জিডিপি কিংবা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি মানেই কি সমৃদ্ধি

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের (২০১৯-২০) মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বাস, ট্রাক, ট্রেন—এসবের মূল্য সংযোজন আগের বছরের চেয়ে ৪ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা বেড়েছে।

স্নাতকের পড়ার সময় জিডিপি নিয়ে অল্প কিছু জেনেছিলাম অর্থনীতির ওপর একটি কোর্স করার কারণে। ওই সময় জেনেছিলাম, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি একটি দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা, টক শো, বাজেট আলোচনায় কিংবা সংবাদপত্রে এ জিডিপি নিয়ে অনেক কথাই শুনি আমরা। কোনো রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি গ্রহণযোগ্য মাপকাঠি হিসাবে আমরা জানি জিডিপিকে। কিন্তু যুক্তরাজ্যে স্নাতকোত্তর অধ্যয়নকালে যখন ‘হোয়াই জিডিপি ইজ নট আ গুড মেজার ফর ইকোনমিক ওয়েলবিং’ নামক একখানা রচনা লেখার ওপর কাজ করেছিলাম, তখন আমার সে ধারণা অনেকটাই পাল্টে যায়। বুঝলাম, জিডিপি নিয়ে আমাদের অনেক মোহ থাকলেও ব্যাপারটির মধ্যেই একটা গোলমাল আছে। বুঝলাম, জিডিপি প্রবৃদ্ধি মানেই কেবল অর্থনীতির উন্নতি নয়।

একসময় উন্নয়ন অর্থনীতিবিদেরা মনে করতেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি মানেই উন্নয়ন। অনেকেই বলতেন, প্রবৃদ্ধি যত বাড়বে, তত এর সুফল গড়িয়ে ওপর থেকে নিচের দিকের মানুষের কাছে যাবে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষেরও আয় বাড়বে। অর্থনীতির ভাষায় ধারণাটিকে বলা হয় ‘ট্রিকল ডাউন থিওরি’। তবে উন্নয়নের এ ধারণা বেশ আগেই পরিত্যাগ করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। কারণ বাস্তবে দেখা যায়, প্রবৃদ্ধি যত বাড়ে, আয়বৈষম্য বাড়ে তার চেয়ে বেশি। আর তাই জিডিপি প্রবৃদ্ধি মানেই যে অর্থনীতির উন্নতি নয়, সেই ফয়সালাও হয়ে গেছে এত দিনে। এমনকি প্রবৃদ্ধি বাড়লে এর ছিটেফোঁটা চুঁইয়ে নিচে নামার যে ‘ট্রিকল ডাউন’ নীতি, সেটাও ভুল প্রমাণিত হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

তবে উন্নয়ন অর্থনীতিবিদেরা জিডিপিকে পরিত্যাগ করলেও অনেক রাষ্ট্র ও সরকার কিন্তু এখনো জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে খুবই ভালোবাসে। ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের যে জিডিপি নিয়ে আগ্রহ একটু বেশি, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এর পেছনে অবশ্য কিছু কারণ আছে। যেমন, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে একটি দেশের ভাবমূর্তির সম্পর্ক রয়েছে। প্রবৃদ্ধি বাড়লে একটি দেশের ভাবমূর্তি বাড়ে বলে মনে করা হয়। দেশটির প্রতি বিনিয়োগকারীদেরও আকৃষ্ট করা যায়। ফলে, সরকারের কৃতিত্বও বাড়ে। এককথায় এর একধরনের রাজনৈতিক মূল্য আছে। আর তাই সরকারও জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে থাকে। কোনো কোনো রাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা এতটাই প্রবল যে তারা পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচে জিডিপি বাড়াতে চেষ্টা করে।

২.
জিডিপি আবিষ্কার করেছিলেন সাইমন কুজনেতস নামের এক রাশিয়ান মার্কিন অর্থনীতিবিদ। তিনি ১৯৭১ সালে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন। মজার কথা হলো, এই কুজনেতস নিজেই পরে তাঁর উদ্ভাবিত জিডিপির দুর্বলতা নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জিডিপি দিয়ে দেশের মধ্যে কলকারখানা, চাষের জমি কিংবা ব্যবসায় মোট কতখানি উৎপাদন হচ্ছে, তা আঁচ করা যেতে পারে বটে; কিন্তু মানুষের জীবনে কী উন্নতি হলো, তার জীবনযাত্রায় কতখানি স্বাচ্ছন্দ্য এল, সে তার ছেলেমেয়েকে ভালো স্কুলে পাঠাতে পারল কি না বা অসুখ-বিসুখে ভালো ডাক্তার পেল কি না, তা এ দিয়ে মাপা যাবে না।

মার্কিন ডলার

জিডিপি নিয়ে অনেকটা একই রকম কথা বলেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাই রবার্ট কেনেডি। ১৯৬৮ সালের ১৮ মার্চ ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাসে দেওয়া বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘জিডিপি আমাদের শিশুদের স্বাস্থ্য, স্কুলের শিক্ষার মান কিংবা খেলার আনন্দকে গোনায় ধরে না। আবার জিডিপি আমাদের কবিতার সৌন্দর্য কিংবা বিয়ে ব্যবস্থার শক্তির দিক, বুদ্ধিদীপ্ত গণবিতর্ক কিংবা সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মনিষ্ঠাকেও গোনায় ধরতে জানে না। এমনকি আমাদের বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ, সাহস, প্রজ্ঞা, শিখতে পারার ক্ষমতা, আমাদের আবেগ, আমাদের দেশভক্তি—কোনো কিছুকেই গোনায় ধরে না এই জিডিপি। আসলে জিডিপি সবকিছুই মাপে, কেবল যা যা আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে, সেসব ছাড়া।’ তার মানে কী দাঁড়াল? এর মানেটা তাহলে দাঁড়াল, জিডিপির সঙ্গে মানুষের জীবনে উন্নয়নের সম্পর্ক নেই। আর জীবনমানের উন্নয়ন যদি নাই বোঝা গেল, তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে কি উন্নয়ন হিসেবে ধরে নেওয়া সমীচীন হবে? আসলেই জিডিপি কিংবা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি মানেই ভালো থাকা নয়।

৩.
উন্নত দেশগুলোয় ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক জিডিপির তথ্য প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল এবং অন্য অনুন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণত বার্ষিক জিডিপির তথ্য প্রকাশ করা হয়ে থাকে। জিডিপি শব্দটির ইংরেজি অর্থ হলো ‘গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট’ যা বাংলায় ‘মোট দেশজ উৎপাদন’। জিডিপি হলো কোনো একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিমাপক। কোনো একটি দেশে কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উৎপাদিত অথবা তৈরিকৃত মোট পণ্য এবং সেবার সমষ্টিকেই জিডিপি নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, বহু দিন ধরে প্রচলিত এই পরিমাপক আমাদের ভালো থাকার জন্য যা যা নিতান্তই দরকার, তার অনেক কিছুই পরিমাপের সময় আমলে নেয় না। জিডিপি কিংবা জাতীয় আয়ের সঙ্গে গোলমালের সূচনা আসলে এখানেই। জিডিপি উৎপাদন কিংবা উন্নয়নপ্রক্রিয়ার জড়িত সব কর্মকাণ্ডের প্রভাব সামগ্রিকভাবে দেশের বা জনগণের জন্য ইতিবাচক না নেতিবাচক, সেই হিসাবের ধারও ধারে না।

কয়েকটা উদাহরণে ব্যাপারটি দেখার চেষ্টা করি। জিডিপি একটি বছরে কতটা গাড়ি উৎপাদন করা হলো, সেটি হিসাবে নেয়, কিন্তু এটি নির্গমনের মাধ্যমে পরিবেশের কতটা ক্ষতি করল, সেই হিসাব করে না। এটি বছরে কত টাকার কোমল পানীয় বিক্রি হলো, সেটা হিসাবে নেয়, কিন্তু এ কোমল পানীয় পানের ফলে শারীরিক যে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, সেটা হিসাব করে না। এটি নতুন নির্মাণকৃত দালানের মূল্যকে আমলে নেয়, কিন্তু এর ফলে বনজঙ্গল ধ্বংস হচ্ছে কি না, তা আমলে নেয় না। পরিবেশের যে আমরা মারাত্মক ক্ষতি করছি, তার কোনো প্রতিফলন জিডিপিতে নেই।
আর তাই তো চোখধাঁধানো প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহরের একটি। আর আমরা বিশ্বের অন্যতম দূষিত দেশের মধ্যে একটি। দেশের বায়ুদূষণ বেড়ে গেছে অনেক। এ বছরের ২৪ এপ্রিলের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ঢাকার স্কোর ছিল ৪৮৯, যা ‘মারাত্মক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

একিউআই মান ২০১ থেকে ৩০০ হলে, স্বাস্থ্য সতর্কতাসহ তা জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। যার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারে নগরবাসী। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। আর একিউআই মান ৩০১ থেকে ৪০০ হলে শহরের বাতাসের মান মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ’। ৪০১ থেকে ৫০০ হলে এটাকে ‘মারাত্মক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বাজেট
সূত্র: প্রথম আলো

জিডিপির আরেকটি দুর্বলতা আছে। এটি ক্রমবর্ধমান আয় ও সম্পদের বৈষম্য বুঝতে পারে না। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আয়বৈষম্য বেড়ে চলছে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘সর্বশেষ খানার আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬’ শীর্ষক জরিপে দেখা যায়, দেশের ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর কাছে মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ আয় কুক্ষিগত আছে। অন্যদিকে, ১০ শতাংশ সবচেয়ে গরিবের কাছে আছে দেশের মোট আয়ের ১ শতাংশ। ২০১০ সালে ও বিবিএস এ রকম একটা জরিপ করেছিল। সে সময় দেখা গিয়েছিল, দেশের ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর কাছে জমা ছিল মোট আয়ের ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ ছয় বছরে ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর আয় বেড়েছে মোট আয়ের ৩ শতাংশ। এ জরিপ বলছে, দেশের মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের মালিক ওপরের দিকে থাকা ৩০ শতাংশ মানুষ।

গিনি সূচক

১৯১২ সালে ইতালিয়ান সমাজবিজ্ঞানী এবং পরিসংখ্যানবিদ করারাডো গিনি সমাজে সম্পদ বণ্টন পরিমাপের একটি উপায় তৈরি করেছিলেন, যা গিনি সূচক বা গিনি সহগ হিসেবে পরিচিত। এর মান ০ থেকে ১ পর্যন্ত। শূন্য বা এর কাছাকাছি মান হলে তাকে সাম্য বা নিম্ন আয়বৈষম্যের দেশ ধরা হয়। আর গিনি সহগ শূন্য দশমিক ৫ পেরিয়ে গেলে তাকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ বলা হয়। অর্থনীতিশাস্ত্রে আয়ের বৈষম্য পরিমাপ করা হয় এ গিনি সূচক বা সহগের মাধ্যমে। দেশে সর্বশেষ গিনি সহগ পরিমাপ করা হয় ২০১৬ সালে। সর্বশেষ হিসাবে বাংলাদেশের গিনি সহগের মান শূন্য দশমিক ৪৮৩। অর্থাৎ দশমিক ৫-এর খুবই কাছে। তার মানে বাংলাদেশও একটি উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

৪.
অর্থনীতির কিছু বিষয়কে অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরেছিলেন ড. আকবর আলি খান ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইটিতে। এককথায় অর্থনীতি বিষয়ে বইটি অনবদ্য। পরবর্তী সময়ে তাঁর ‘আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি’ বইয়ে তিনি নতুন কিছু বিষয়কে আরও আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরেছেন পাঠকদের সামনে। সেখানে সুখস্থান নামের এক দেশের একটি গল্প লিখেছেন।

গল্পখানা এ রকম। সুখস্থান নামক দেশে ১০০ জন সুদর্শন যুবক বাস করে, যাদের প্রত্যেকের আয় বছরে এক কোটি টাকা। তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে একজন করে গৃহপরিচারিকা আছে। বছরে তাদের বেতন এক লাখ টাকা করে। জাতীয় হিসাবে সুখস্থানের মোট জাতীয় উৎপাদন ১০১ কোটি টাকা আর মাথাপিছু আয় ৫০ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

একদিন এ যুবকেরা তাদের নিজ নিজ গৃহকর্মীকে বিয়ে করে ফেলে। স্ত্রীরা এখন খুশি হয়ে নিজের সংসারে আগের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে। স্বামীরাও আগের চেয়ে বেশি সুখে থাকে। এখন সবার সুখ বেড়ে গেছে। অথচ নতুন হিসাবে রাজ্যের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৫০ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৫০ লাখে নেমে গেছে। কারণ, বিয়ের আগে গৃহকর্মীরা বেতন পেত। কিন্তু স্ত্রী হওয়ার পর তারা একই কাজ করে, কিন্তু এখন আর বেতন পায় না। স্ত্রীকে স্বামী যে অর্থ দেয়, তা জাতীয় আয়ের হিসাবে আসে না। কাজেই দেখা গেল, সুখস্থান রাজ্যে সবার সুখ যদিও বেড়ে গেছে, কিন্তু মোট জাতীয় উৎপাদন ও মাথাপিছু আয় কমে গেছে।

এক বছর পর দেশটির সব দম্পতি তাদের বিবাহবার্ষিকীতে নিজেদের নতুন গাড়িতে চড়ে বেড়াতে গেল। ফেরার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় ১০ জন স্ত্রী মারা যায়। ১০ জন স্বামী প্রত্যেকে একটি করে পায়ের আঙুল হারায়। আরও ২০ জন হাসপাতালে দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে যায়। এক বছর পর দেশের নতুন হিসাবে দেখা গেল, রাজ্যে মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে; কারণ, ১০ জন স্ত্রী মারা যাওয়ায় জনসংখ্যা যদিও কমেছে অথচ সব পুরুষ জীবিত থাকায় মোট জাতীয় উৎপাদন বেড়ে গেছে। কেননা, হাসপাতালে মৃতদের সৎকারকারীদের এবং গাড়ি মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় বেড়েছে ওই সময়ে।

পরের বছর ঘটল আরেক ঘটনা। সেনাবাহিনী নিয়ে নিল দেশের ক্ষমতা। ক্ষমতায় এসেই দেশের সবাইকে অতিরিক্ত পণ্য উৎপাদনে বাধ্য করল। এতে রাজ্যে মাথাপিছু আয় ২০ শতাংশ বেড়ে গেল। যদিও রপ্তানি আয়সহ রাজ্যের মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশ নতুন ক্ষমতাসীন প্রধান ও তাঁর ৯ জন সহযোগীরা আত্মসাৎ করেন। ফলে, রাজ্যের ৯০ শতাংশের আয় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে যায়। তখন দেখা গেল, গড় আয়ের ভিত্তিতে মানুষের সুখ বেড়েছে। কিন্তু ৯০ শতাংশ লোকের মাথাপিছু আয় ও সুখ কমে গেছে। শুধু ১০ ভাগ লোকের আয় বেড়েছে। শেষমেশ দেখা গেল যে সুখস্থান রাজ্যে মানুষের সুখ যখন বাড়ছে, মাথাপিছু আয় তখন কমে যাচ্ছে। আর যখন দুঃখ বাড়ছে, তখন মাথাপিছু আয়ও বাড়ছে। তবে দোষ সুখস্থানের নয়, দোষ হলো জাতীয় আয় হিসাবের পদ্ধতিতেই।

ফাইল ছবি

গল্প ছেড়ে এখন বাস্তবে আসি। কয়েক বছর ধরে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্কের ‘বৈশ্বিক সুখ প্রতিবেদন ২০১৯’ রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ সুখের সূচকে ১০ ধাপ নিচে নেমে গেছে। ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫তম। এর আগের বছরে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৫তম। মূলত, ছয়টি চলকের ওপর ভিত্তি করে এ রিপোর্ট করা হয়েছে। চলকগুলো হচ্ছে, আয়, স্বাধীনতা, আস্থা, সামাজিক সহায়তা, উদারতা ও প্রত্যাশিত আয়ুকাল। দেশের ক্ষেত্রে তাহলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সুখ একসঙ্গে বাড়ছে না।
আরেকটি বিষয়ে একটুখানি নজর দিই। কিছুদিন আগে অনানুষ্ঠানিক এক বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, দেশে মাথাপিছু আয় বর্তমানে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত বছরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এর আগের বছর মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার। সে হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬৩ ডলার, আগেরবার থেকে যা ৯ শতাংশ বেশি। খুবই ভালো কথা। কিন্তু আমরা যদি ও চারপাশে ভালো করে দেখি, তাহলে কি দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারি, এটা দেশের প্রতিটি মানুষের প্রকৃত আর্থিক অবস্থার প্রতিফলক? আসলে মাথাপিছু জাতীয় গড় আয় বা গড় ব্যয় দ্বারা কখনোই একজন মানুষের প্রকৃত আর্থিক অবস্থার মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। গড় আয় বা এ ধরনের মূল্যায়নের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র শ্রেণির মানুষ।

৫.
ডেভিড পিলিং একজন মার্কিন সাংবাদিক। তিনি বিখ্যাত ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় কাজ করেন। জিডিপির প্রতি আমাদের অতি উৎসাহকে নিয়ে তিনি একখানা বই লিখেছেন ‘দ্য গ্রোথ ডিলিউসন’ নামে। বাংলায় যার অর্থ ‘প্রবৃদ্ধির বিভ্রম’। ২০১৮ সালে প্রকাশিত বইয়ে তিনি একখানা প্রশ্ন রেখেছেন: আমাদের নীতিমালা কেবল জিডিপি বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়ে তৈরি হয়। কিন্তু এ মাপকাঠিতে আমরা কি সুখী বা সমৃদ্ধিশালী হতে পারছি? আমরা এখনো কেন অস্থির, ভাঙাচোরা সময়ের মধ্যে বাস করছি, যেখানে আয় ও সম্পদের বৈষম্য এবং জনতুষ্টিবাদের মতো মারাত্মক বিষয়গুলো দিন দিন বেড়েই চলেছে?

আসলে সব ভুলে জিডিপি বাড়ানোর চেষ্টায় থাকার বিপদও রয়েছে অনেক। এতে কারখানা করতে গিয়ে উর্বর জমি দখল হতে পারে। বনজঙ্গল ধ্বংস হতে পারে। বসতবাড়ি থেকে উৎখাত করা হতে পারে অনেককে। বড় বড় প্রকল্প চালু করতে গিয়ে পরিবেশ রক্ষার চিন্তাভাবনায় ছেদ পড়তে পারে। আরও অনেক জরুরি বিষয়ের প্রতি আমাদের খেয়াল তখন নাও থাকতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই সব নয়; প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক বিষয়ে নজর দিতে হয়। পিলিং তাই তাঁর বইটিতে জিডিপি নিয়ে দেশগুলোর অতি উৎসাহ কমাতে বলেছেন। তাঁর মতে, জিডিপির মোহ কাটিয়ে কীভাবে ভালো থাকা যায়, সেদিকে দেশগুলোর মনোযোগ দেওয়া উচিত। তাঁর মতে, ভালো থাকার মানে হচ্ছে সমাজবদ্ধ হয়ে থাকা, অপরাধের হার কমানো, সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, আয়ুকাল বাড়ানো, নির্মল বাতাস, বিশুদ্ধ পানি, দূষণমুক্ত পরিবেশ আর জীবন নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব।

একটি বিষয় এখানে না বললেই নয়; সবার আগে জিডিপি প্রবৃদ্ধির মোহ কাটায় দক্ষিণ এশিয়ার অত্যন্ত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ভুটান। অর্থনৈতিক অবস্থা যাচাইয়ে জিডিপিকে ভ্রান্ত বলার জনকই বলা চলে এ ভুটানকে। দেশটির রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুক সেই সত্তরের দশকেই তত্ত্ব দিয়েছিলেন, জিডিপি আসলে কিছুই নয়। একটি দেশের ভালোমন্দ বুঝতে হবে ‘গ্রোস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ দিয়ে। এর ফলও তারা পাচ্ছে। ভুটানের শতকরা প্রায় ৪০ জনই এখন সুখী এবং এই বৃদ্ধির ধারাটা অব্যাহত রয়েছে।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও জোসেফ স্টিগলিৎজের (২০০৮) উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করি। তাঁদের মতে, শুধু জিডিপি ও তার প্রবৃদ্ধি মাপলে চলবে না। এর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের উপকার কতখানি হচ্ছে, তা মাপার জন্য নতুন মাপকাঠি দরকার। সঠিক মাপকাঠি না থাকলে সঠিক নীতিও তৈরি হবে না। বিষয়টি আসলেই তাই। আমাদের বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত। আর তা না হলে আমরা কেবল জিডিপি নিয়েই পড়ে থাকব। আসল কাজের কাজ কিছুই হবে না।

লেখক: ব্যাংকার