অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে রাষ্ট্র ও জনতার দায়িত্ব কতটা

একেক ধরনের আগুন নেভানোর উপায়ও ভিন্ন
ছবি: প্রথম আলো

গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে প্রকৃতি থাকে উত্তপ্ত। ফলে এ সময়টা দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কোথাও স্বল্প পরিসরে, আবারও কোথাও–বা ভয়াবহ। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে যত বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তার সব কটিই বলা যায় রাজধানী শহর ঢাকাতে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সেজান জুস কোম্পানিতে আগুনে হতাহতের ঘটনায় বিষয়টি নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে, কেন অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না?

ক্ষয়ক্ষতি যেমনই হোক না কেন, আগুন কিন্তু সব সময় মারাত্মক। কারণ, আগুনে পুড়ছে মানুষের সঙ্গে তাদের স্বপ্ন। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের সব বিভাগ থেকে ঢাকায় দুর্ঘটনার সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতি বেশি। ২০২০ সালে ১৮ হাজার ১০৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত দুই শতাধিক মানুষ। ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১৫৯ কোটি ২৫ লাখ টাকার সম্পদের। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এর আগের বছর ২০১৯ সালে ২৪ হাজার ৭৪টি অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি হয় ১৮৪ জনের। এর মধ্যে ১২৫ জন ছিল ঢাকার, ৪৪ জন চট্টগ্রামের, ৬ জন বরিশালের, রংপুরের ৪ জন, সিলেটের ৪ জন এবং ময়মনসিংহের ১ জন। এসব অগ্নিকাণ্ডে সম্পদের ক্ষতি হয় ৩৩০ কোটি ৪১ লাখ ৫৬ হাজার টাকার।

অগ্নিকাণ্ড এখন যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কেন এত দুর্ঘটনার শিকার ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরসংলগ্ন এলাকা? কারণ খুঁজলে উত্তর হলো, এসব অল্প জায়গায় বেশি মানুষ বসবাস করে। অনেক অপরিকল্পিত ও অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে। নতুন নতুন ইলেকট্রিক গ্যাজেট, ল্যাপটপ, মুঠোফোনের চার্জারসহ অন্যান্য দাহ্য পদার্থের প্রাপ্যতা বেশি। তাই ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডসহ অন্যান্য দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি। আগুন শুধু ঢাকাকেই পছন্দ করে, না আমি মনে করি আগুনের পছন্দ অসচেতন জনগণ। সে ঢাকারও হতে পারে, হতে পারে বাংলাদেশ বা বহির্বিশ্বের। এ অসচেতন জনগণকে জানাতে হলে আগে আমাদের মনে রাখতে হবে বা জানতে হবে অগ্নিকাণ্ডের উপকরণ, কারণ ও এই ব্যাপারে কী কী সাবধানতা আমাদের নেওয়া প্রয়োজন।

সবার আগে বুঝতে হবে অগ্নিকাণ্ডের জন্য কী কী উপাদান কাজ করে। অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম উপকরণ হলো অত্যধিক তাপ, জ্বালানি ও অক্সিজেন। আগুন অথবা অত্যধিক তাপ হতে পারে, সেটা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট অথবা অন্য কোনো মাধ্যম থেকে। আগুন যদি না–ও থাকে, অত্যধিক তাপ থেকেও কিন্তু অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে।
অগ্নিকাণ্ডের অনেক কারণ আছে। বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ধরন ও প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য থেকে দেখা যায় যে বেশির ভাগ অগ্নিকাণ্ডের কারণই বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট। বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় তাড়াহুড়ো করেই হোক আর খরচ বাঁচাতে গিয়েই হোক, নিম্ন মানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে সহজেই তা থেকে শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লাগছে। পোশাকশিল্পে আগুন লাগার ক্ষেত্রে বিশেষত যে কারণটি লক্ষ করা যেতে পারে, তা হলো কর্মরত অধিকাংশ শ্রমিক কর্মচারী ধূমপান করেন। যখন বিরতি দেওয়া হয় তখন অনেকেই এখানে–সেখানে দাঁড়িয়ে ধূমপান করেন। এরপর যখন ঘণ্টা বা সাইরেন বাজে কাজে ফিরে যাওয়ার তখন অনেকেই হাতের সিগারেট বা বিড়ির অবশিষ্টাংশটুকু যত্রতত্র ফেলে দেন। সেই রেখে যাওয়া সিগারেটের অল্প একটু আগুন ভেতরের তাপে আরও বেশি উত্তপ্ত হয় এবং একসময় ভয়াবহ আগুন হিসেবে সব জ্বালিয়ে দেয়। মশার কয়েল থেকেও অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে।

আর ঘটমান এই অগ্নিকাণ্ডগুলো ভয়াবহ হওয়ার কারণ বিশ্লেষণে উঠে আসে যে শপিং মল কিংবা কারখানাগুলোতে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে সহজে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে না। কোনো এক ফ্লোরে আগুন লাগলে সঙ্গে সঙ্গে যদি অটো অ্যালার্মিং সিস্টেম চালু থাকে, তবে অন্য ফ্লোরে অবস্থানরতরা আগেই স্থান ত্যাগ করতে পারে। এ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে অন্তিম মুহূর্তে সবাই বুঝতে পারে আগুন লেগেছে। ফলে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। হতাহতের সংখ্যাও বাড়ে। আর ভবন তৈরির আইনটি তৈরি হয়েছে ২০০৬ সালে। ফলে অনেক ভবন আগে তৈরি দুর্ঘটনার সময় হতাহতের পরিমাণ বাড়ে। গলদ রয়েছে অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহৃত সরঞ্জাম নিয়েও। এ মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন ফায়ার সার্ভিস ব্যবস্থার আধুনিকায়ন।

যান্ত্রিক এই কারণগুলো ছাড়াও অন্যতম কারণ হলো সাধারণ জনতার নিরক্ষরতা ও আগুনের বিষয়ে শিক্ষার অভাব। আমেরিকায় সাধারণ জনতাকেও আগুনের ব্যাপারে শিক্ষিত করা হয়। স্কুল-কলেজে শেখানো তো হয়ই, কর্মক্ষেত্রেও নিয়মিত ট্রেনিং দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এমন ব্যবস্থা আছে বলে আমি জানি না। তা ছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা নেই। ফলে আগুন ভয়াবহ রূপ ধারণ করার সময় বা সুযোগ পায়। আগেই বলেছিলাম, আগুন শুধু আর্থিক ক্ষতি করে না, একটি স্বপ্নকেও কেড়ে নেয়। তাই কোথাও কোনো অবস্থাতেই আগুন লাগুক, এটা কারও কাম্য হতে পারে না। সচেতনতাই পারে এর থেকে আমাদের রক্ষা করতে। তবে এই সচেতনতার জন্য তাহলে আমাদের করণীয় কী, তা–ও কিন্তু জানতে ও জানাতে হবে। উচিত হবে, আগুন যেন না লাগে, সেটা খেয়াল রাখা। অফিস–আদালতে আগুন নিয়ে কাজ কারবার না করাই ভালো।

ঘরের ভেতরে ম্যাচের কাঠি, সিগারেট, লাইটার ইত্যাদি অ্যালাউ না করা। চুলা জ্বালানো কাজে ওসব লাগলে নির্দিষ্ট স্থানে রাখা। বাড়ির বাইরেও জ্বলন্ত সিগারেট, জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি যেখানে–সেখানে ছুড়ে না ফেলা। বৈদ্যুতিক তার, সার্কিট ইত্যাদি নিয়মিত চেক করা। যদি কোথাও কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়, তাহলে দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়া। অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, বৈদ্যুতিক আগুনে পানি ঢালা চলবে না। এতে আগুন ভয়াবহ রূপ নেবে। সে ক্ষেত্রে আপনাকে মেইন সুইচ অফ করে দিতে হবে। তারপরে ফোম বা বালু ছিটাতে হবে। কিন্তু পানি নয়। দাহ্য পদার্থ বাড়িতে না রাখা। রাখলেও সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করা। বিশেষ করে যেখানে আগুন লাগার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকে, সেখানে অবশ্যই এসব পদার্থ না রাখা। প্রতিটা কমার্শিয়াল দালানে ইমার্জেন্সি ফায়ার এক্সিট রাখা, যদি না থাকে, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা করা। যদি তারপরও কেউ ব্যবস্থা করতে না চান, তাহলে আইনের আওতায় এনে শাস্তির বিধান করা। ফায়ার এক্সিট না থাকলে কোনো কমার্শিয়াল ভবন নির্মাণের অনুমতি না দেওয়া।

প্রতিটা দালানের প্রতি তলায় কিছু দূরত্বে অগ্নিনির্বাপকের ব্যবস্থা থাকা, যাতে হাতের নাগালে পাওয়া যায়। সেই দালানে নিয়মিত কাজ করা প্রায় প্রত্যেক কর্মচারীকেই অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেটার ট্রেনিং দেওয়া। মাসে একবার হলেও নিয়মিত ফায়ার ড্রিলের ব্যবস্থা করা। ফায়ার অ্যালার্ম বাজিয়ে ভবন খালি হলে কোন দিক দিয়ে বেরোতে হবে, সেটা অনুশীলন করা, যাতে বাস্তবে আগুন লাগলে মানুষ দিশেহারা হয়ে না যান। কোনো ঘটনা থেকে কেবল শিক্ষা নিয়ে বসে থাকলেই পরবর্তী ঘটনা আটকানো যায় না৷ কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তার যথাযথ কারণ বের করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই যে কোনো সভ্য সমাজের রীতি। কিন্তু আমরা তা করি না। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন আইন মেনে চলার অভ্যাস নেই, সাধারণ মানুষকে আইন মানানোর বাধ্যকতা সৃষ্টির জন্য যেসব কর্তৃপক্ষ আছে, তারাও হাত-পা গুটিয়ে বসে।

দেশে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি খুবই অপ্রতুল। বিশেষ করে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে। যে ক্ষেত্রে আগুন নেভানো, মানুষকে সরিয়ে নেওয়া এবং জরুরি উদ্ধারকাজ পরিচালনা করা দরকার, সেসব ক্ষেত্রে আমরা সাধারণ জনতা ফটোসেশনে আর ভিডিওতে মগ্ন থাকি বিবেকহীনভাবে, যদি অগ্নিকাণ্ড সবার জন্য বিপজ্জনক হয়, তবে আসুন সবাই আগুনের নিরাপদ ব্যবহার করি ও সচেতন থাকি। নিজেকে নিরাপদ রাখি।


* লেখক: তারেক তানভীর, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়