৃতি, বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি, পরিবেশ বিপর্যয়ের পথে বাংলাদেশ, The Emergency of Bangladeshসহ বিপুলসংখ্যক রাজনীতি ও সংস্কৃতিবিষয়ক মননশীল গ্রন্থ রচনা করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের চেয়ে আলাদা। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসের ৮০–৯০ শতাংশ অংশই মিথ্যা, যা মূলত সরকার-প্রণীত ভাবনা বা প্রচারমুখী ধারণা। জাতীয় নেতা ও রাজনৈতিক বীরত্বের সাহায্যে ইতিহাস সাজানোর চেষ্টা হয়েছে, যা বাস্তব ইতিহাসকে ঢেকে দিয়েছে। বদরুদ্দীন উমরের মতে, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা চাননি; তিনি পাকিস্তানের কাঠামোর ভেতর সর্বোচ্চ আত্মনিয়ন্ত্রণ চেয়েছিলেন এবং নিজেকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী দেখতে চেয়েছিলেন।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

বদরুদ্দীন উমর ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হিসেবে দেখেননি। তিনি মনে করেন, শেখ মুজিবুর রহমানের এই ভাষণ ছিল একটি রাজনৈতিক কৌশল, যা পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে আলোচনার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। উমরের মতে, এই ভাষণে স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা ছিল না; বরং এটি ছিল একটি ‘কথার কথা’ বা ‘শব্দের খেলা’, যা পরিস্থিতির চাপের মধ্যে দেওয়া হয়েছিল।

উমর জীবনের শেষবেলায় প্রশ্ন তুলেছেন: ‘মুজিব কিসের জাতির পিতা?’ কারণ, ১৯৭৫ ও ২০২৪ সালে জনগণ তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সমালোচনা করেছিল, যা তাঁর ঐতিহাসিক মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। তবে তিনি ২০২১ সালে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের কৃতিত্ব ছিল জাতীয় সংগ্রামের বিকাশ তথা পাকিস্তানিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব যে প্রধান বিষয়, সেটা ভালোভাবে ধরতে পেরেছিলেন। মাওলানা ভাসানী, এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমানদের কাণ্ডজ্ঞান কমিউনিস্ট নেতাদের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এই কাণ্ডজ্ঞানের মধ্য দিয়ে তাঁরা বুঝেছিলেন, এখন জাতীয় সংগ্রামের বিকাশ ঘটানো দরকার।’

বদরুদ্দীন উমরের বাবা ভারতীয় উপমহাদেশের একজন মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম। যদিও তাঁর পিতা আবুল হাশিম পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধী ছিলেন, তথাপি তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৯৫০ সালে কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। অনেক সমালোচক বলেন, স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আবুল হাশিমের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিরোধ ছিল, যে কারণে জীবনভর বদরুদ্দীন উমর মুজিবকে স্বাধীনতার নেতা হিসেবে মেনে নেননি।

প্রথম আলোর ওই একই সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন ছিল, তা বাঙালি মুসলমানের মধ্যে মননশীলতা তৈরি হলো না কেন? বদরুদ্দীন উমর উত্তর দিয়েছিলেন, ‘শরীরে ইনজেকশন দিয়ে তো মননশীলতা তৈরি করা যায় না। রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করেও এটি পাওয়া যাবে না। এর জন্য চর্চা দরকার। আজ বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, জ্ঞানের চর্চা বলে কিছু নেই। কিন্তু ভারতে মোদি সরকার যতই দুর্বৃত্তায়ন চালাক না কেন, সেখানে প্রগতিশীলেরা, কমিউনিস্টরা ইতিহাসচর্চা করছেন। রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিব, অমিয় কুমার বাগচীর মতো অনেক ইতিহাসবিদ আছেন। আর আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকান, কোনো ইতিহাসবিদ নেই। এমনকি সৃজনশীল সাহিত্যেও তো আখতারুজ্জামান, হাসান আজিজুল হকের পর উল্লেখ করার মতো কাউকে দেখছি না। এই যে সাতচল্লিশ সাল থেকে এত সংগ্রাম করে এখন যে অবস্থা দাঁড়াল, তা খুবই হতাশাজনক। অর্থনীতির দিকে তাকালেও দেখব, একদিকে মেট্রোরেল হচ্ছে, টানেল, পাতাল রেল হচ্ছে; অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাট নেই, সেতু নেই। মানুষের কষ্টের শেষ নেই।’

২০২৫ সালে বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন; কিন্তু তিনি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। বস্তুত জীবদ্দশায় কোনো পুরস্কারই তিনি গ্রহণ করেননি। যেখানে বাঙালি মানে পুরস্কারের আশায় বিগলিত থাকেন।

আমাদের সময়ের বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর কলকাতার বংশোদ্ভূত হয়েও তাঁর প্রজ্ঞা ও জ্ঞানচর্চা দিয়ে বাংলাদেশিদের মন জয় করতে পেরেছিলেন। যদিও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এখনো অনেকেই মনে স্থান দিতে ভীষণ কুণ্ঠাবোধ করেন। বাঙালির এই দ্বিচারিতা চিরায়ত ও সহজাত।

অনেক কাজ যিনি করেন, তাঁর সমালোচনাও অনেক বেশি। আমরা বদরুদ্দীন উমরের রাজনৈতিক জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চাকে সমীহ করব। আমরা তাঁর পুণ্যস্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক: সাংবাদিক