কলকারখানায় দুর্ঘটনা এড়াতে ‘ভবন নিরাপত্তা’ নিশ্চিত জরুরি
করোনা প্রকোপে ধুঁকছে দেশ। সঙ্গে রয়েছে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে প্রাণহানি এবং প্রিয়জন হারানোর মর্মন্তুদ আহাজারি। মগবাজারে অনাকাঙ্ক্ষিত বিস্ফোরণে প্রাণহানির রেশ কাটতে না কাটতেই ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি হয়েছে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট ২০ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়। ততক্ষণে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করেছে ৫২টি তাজা প্রাণ।
গত দুই সপ্তাহে রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পৃথক একাধিক অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৬০ জন, আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। তাঁদের বেশির ভাগই কলকারখানার শ্রমিক। একদিকে করোনা, অন্যদিকে কলকারখানায় অনাহূত অগ্নিকাণ্ডে নিভে যাচ্ছে শ্রমিকের জীবনপ্রদীপ। অগ্নিনির্বাপকযানের সাইরেন আর অসহায় মানুষের আর্তচিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বলি হচ্ছেন সাধারণ শ্রমিক।
২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধস ও তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধের লক্ষ্য নিয়ে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডাইফ), আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সমন্বিত উদ্যোগে গ্রহণ করা হয় জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনা (এনটিপিএ)। ২০১৮ সালে এসব প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের জন্য রিমেডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেল (আরসিসি) গঠন করা হয়। বায়ার জোটভিত্তিক সংগঠনের বহির্ভূত অধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেড় হাজারের অধিক তৈরি পোশাক কারখানার দুর্ঘটনা রোধকল্পে কাজ করছেন সরকারি কারেক্টিভ অ্যাকশন প্ল্যান (ক্যাপ) বাস্তবায়ন প্রকল্পের ৬০ জন বিশেষায়িত প্রকৌশলী। নাজুক অবকাঠামো, ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা, যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, কারখানার ডিজাইন ড্রয়িং, তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ইত্যাদি তদারক করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রাম জেলাকেন্দ্রিক তৈরি পোশাক কারখানার পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন ক্যাপ বাস্তবায়ন প্রকল্পের প্রকৌশলীরা। তাঁদের নিবিড় তদারকিতে এই ১ হাজার ৫০০ তৈরি পোশাক কারখানায় করোনাকালসহ গত তিন বছরে শূন্য প্রাণহানি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে আরসিসি।
জাতীয় উদ্যোগের আওতায় আরসিসিতে ন্যস্ত কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ৫৪৯টি। এর মধ্যে ঢাকা জেলায় ৬৪৮টি, নারায়ণগঞ্জে ২৯৯টি, গাজীপুরে ৩৭২টি, চট্টগ্রামে ১৯৩টি এবং অন্যান্য জেলায় ৩৭টি কারখানা আছে
২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রকৌশলী কর্তৃক প্রস্তাবিত সংস্কারকাজের ৫০ শতাংশ বা এর কম অগ্রগতি হয়েছে ৩৭১টি কারখানার, ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ অগ্রগতির মধ্যে রয়েছে ৬৭টি কারখানা এবং ১১১টি কারখানার ৭০ শতাংশ এর বেশি অগ্রগতি সম্পন্ন হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন নিরাপত্তাবিষয়ক সংস্কারকাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে ১৫টি কারখানার, এর মধ্য ১টি কারখানা সব ক্ষেত্রে সংস্কারকাজ শতভাগ সম্পন্ন করেছে। আরসিসি প্রকৌশলীদের নিয়মিত পরিদর্শন এবং ডাইফের নিবিড় তদারকির ফলে সংস্কারকাজ অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় ৬২০টি কারখানা কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে এবং ১০৪টি কারখানা অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছে।
ডাইফের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৯-২০ অনুযায়ী, বর্তমান প্রকল্পের সংস্কারকাজের সার্বিক অগ্রগতি (জুন, ২০২০ পর্যন্ত) প্রায় ৪০ শতাংশ, যা শুধু জাতীয় উদ্যোগের আওতাধীন চলমান কারখানাসমূহ বিবেচনা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। আরসিসির পরিদর্শন কার্যক্রমের ফলে জাতীয় উদ্যোগের আওতাধীন ৬২০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে বিধায় কারখানাগুলোয় নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে বিবেচনায় সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৬০ শতাংশ বলা যায়।
কলকারখানার দুর্ঘটনার হতাহত হওয়ার ঘটনা যথাযথ পূর্বসতর্কতা গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। সঠিক কর্তৃপক্ষের যাচাইকৃত অনুমোদন, সঠিক দুর্ঘটনাকালের জরুরি ব্যবস্থা পূর্বনিশ্চিতকরণ এবং শ্রমিকদের সচেতনতা বৃদ্ধিসহ এ ধরনের পদক্ষেপগুলো কলকারখানার দুর্ঘটনা প্রতিরোধের নিয়ামক। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানা ভবনটি ছয়তলা। প্রতিটি ফ্লোর ৩৫ হাজার বর্গফুটের। সম্পূর্ণ ভবনটিতে সিঁড়ি ছিল মাত্র দুটি। এ আয়তনের একটি ভবনে অন্তত চারটি সিঁড়ি বা বহির্গমনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। যে কারণে অগ্নিকাণ্ডের সময় এত বিপুলসংখ্যক শ্রমিক মাত্র দুটি সিঁড়ি ব্যবহার করে বের হতে পারেননি। এ কারণে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানি হয়, যা সহজেই এড়ানো যেত। ফায়ার সার্ভিস বলেছে, ‘বিল্ডিং কোড’ মেনে পর্যাপ্ত সিঁড়ি রাখা হলে এত প্রাণহানি হতো না।
দেশজুড়ে এমন অসংখ্য অনিরাপদ কারখানা ভবন রয়েছে, যেগুলোকে যথাযথ তদারকির অধীনে নিয়ে সেগুলোর সার্বিক নিরাপত্তা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব। এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রশিক্ষিত ও বিশেষায়িত জনবল দিয়ে কলকারখানাগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা তদারকি করাই একমাত্র সমাধান। ক্যাপ বাস্তবায়ন প্রকল্পের অধীনে পারদর্শী প্রকৌশলী তথা জনবল সরকারের অধীনেই রয়েছে। শুধু তৈরি পোশাক নয়, ফায়ার সার্ভিসের নিরাপত্তা পরিকল্পনা, প্রকৌশল জ্ঞান আর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তদারকির সমন্বয়ে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সব ধরনের কলকারখানাকে সংস্কারকাজ সমন্বয় কেন্দ্র আরসিসির অধীনে এনে দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী সমাধান করতে হবে। যদিও সম্প্রতি প্রকল্পের মেয়াদ ও অর্থ বরাদ্দসংক্রান্ত জটিলতার জন্য প্রতিষ্ঠানটির কাজ স্থগিত রয়েছে। অনিশ্চয়তায় আছে সংস্কারকাজ তদারকি।
নিরাপদ ও শ্রমিকবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে কলকারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। নয়তো অপার সম্ভাবনার দেশ অপার দুর্ঘটনার দেশে রূপান্তরিত হবে, যা দেশের শিল্প খাত এবং রপ্তানি খাতকে ব্যাহত করবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
*লেখক: মনজিল হাসান, প্রকৌশলী (ফায়ার) এবং অমিত পাল, প্রকৌশলী (স্ট্রাকচারাল), ক্যাপ বাস্তবায়ন প্রকল্প।