স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তারা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানিদের বিজয় অহংকার। বাংলায় বর্বর হামলা চালায় দেশটির সেনাবাহিনী। শুরুতেই স্বাধীন বাংলা বেতারকে টার্গেট করে তারা। ভয়ংকর শত্রু মনে করে এই বেতারকে। কিন্তু শুরু থেকেই এই বেতার কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল, শুধু তা–ই নয়। সাত কোটি বাঙালি এখান থেকে ফিরে পেয়েছিল প্রাণ। সে সময় বিশ্বের সমর্থন ও সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সেদিন এই সহযোগিতা ও সমর্থনের আহ্বান জানানো হয়েছিল। এ কেন্দ্রের নাম শুনে স্তম্ভিত হয়েছিল পাকিস্তানি প্রশাসন। বেতার ধ্বংস করেছিল তাদের প্রতিরোধহীন বিজয় অহংকার। বাঙালির মনে স্বপ্ন বুনেছিল এই বেতার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার উচ্চারণ ছিল বাঙালি জাতির আত্মপ্রত্যয়ের অমোঘ বাণী। এ ঘোষণা শোনা মাত্রই দিশাহারা বাঙালি মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ায়। সবাই যেন একসঙ্গে চিৎকার করে বলল, ‘আমরা জেগে আছি। ভয় নাই। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়ে যাব। সেদিন হয়তো দূরে নয়, যেদিন জয় করব বাংলার মাটি।’
বীর বাঙালি শত্রুকে প্রতিরোধ করল। রাস্তায় ব্যারিকেড দিল। প্রতিরোধ করল শত্রুর অগ্রযাত্রা। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল শত্রুর ওপর। বাংলায় শুরু হলো শত্রু হত্যার প্রস্তুতি।
সূচনা হলো সর্বাত্মক স্বাধীনতাযুদ্ধের। যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতারের দুঃসাহসী প্রচার ছিল। গুঁড়িয়ে দিয়েছিল খানদের বিজয় অহংকার।
চট্টগ্রাম কালুরঘাট থেকে শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতারের যাত্রা। তারপর কলকাতার বালিগঞ্জের ছোট একটি দোতলা বাড়িতে এসে স্থির হয়। এখান থেকেই চলতে থাকে স্বাধীন বাংলা বেতারের সম্প্রচার। একটি মাত্র স্টুডিও। এখানে সবকিছু তৈরি করা যেত না। পরে রেকর্ডিংয়ের জন্য আরও একটি কক্ষ খালি করা হয়। তবে এগুলো কোনো পেশাদার স্টুডি নয়। শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ড্রাম, গিটারসহ তেমন কিছুই ছিল না, তবে সময়ে সব গুছিয়ে নিয়েছিল। বেতারের সঙ্গে যুক্ত প্রায় সবাই এখানেই থাকতেন। গভীর রাত পর্যন্ত রেকর্ডিংসহ নানা কাজ করতেন। তারপর চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন মেঝেতেই।
মুজিবনগর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রথমে সব ঠিক ছিল না। শুরুতে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল। অনেক কিছু গুছিয়ে নিতে হয়েছে। এ জন্য প্রথম দিকে বেশি অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি।
প্রথম দিকের অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল চরমপত্র-বিশেষ ব্যঙ্গ রচনা। অগ্নিশিখা-মুক্তিবাহিনীর জন্য অনুষ্ঠান। জাগরণী-উদ্দীপনামূলক গানের অনুষ্ঠান। ইংরেজি ও বাংলা খবর ইত্যাদি। সেই ভয়াবহ দিনগুলোয় কত যে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছে, তার শেষ নেই। এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল ইংরেজি ও বাংলা খবর, বিশ্বজনমত, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ প্রোগ্রাম, ১০ মিনিটের উর্দু অনুষ্ঠান, বিশেষ কথিকা, বঙ্গবন্ধুর বাণী। ‘জল্লাদের দরবার’ ইয়াহিয়া ও তার দোসরদের নিয়ে ব্যঙ্গনাটিকা। দৃষ্টিপাত-বিশেষ পর্যালোচনা, রাজনৈতিক মঞ্চ ইত্যাদি।
এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে জেগে উঠেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁরা দুর্বার অক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন হানাদার বাহিনীর ওপর। ধংস করেছিলেন তাদের দম্ভ ও বিজয়ের স্বপ্ন। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীন বাংলা বেতার এক অনন্য বেতার। চলবে...
আশফাকুজ্জামান, লেখক ও সংগঠক