একজন মা এবং তার বিসর্জনের গল্প

মায়ের সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীতে মায়া-মমতা-ভালোবাসা এবং কি বিসর্জনের মতো বোধগুলোর যদি কোনো পার্থিব রূপ থাকত, তাহলে সে হয়তো একজন মায়ের মতোই দেখতে হতো। পৃথিবীতে মা হচ্ছে এমন একমাত্র সম্পর্ক, যার সৃষ্টি স্বয়ং আত্মত্যাগকেই সংজ্ঞায়িত করেছে এর স্বমহিমায়। শত সহস্র নির্ঘুম রাত, শিরা থেকে ধমনি অব্দি প্রভাবিত প্রতিটি রক্তকণিকা নিংড়ে বেরিয়ে আসা শরীরী আর্তনাদ এসব আত্মত্যাগের পরম সাক্ষী। একজন মায়ের কাছে সন্তান হচ্ছে তার আত্মার পরম আত্মীয়, এক অভিন্ন সত্তার সঙ্গী, অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। মা হচ্ছেন এমন একজন বিচারক, যার আঁচলে বাঁধা সুখগুলোকে সে ছড়িয়ে দিতে পারে প্রতিটি সন্তানের কাছে অত্যন্ত নির্ভুলভাবে।

সন্তান আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, মাতৃগর্ভে আমি তার প্রতিটি নিশ্বাস লুফে নিয়েছি আমি বাঁচব বলে, আমি তার মুখের ভাষার প্রতিটি শব্দ-ধ্বনি শিখে নিয়েছি আমি কিছু বলব বলে, আমি তার আঙুলগুলো অত্যন্ত শক্ত করে ধরে রেখেছি আমি চলব বলে, আমি দুগ্ধকণিকা শুষে নিয়েছি আমি ক্ষুধার্ত বলে, স্মৃতির ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য আবদারে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছি আমি হাসব বলে।

তাই তো বলি একটি সন্তানের হাজার জনমের বেঁচে থাকা প্রতিটি নিশ্বাসও যদি অবিরত তার মায়ের পূজা করে, তবু তার ঋণ পরিশোধযোগ্য নয়। তাই তো শুধু বারবার বলতে ইচ্ছা হয়, মা গো, তুমি আমায় আর একটিবার জনম দেবে? সে জনমে না হয় শুধু তোমার হয়েই থাকব, তোমার প্রতিটি কথা আমি শুনব। মা গো, তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাব অবিরত ভোর না হওয়া রাত্রি, মা গো, তখন তোমার সেই ডানপিটে ছেলেটিকে একটু বেশি করে বকে দিয়ো, আমার তাতে একটুও আর মন খারাপ হবে না, নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে আর কোনো জ্বলন্ত দুপুরে কিংবা রাতের আঁধারে ঘুরে বেড়াব না, আমি শুধু তোমার পাশেই থাকব তোমার আঁচলের একটি কোনা ধরে, সেই তোমার ছোট্ট আমি যেমনটি ছিলাম। কারণ, আমি তো জেনেই গেছি মায়ের প্রতিটি নিশ্বাস তার সন্তানের জন্য আশীর্বাদ বহন করে।

আমাদের সমাজে একজন মা এবং তার প্রতিদিনের জীবনধারায় যে অসংখ্য বিসর্জনের গল্পের সমারোহ, তার কিঞ্চিৎ অঙ্কন প্রয়াসেই একটি ছোট্ট ঘটনা তুলে ধরলাম।
আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগের ছোট্ট একটি মেয়ের গল্প। ছয় ভাইবোনের পরিবারে সেই মেয়েটিই বড়। তারা ঢাকায়ই থাকে। বাবা সরকারের উচ্চপদস্থ একজন কর্মচারী।

পরিবারে অঢেল প্রাচুর্য না থাকলেও সুখের অভাব ছিল না সেখানে। অমন একটি সুখী পরিবারে নিজের সাধ-আহ্লাদের সম্পূর্ণতা নিয়েই বড় হতে থাকে মেয়েটি। শৈশবের সেই দুরন্তপনা, লাল-কালো ফিতায় সাজানো দুই ঝুঁটি করে বান্ধবীদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়া, টিফিনের ফাঁকে আচার আর ঝালমুড়ি খাওয়া, সেই সঙ্গে দল বেঁধে গোল্লাছুট আর দাঁড়িয়াবান্ধা খেলা—এই সবই যেন ছিল মেয়েটির প্রতিদিনের ছুটে চলা জীবনের একটি অংশ, স্কুলের মাঠের বুকে প্রতিটি কোনায় প্রতিটি ঘাসেই যেন ছিল তার স্পর্শ, হয়তো ঘাসের ফাঁকে কোনো এক লজ্জাবতীগাছ রোজ অপেক্ষা করত মেয়েটির স্পর্শে নুইয়ে পড়বে বলে। কিন্তু এ তো ছিল মেয়েটির আপন ভুবনের একান্ত আপন কিছু স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ।

কিন্তু তখনকার সমাজের একটি স্কুলপড়ুয়া মেয়ের নিজস্ব মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণার মধ্যে ছিল বিস্তর ফারাক। তার ওপর মেয়েটির বাবার কাছে পাঁচ মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার বিশাল দায়িত্ব। তাই তো মেয়েটিকে ওই অল্প বয়সেই জীবনের চরম বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে শুরু করতে হয়েছিল তার সংসারজীবন, বিনিময়ে তাকে বিসর্জন দিতে হয়েছিল তার স্কুলজীবন, সহপাঠী এবং কি বড় হয়ে হতে চাওয়া একঝাঁক রঙিন স্বপ্ন। সেই সঙ্গে আরও হারাতে হয়েছে ছোট্টবেলার খেলার সাথি, আর হইহুল্লোড় করে ঘুরে বেড়ানো প্রতিটি মুহূর্ত।

অবশেষে মেয়েটির বিয়ে হয় ঢাকা থেকে বেশ দূরের একটি গ্রামে, আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগের একটি গ্রামে। স্বভাবতই তখন সেখানে ছিল না বিদ্যুৎ, ছিল না পাকা রাস্তা।

আর ফোন তো স্বপ্নেও দুষ্প্রাপ্য সেই সময়। তাহলে একটিবার চিন্তা করেন তো পরিবারের সবাইকে ছেড়ে এত দূরের একটি যোগাযোগবিচ্ছিন্ন গ্রামে, একটি মেয়ের জন্য কতটুকু কষ্টের হতে পারে তার এই জীবনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে। যেখানে একটি চিঠির জন্য যাকে এক মাস পথ চেয়ে অপেক্ষা করতে হতো। সবাইকে ছেড়ে আসার যে কষ্ট, সেগুলো কান্না হয়ে নীরবে তার বালিশের এক কোনা ভিজিয়ে দিত, শতসহস্র নির্ঘুম রাত তার নীরব সাক্ষী, কিন্তু আজকের এই থ্রি-জি আর ফোর-জির যুগে বসে ঠিক ওই মুহূর্তগুলোতে একটি মেয়ের হৃদয়ের যে অনুভূতি, জীবনসংগ্রামে টিকে থাকার প্রয়াসে যে বিসর্জন, তা গল্পের রূপে উপস্থাপন করা সম্ভব হলেও পরিপূর্ণ অনুভব করা দুঃসাধ্য।

ছবি: সংগৃহীত

যা-ই হোক, মেয়েটি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নিজের জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করে হলেও সংসারে সবাইকে যেন সুখী রাখতে পারে। এভাবেই চলতে চলতে সেই ছোট্ট মেয়েটি একসময় সন্তানের মা হয়, জীবনসংগ্রামে যুক্ত হয় নতুন কিছু দায়িত্ব। বাবার বাড়ি খুব একটা যাওয়ার সুযোগ নেই। সন্তানেরাও বড় হতে থাকে। তারা পড়ালেখা করে। বছর শেষে বাচ্চাদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলেই একমাত্র বাবার বাড়িতে যাওয়া সম্ভব। বাবা মেয়েটির একমাত্র ভাইকে পাঠাবে, সেই আশায় কতই না পথ চেয়ে বসে থাকে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না। কারণ, সে যে বাড়ির বউ, একজন মা—এত সাধ-আহ্লাদ তার থাকতে নেই যে। প্রতিবছর এক দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর শেষে ভাইয়ের সঙ্গে সে তার মা-বাবার কাছে যায়। সেখানে কিছুদিনের জন্য সবাইকে কাছে পেয়ে আবার যেন সেই পুরোনো জীবনকে ফিরে পাওয়া, এ যেন সংসারের ব্যস্ত জীবন থেকে কয়েকটি দিনের জন্য ছুটি নেওয়া, সময়গুলো বোধ হয় একটু তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। আবার ফিরতে হবে সংসারে। প্রতিবার ফেরার সময় খুব কষ্ট হয় মেয়েটির, মায়ের বুকে মাথা রেখে অনেক কাঁদে। মা-বাবা দুজনেই বুকের ভেতর এক কষ্টের পাহাড় চেপে রেখে মেয়েকে সান্ত্বনা দেয় (মা, তুই যা। আমরা কয়েকটা দিন পরেই আসতেছি)। সব মায়া, মমতা আর ভালোবাসার পিছুটান বিসর্জন দিয়ে দুচোখ ভরে আসা জলকে নিতান্তই তুচ্ছ করে আবার সংসারসংগ্রামে তার ফিরে যাওয়া।

জীবনসংগ্রামের এ পথ ধরে চলতে চলতে কোনো এক বাঁকে এসে হারাতে হয় তার বাবাকে। কিছুদিন পর মা-ও চলে যায় তাকে ছেড়ে। তাই পেছনের সব ভালোবাসা আর আবেগপ্রবণ সব ভালো লাগা আজ শুধুই স্মৃতির অ্যালবামে সাজানো। আজকাল তার সংগ্রামী জীবন শুধু সন্তানদের ঘিরেই। আজও সে কাঁদে, তবে তা হয়তো আগের মতো মাকে ছেড়ে আসার কষ্টে নয়, এখন সে কাঁদে তার মেয়ের বিদায়ে, হয়তো অতীতের হারিয়ে যাওয়া খুব কাছের কিংবা ভালোবাসার মানুষগুলোকে ফিরে না পেয়ে। এখন হাসে কোনো এক উৎসবে, যখন সব সন্তান একসঙ্গে হয়। তার চোখের সামনে বসে যখন তার সন্তানেরা পছন্দের খাবারগুলো পেট পুরে খায়। এখন হাসে হয়তো কারণে আর অকারণে ডাকা মা শব্দটি যখন কানে ভেসে আসে। অবশেষে বলতে হয়, হাজারো বাংলা মায়ের হাজার বছরের গল্পগুলো যেন এমনই ছিল, আসলে মায়েরা এমনই হয়।

*লেখক: মো. মেহেদি হাসান রনি, এজিএম ওপেক্স গ্রুপ