শুভ জন্মদিন এমসি কলেজ: ঐতিহ্যের ১২৯ বছর

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আশানুরূপ ফল না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। ভাগ্যক্রমে ভর্তি হয়ে যাই সিলেটের তথা বাংলাদেশের সপ্তম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ মুরারিচাঁদ কলেজে, যা এমসি কলেজ নামে পরিচিত। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই জানার চেষ্টা করেছি এটার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। আজ ২৭ জুন, কলেজের ১২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

একটু পেছনে তাকালে দেখা যায়, এমসি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯২ সালের ২৭ জুন। সিলেটের বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী রাজা গিরীশ চন্দ্র রায় কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। আগে কলেজের অবস্থান ছিল সিলেট মহানগরীর বন্দরবাজারের কাছে রাজা জিসি উচ্চবিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী স্থানে। ১৮৯১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটিতে এফএ অর্থাৎ বর্তমানের উচ্চমাধ্যমিকের ক্লাস খোলার অনুমতি দিলে ১৮৯২ সালের ২৭ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে এমসি কলেজ যাত্রা করে। কলেজটি ১৯১২ সালে সরকারি কলেজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯১৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান ক্লাস ও স্নাতক শ্রেণিতে পাঠ শুরু হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কলেজের স্থান পরিবর্তন করে শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বর্তমান সিলেটের টিলাগড়ে ১৪৪ একর জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। তখন কলেজের শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ৫৬৮ জন। বর্তমানে আছে ১৪ হাজারের ওপরে। এখানে ১৫টি বিষয়ে স্নাতক ও ১৬টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে।

এমসি কলেজের পূর্বে রয়েছে সিলেট সরকারি কলেজ এবং উত্তরে রয়েছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। কলেজের সুবিশাল ক্যাম্পাসে রয়েছে একটি বিশাল খেলার মাঠ। আরও আছে পুকুর, ক্যানটিন, শহীদ মিনার, ২৫ হাজারের অধিক বই নিয়ে গ্রন্থাগার, স্পোর্টস রুম, অডিটোরিয়াম, মসজিদ, বিপন্ন উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্নার, ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক হোস্টেল ও বিভিন্ন বিভাগীয় ভবন।

সিলেট বিভাগরে চার জেলার শিক্ষার্থী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার শিক্ষার্থীরা এ প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন। প্রতিবছর ফলাফলের দিকেও এগিয়ে রয়েছে কলেজটি।
শিক্ষার্থীরা শুধু ক্লাসরুমে পড়ালেখার মধ্যেই থেমে নেই; নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত। এমসি কলেজে রয়েছে নাটক সংগঠন থিয়েটার মুরারিচাঁদ, মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন, মুরারিচাঁদ কবিতা পরিষদ, মুরারিচাঁদ ডিবেটিং সোসাইটি, বিজ্ঞান ক্লাব, ফটোগ্রাফি সোসাইটি, রোভার স্কাউট, বিএনসিসি ও এমসি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি।

বছরজুড়েই তাই নানা অনুষ্ঠান চলে ক্যাম্পাসজুড়ে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রতিবছরই বাংলা নববর্ষ, বসন্তবরণ, বর্ষবরণসহ নানা আয়োজন করে থাকে। এমসি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করছেন। কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী অমিত বিক্রম দেব বর্তমানে কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসায়। ১৯১৯ সালে সিলেটে এসেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমসি কলেজের তৎকালীন ছাত্ররা কবিগুরুকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আবুল মাল আবদুল মুহিত, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামসহ অসংখ্য গুণীজন এমসি কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন।

২০১৯ সালে কলেজ প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য নির্মাণের মধ্য দিয়ে কলেজের শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের একটা দাবিও পূরণ হয়েছে। প্রতিবছরই কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হলেও এবারই পালন হচ্ছে না। কারণটা সবারই জানা। বিশ্বব্যাপী করোনার ছোবলের কারণে আজ সবাই ঘরবন্দী। শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে কলেজের শিক্ষকেরা অনলাইনে ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছেন শুরু থেকেই।

কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কথা হয় কলেজের অধ্যক্ষ মো. সালেহ আহমদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা এবার ১২৯ বছর উদ্‌যাপন করতে অনেক পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু মহামারি করোনার কারণে তা সম্ভব হয়নি।’ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে উপলক্ষে তিনি আরও বলেন, ‘পড়ালেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পাঠক্রমবহির্ভূত সৃজনশীল কার্যক্রমেও উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষার্থীরা যাতে অধিক সময় ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে পারে, সে জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি।’

কলেজ উপাধ্যক্ষ পান্না রানী রায় বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যেন অধ্যয়নরত অবস্থায় চাকরির বাজার সম্পর্কে ধারণা পায়, এ জন্য করোনা–পূর্ববর্তী সময়ে প্রতি মাসেই আমরা নানা সেমিনারের আয়োজন করেছি, ভবিষ্যতেও করব। আমাদের কলেজ লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত বই আছে। এ জন্য তাদের বাজারমুখী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।’

কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক মো. তৌফিক এজদানী চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা একটাই, আমাদের সব শিক্ষার্থী যেন আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।’