চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিস্ময় রেশমের পণ্যসত্ত্ব ছিনতাই
দৈনিক প্রথম আলো (১৮.০৬.২১ ও ২০.০৬.২১) থেকে জানা গেল, ‘রাজশাহী সিল্ক’ জাতীয় ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ পত্রিকার মাধ্যমে আরও জানা যায়, একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের বা সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকেই সেই দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যখন কোনো দেশের কোনো পণ্য জিআই হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তখন ওই পণ্য ওই দেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে গণ্য হয়।
আমরা নিঃসন্দেহে আনন্দিত, দেশের বিভিন্ন স্থানের পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করছে এবং এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে আরও অনেক পণ্য অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমার ও আমার মতো অনেকের কাছে একটা বিষয় খুব চিন্তার—জিআই পণ্য নির্ধারণের নীতিমালা কী? এতে কোন কোন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়? গুরুত্ব বিশ্লেষণ বা বিচার করার সময় ভৌগোলিক অবস্থান, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, উৎপাদিত পণ্য উপকরণের সহজলভ্যতা, গণমানুষের সম্পৃক্ততা ইত্যাদি এর মধ্যে পড়ে কি না। কেননা রাজশাহী সিল্কের নামে জেলা ব্র্যান্ডিং আমাদের বিস্মিত ও মর্মাহত করেছে। সে কারণে এসব প্রশ্ন বারবার উদিত হচ্ছে, জিআই পণ্য বাছাইয়ের প্রক্রিয়া কী?
কথায় বলে, বড় গাছের নিচে ছোট গাছ জন্মাতে পারে না। কথাটা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ক্ষেত্রে বহুলাংশে প্রমাণিত এবং এ প্রক্রিয়া চলমান। কেননা তার প্রতিফলন হলো রাজশাহী সিল্কের ব্র্যান্ডিংয়ের। রাজশাহীর অন্যতম মহকুমা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হিসেবে উন্নীত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও এ স্থানের আদি ও প্রসিদ্ধ বিভিন্ন জাতের আম, রেশম, বিভিন্ন মিষ্টান্ন দ্রব্য এবং আলকাপ, গম্ভীরা—এই সবকিছুকেই রাজশাহীর নিজস্ব সম্পদ হিসেবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এসব হলো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে।
বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা খ্রিষ্টপূর্ব সময় থেকে রেশম উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। দেশভাগের আগে এ জেলা মালদহর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। কুটির শিল্প হিসেবে রেশমশিল্প অতি প্রাচীনকাল থেকেই বহুল সমাদৃত এবং ঐতিহ্যবাহী। ইতিহাসপূর্ব যুগ থেকে এখানে ও আশপাশে রেশমের সূচনা হয়েছিল। বাংলার সুলতানি আমলে গৌড় লক্ষ্ণৌতি থেকে রেশম বস্ত্র রাজধানী দিল্লিতে পাঠানো হতো। ইউরোপের বাজারে প্রথম ঢাকার মসলিন এবং পরে রেশম রপ্তানি করা হতো। গঙ্গা-পাগলা-মহানন্দা বিধৌত মালদহর আবহাওয়ায় অনায়াসে রেশম তৈরির প্রধান কাঁচামাল তুঁতগাছের প্রাচুর্য্য ছিল। সে সময় তুঁতবাগান জমির দাম ছিল বেশি। ১৯১৮ সালে ধানি জমির দাম ছিল বিঘাপ্রতি ১০ আনা থেকে এক রুপি, বোরো জমি ৮-১০ আনা, আমবাগান ৮-১৩ আনা, তুঁতবাগান ১-৪ রুপি (সূত্র– বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, মালদহ ১৯১৮)। উল্লেখ্য, বঙ্গদেশে নীলকুঠির আগে রেশমকুঠি স্থাপিত হয়। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নায়ক মজনু শাহ ১৭৮৩ সালে মালদহর আশপাশে ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করে ইংরেজ ও অন্যান্যদের নীলকুঠির সঙ্গে অনেক রেশমকুঠি ধ্বংস করেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বপ্রথম ১৬৭৬ সালে মালদায় আগমন ঘটে এবং তারা রেশমের ব্যবসা শুরু করে। তার আগে তারা ভাসমান ছিল। তাদের আসার বহু আগে থেকে ওলন্দাজ এবং পরে ফরাসি বণিকেরা এসে রেশম ব্যবসা ও উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় জড়িত হয়। মালদহর বস্ত্র ব্যবসা সে সময় ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। আগ্রা, গুজরাট, কাশ্মীরের বণিকেরা প্রতিবছর বাণিজ্য করতে আসতেন। ব্রিটিশ বণিক ও পর্যটক স্ট্রেন শ্যাম মাস্টারের ডায়েরি থেকে জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৭৬ সালে মালদহয় রেশম ব্যবসা শুরু করে। কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে নবাব শায়েস্তা খাঁর সঙ্গে কোম্পানির বিরোধ চরমে ওঠে এবং তাদের মালদা থেকে বিতাড়িত করা হয়। পরে কোম্পানি পুরাতন মালদহ থেকে ইংরেজ বাজারে রেশমকুঠি স্থানান্তর করে (A statistical account of Bengal, volume VII, Malda, 1876: By WW Hunter report থেকে এর সত্যতা আঁচ করা যায়)। হান্টার রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, ফরাসি কোম্পানি MM Louis Poyen and Cie ভোলাহাটে (বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপজেলা) একটি রেশম কারখানায় গরম বাষ্প দ্বারা সুতা শুকানোর যন্ত্র প্রতিস্থাপন করে। যন্ত্রটি কালের সাক্ষী হিসেবে এখনো ভোলাহাটের রেশম বোর্ডের অফিসে অযত্ন ও অবহেলায় খোলা আকাশের নিচে পড়ে রয়েছে, যদিও শত শত বর্ষীয় পুরোনো অবকাঠামোর অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান।
‘Bengal District Gazetteers Malda, 1819’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় ভোলাহাট ও বারঘরিয়ায় রেশমচাষিদের কাছ থেকে কোকুন সংগ্রহ করে দেশি ব্যবসায়ী ও বিদেশি বণিকেরা সুতা তৈরি করতেন। ভোলাহাটের আশপাশের লোকজনের একটি বড় অংশ চাষীদের কাছ থেকে কোকুন সংগ্রহ করে সুতা তৈরি করত। মালদহর পাশেই সাহাপুর এবং বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ ও ভোলাহাট রেশম বস্ত্র তৈরির জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদনকেন্দ্র ছিল। এসব স্থানের উৎপাদিত রেশম বস্ত্র মালদহয় বাজারজাত করা হতো। উৎপাদিত রেশম বস্ত্র প্রধানত থান, শাড়ি, ধুতি, রুমাল, কোট, টাই ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। প্রাচ্যের বড় বড় শহর—লন্ডন, আমস্টারডাম, প্যারিসের ললনাদের আকর্ষণীয় পরিধেয় বস্ত্র ছিল রেশম। মালদহয় ১৯০৮ সালের দিকে অজ্ঞাত কারণে ভোলাহাট, শিবগঞ্জ ও বারঘরিয়া ব্যতীত অন্যান্য স্থানের অধিকাংশ রেশম কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। দেশবিভাগের পর প্রাথমিক বিপর্যয় মোকাবেলা করে শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, বারঘরিয়া প্রভৃতি স্থানে পুনরায় রেশম বস্ত্রে উৎপাদন শুরু হয় এবং হৃত গৌরব প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ঢাকা ও করাচির মতো শহরে বাজারজাত করা হতো। শত শত বছর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমার অধিকাংশ গ্রামের নারীরা ঘরে ঘরে পলু চাষ করে রেশমের গুটি তৈরি করতেন এবং যেখানে–সেখানে তুঁতগাছ ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেক গ্রামে বিভিন্ন ধরনের রেশম বস্ত্র তৈরি হতো। গ্রাম বা এলাকায় শত শত হস্তচালিত তাঁতের খুটখাট আওয়াজে মুখরিত থাকত। হাজারো নারী–পুরুষের কর্মসংস্থান বা জীবন–জীবিকার নিশ্চয়তা বিদ্যমান ছিল। সে তুলনায় রাজশাহী ও আশপাশে পলু চাষের প্রচলন সেভাবে ছিল না এবং রেশম উৎপাদনের ইতিহাস পুরোনো বলা যায় না। তবে যৎসামান্য উৎপাদন হলেও ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না। ১৯৬২ সালে রাজশাহীতে সরকারি উদ্যোগে একটি রেশম কারখানাসহ প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেখানে ১৯৭৭ সালে রেশম বোর্ড গঠন করা হয়। কিন্তু উভয়ই কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এ কারখানায় উৎপাদন ছিল সীমিত এবং রেশম বস্ত্র গুণে ও মানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সমকক্ষ ছিল না। উপরন্তু কাঙ্ক্ষিত উৎপাদনে কোনো সফলতা বা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। কিন্তু বিরাট ক্ষতি ও সুনাম ক্ষুণ্ন করে সে সময়ের মহকুমা চাঁপাইনবাবগঞ্জের।
‘রাজশাহী সিল্ক’ নামে শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, হরিনগর, লাহারপুর প্রভৃতি স্থানের রেশম বস্ত্র বাজারজাত করা হয়। গভীর পরিতাপের বিষয় হলো, গত মধ্য সত্তর দশকের অব্যবহিত পর সামরিক সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কুটির শিল্প হিসেবে রেশম বস্ত্র ধীরে ধীরে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য হয়। সরকার ঢালাওভাবে কৃত্রিম রেশম সুতা আমদানির অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করে। ফল যা হওয়ার তা–ই হলো। অনুন্নত ও মানহীন কৃত্রিম রেশম সুতায় সয়লাব হয়ে পড়ে। ফড়িয়া রেশম সুতা ব্যবসায়ীদের রমরমা উপস্থিতির কারণে হাজার বছরের কায়িক শ্রমলব্ধ রেশম অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। তারপর থেকে শুরু হয় বিশ্ব বাজার অর্থনীতির ছোবল। মুখ থুবড়ে পড়ে কুটির শিল্প রেশম। এ সময় জেলার তুঁতবাগানগুলো আমবাগানে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বেশ কিছু তাঁতে রেশম বস্ত্র উৎপাদিত হলেও সেই রমরমা অবস্থা নেই। আমদানিকৃত কৃত্রিম রেশম সুতা অত্যন্ত নিম্নমানের। আয়ুষ্কাল ক্ষণস্থায়ী, একবার ধৌত করার পর আর ব্যবহার উপযোগী থাকে না। কিন্তু আদি রেশম বার বার ধৌত করা যেত এবং প্রতিবার রেশমের উজ্জ্বল রং ঠিকরে পড়ত, অনায়াসে কয়েক বছর ব্যবহার করা যেত। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে স্বল্প পরিমাণে উন্নতমানের রেশম বস্ত্র উৎপাদন করে পুরোনো আভিজাত্য ধরে রেখেছে এবং বাতিটা এখনো টিমটিম করে হলেও জ্বলছে। বংশপরম্পরায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শত শত তাঁতির এখনো জীবন–জীবিকার একমাত্র অবলম্বন তাঁত। তবে সুতা সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে রেশম বোর্ডের কোনো প্রভাব আগেও ছিল না, বর্তমানেও নেই। প্রকৃত ইতিহাস দেশবাসীর জানা প্রয়োজন এবং উপরোক্ত নিরীক্ষায় এটাও জানা প্রয়োজন যে কীভাবে রেশমের জিআই পণ্যসত্ত্ব অন্য জেলার নামে ছিনতাই হয়ে গেল। ফলে একদিকে ছিনতাই, অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার হাজার হাজার বছরের প্রবহমান সংস্কৃতির ওপর নিষ্ঠুর বজ্রাঘাত।
*লেখক: গবেষক