ফরিদপুরের আঙিনায় পাখিফুলের অবারিত প্রস্ফুটন
ফরিদপুরের আঙিনায়—শ্রী জগদ্বন্ধুর আশ্রমের ভেতরে—এ বছর কোভিডকালে নিষেধাজ্ঞার কারণে শতবর্ষী একমাত্র পাখিফুলের গাছে অবারিত ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত প্রস্ফুটন ঘটেছে, যা আগে কখনো এতটা জমকালোভাবে দেখা যায়নি। পাড়ার দুষ্টু ছেলেদের উৎপাতে গাছে ফুল রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ত, এ বছর আর সেটা ঘটেনি। গাছের ফুল গাছেই পরিপূর্ণভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে। কেবল পূজার অর্ঘ্য হিসেবে অন্য আরও ফুলের সঙ্গে প্রতিদিন দু-একটি পাখিফুলও ছেঁড়া হয় মাত্র।
পাখিফুল দুষ্প্রাপ্য গাছের তালিকায় পড়ে আমাদের বাংলাদেশে। পাখিফুল মূলত দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণমণ্ডলীয় গাছ ও গোলাপ নামে পরিচিত, আবার সুপ্তিও বলা হয়। বৈজ্ঞানিক নাম ‘ব্রাউনিয়া ককসিনিয়া’। গাছটিকে স্কারলেট ফ্রেমবিন নামেও ডাকা হয়।
বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি অতি সুপরিচিত ও অতি প্রিয় গাছ। গৌতমবুদ্ধের কাছে তাঁর ভক্তরা এ ফুলের অর্ঘ্য সাজাত। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা মন্দিরে থাকা এ গাছের রক্তিম বর্ণের ফুল দিয়ে দেবদেবীর পূজা দেয়। মিয়ানমার, কক্সবাজার, নাটোরের উত্তরা গণভবন, ফরিদপুরের আঙিনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল, চট্টগ্রামের বৌদ্ধমন্দিরসমূহ, বরেণ্য চিত্রকর এস এম সুলতানের চিত্রা নদীর তীরের বাড়ি, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টার ও পাবনার শালবাড়িয়া সড়কে এ পাখিফুলের গাছ আছে।
ফাল্গুন মাস থেকেই এ ফুল থোকায় থোকায় ফুটতে শুরু করে। মূলত, এটি গ্রীষ্মকালীন ফুল। ফুল হয় আবরণের মধ্যে, মাথাটা থাকে সুচালো, তার সঙ্গে ছোট ছোট ফুল থাকে ৩০ থেকে ৫০টি। পূর্ণ প্রস্ফুটিত ফুল কড়ে আঙুলের মতো লম্বা হয়। এভাবে একটি থোকায় অনেক ফুল ফোটে বলে খুবই সুন্দর দেখায় এবং চিত্তে দোলা দেয়।
সব কাণ্ডের গায়ের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ফুল হয়। এর নতুন পাতা দেখতে অনেকটা অশোকের পাতার মতো। ফুলের রক্তিম লাল খুবই উজ্জ্বল। একটি পেনসিলের মতো আবরণের ভেতর নতুন পাতার কুঁড়ি প্রথমে বেড়ে ওঠে, তারপর হঠাৎ পূর্ণরূপে বিকশিত হয়। তখন কচি পাতার রং থাকে উজ্জ্বল বেগুনির ওপর ছোপ ছোপ, কখনো কখনো রংটা তামাটের দিকেও হয়। এ জন্য এসব গাছকে তাম্রপত্রী বৃক্ষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তখন এক থোকা পাতা নরম ডাল থেকে চমৎকারভাবে ঝুলে থাকে, যেন ঝুলে থাকা পাখির লেজ। তারপর বেশ দ্রুত রং পাল্টে যায় এবং পরে সোজা হয়ে মসৃণ সবুজ পাতায় রূপ নেয়। এ জন্য বাংলায় এর নাম পাখিফুল।
এ গাছের উচ্চতা ৫ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। গাছটি খুবই ধীরলয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। লোয়ার কলম করে এর চারা পাওয়া যায়। বীথি হিসেবে এ গাছ অবারিত সৌন্দর্যের বিভায় শোভিত হয়। মাঝারি ধরনের এ ছায়াবৃক্ষ পথের পাশের জন্য খুবই উপযোগী। ভেজা আবহাওয়া ও সমুদ্রের উপকূলে এই গাছ ভালো জন্মে। আবার উষ্ণ আবহাওয়া ও বৃষ্টি এর জন্য খুবই উপযোগী। ঠাসবাঁধা সুদৃশ্য এ গাছে টকটকে রক্তিম ফুল হয় বলে জমকালো দেখায়। পাখিফুলের ঐশ্বর্যমণ্ডিত পূর্ণ প্রস্ফুটন দর্শকের মস্তিষ্ককে প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দেয়, মন ও চোখের নজর কাড়ে এবং হৃদয়ের আকুতি প্রশমিত করে।
*লেখক: মো. সহিদউল্লা, প্রকৃতি প্রত্যবেক্ষক, ফরিদপুর।