মানব পাচার ও আধুনিক দাস প্রথার বলয়
এক টেবিলে ব্ল্যাক কফি, অন্যটিতে কোল্ড ড্রিংকস। চা নিয়ে হাত দুটি ব্যালেন্স করে রেস্তোরাঁয় পুরো দস্তুর মতো কাজ করছে ছটকো। পয়সা পায় না, তবে দুবেলা খেতে পারে এতেই তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। মায়ের হাতে কবে লুচি–পায়েস খেয়েছিল মনে নেই ছটকোর। তারপরও মনের মাঝে কোনো দুঃখ নেই টিভিতে সিনেমা দেখতে পারে বলে!
ছটকোর জীবনীতে ক্রীতদাসের ছবি ফুটে ওঠে। নিখুঁত করে বলতে গেলে ‘আধুনিক ক্রীতদাস’। তবে সব ছটকোই যে ক্রীতদাস তা কিন্তু নয়। ‘ফোর্সড লেবার’ বা জবরদস্তিমূলকভাবে কাজ করানোর সঙ্গে আধুনিক ক্রীতদাসের সম্পর্ক অতি নিবিড়। ‘গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্স’ সূচকনির্ভর প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা কেভিন ব্যালেস ‘আধুনিক দাসপ্রথা’র ধারণাটি বিশ্ববাসীর সামনে নিয়ে আসেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো কর্মী যদি নির্ভয়ে তার অপছন্দের কাজকে ‘না’ বলার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে, তবেই প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে। কর্মক্ষেত্রে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে না পারলে ক্রীতদাস হিসেবেই জীবনকে বেছে নিতে হয়। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, অনেকেই ছোটবেলা থেকে কর্মক্ষেত্রে জোর জবরদস্তিমূলকভাবে বেড়ে ওঠায় ব্যক্তি স্বাধীনতা কী তা ভুলে যায়।
বেগার শ্রম, মানব পাচার, বলপূর্বক শ্রমে নিয়োগ, জোর করে বিয়ে দেওয়া আধুনিক ক্রীতদাস হিসেবে বিবেচ্য। মানব পাচার হলো দাসত্বের আধুনিকতম পর্যায়, যা বাধ্যবাধক শোষণের জন্য মানুষের অবৈধ বাণিজ্য জড়িত। মূলত সমাজের অতি দরিদ্র, নিরক্ষর মানুষেরাই মানব পাচারকারী টার্গেটে পরিণত হয়। বিদেশ পাড়ি দেওয়ার কথা বলে মানুষগুলোর মাঝে আশা জাগায়। স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দুচোখ ভরে; অবারিত ধারায় জীবন চলতে শুরু করে সরলমনা মানুষগুলোর প্রথম প্রহরেই। কিন্তু প্রতারণার ফাঁদে পড়ে দুর্বিষহ জীবন নেমে আসে। নারীদের অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয় কিংবা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বসবাস করায় দেশে ফেরত পাঠানোর ভয়ে অনেকটা চোখ বুজে নির্যাতন সহ্য করে। ‘রুটস: দ্য সাগা অব অ্যান আমেরিকান ফ্যামিলি’ উপন্যাসে দাসের ওপর নির্যাতনের সেরূপ করুণ চিত্র আমরা খুঁজে পাই। লেখক অ্যালেক্স হ্যালি দাসের নির্মম কাহিনি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসে কোন্টাকিন্ট বারবার চেষ্টা করেও দাসত্বের বলয় থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে পারেনি। বরং দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার বদলে মালিকের কুঠারের আঘাতে পায়ের পাতার অর্ধেকটুকু হারিয়ে চিরতরে ‘মুক্তি’ হারায় কোন্টা!
পাচারকৃত ভুক্তভোগীদের বেশিসংখ্যক নিরক্ষর থাকায় দেশগুলোর আইনকানুন সম্পর্কে ধারণা থাকে না। ফলে নির্যাতনের মতো অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় এগোতে পারে না। শিশুদের ক্ষেত্রে আরও ভয়ানক বার্তা প্রকাশ পায়। তাদের জোরপূর্বক মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত রাখে। এমনকি কোনো কোনো শিশুকে নেতিবাচক মতবাদ বা আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ফলে এক অন্ধকার অমানিশায় ঘুরপাক খায় মানুষগুলোর ভাগ্যের চাকা। বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্নের স্ফুলিঙ্গ ভাসিয়ে দেয় উত্তাল সাগরে।
ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যা ক্রাইম (ইউএনওডিসি)-এর তথ্যমতে, প্রতিবছর আন্তর্জাতিক সীমান্তে প্রায় ৮ লাখ লোক পাচার হয়। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ নারী বা মেয়ে এবং ৫০ শতাংশ নাবালিকা। জাতিসংঘের এক তথ্যমতে, এখনো মানব পাচার বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং লাভজনক পেশার একটি। মানব পাচারকারীরা ভুয়া বিজ্ঞাপন দিয়ে ভুক্তভোগীদের আকৃষ্ট করে। বিশেষ করে নারীদের আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি মানব পাচারকারীদের একটি অপকৌশল মাত্র। সে প্রতিশ্রুতির ফাঁদে ফেলে নারীদের আকৃষ্ট করে পাচারকারীরা তাঁদের কূট কৌশলে সফল হয়। উদাহরণস্বরূপ, কম্বোডিয়ার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী ও শিশু থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ায় পাচার করা হয়। দেশগুলোতে নারী পাচারের ট্রানজিট হিসেবেও কম্বোডিয়াকে ব্যবহার করা হয়। যাদের প্রধান উদ্দেশ্য শিশুশ্রম ও বাণিজ্যিক যৌন শোষণ।
আমাদের দেশ থেকে যেসব মানব পাচার হয়ে থাকে তার উল্লেখযোগ্যসংখ্যকই নারী। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২০ সালেই অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় ৩০৩ জন নারীকে উদ্ধার করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক তথ্যমতে, ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে নারী পাচারের শিকার এমন মামলার সংখ্যা ১ হাজার ৭৯১টি। মামলার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে যত মানব পাচার হয়েছে তার মধ্যে ২১ শতাংশ নারী। সম্প্রতি ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশের এক তরুণীকে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়, যা আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়।
তবে আশার কথা হলো, আধুনিক দাসদের মাঝে নারী ও শিশুদের পুনর্বাসনে কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও ইতিবাচক। তারপরও আমাদেরই সচেতনতার ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আধুনিক দাসপ্রথার বলয় থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
*লেখক: অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক