স্কুল বুলিংয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা–১
অনেকদিন ধরেই বুলিং নিয়ে লিখতে ইচ্ছা করছিল। আবার লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, এসব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মনে হয় না লিখলেই ভালো। আমি অভিজ্ঞতা ছাড়া কিছু লিখতে পারি না। আমার জীবনে অনেক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আছে বুলিংয়ের। পরে চিন্তা করে দেখলাম, লিখি না একটা। যদি একজন মানুষও এর ভয়াবহতা বুঝতে পারে!
আমি ক্লাস ফোর-ফাইভের দিকে সরকারি স্কুলে পড়তাম। সেখানে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ছেলেমেয়ে পড়ত। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ের সংখ্যা ছিল বেশি। আমি এমনিতে রেজাল্ট ভালো করতাম। কিন্তু স্কুলটাতে আমার একদম পড়তে ইচ্ছা করত না। কারণ, শিক্ষকদের দুর্ব্যবহারের জন্য। একদিন ক্লাসে শিক্ষক ঢুকেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুই “অমুক” সাহেবের মেয়ে না?’ আমি ভয়ে বললাম, ‘জি স্যার।’ তিনি তৎক্ষণাৎ রেগে বললেন, ‘ওই মাইয়া! স্যার কী রে, জি “জনাব” বল। ইংরাজি বলে বলে ছেলেমেয়েগুলো নষ্ট হয়ে গেল।’ আমি বললাম, ‘জি জনাব।’ তিনি বললেন, ‘তোর আব্বাকে বলবি, জীবনে তো অনেক টাকাপয়সা আয় করবে। স্কুলে যেন একটা ফ্যান লাগায়ে দেয়। এত টাকা দিয়া করবে কী?’
একদিন কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে আসলাম। বাসায় অকারণে মার খেয়েছি। ম্যাডাম বাংলা কবিতা পড়াচ্ছেন, আমি পড়ছি, আর ক্রমাগত চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। একটা মেয়ে ভয়ে ভয়ে ম্যাডামকে বলল, ‘আপা, রিফাত কাঁদে।’ ম্যাডাম কবিতার বই থেকে চোখ তুলে বললেন, ‘কান্দুক। মাইয়া মানুষ সারা জীবনই চোখের পানি ফেলা লাগব। ওরে কাইনবার দাও। অভ্যাস হোক।’
আমার খুব শখ ছিল অন্য একটা স্কুলে ভর্তি হওয়ার। সেই স্কুল নিয়ে আমি একটা লেখাও লিখেছিলাম অনেকদিন আগে। অনেক সাধনায় চান্স পাওয়া সেই স্কুল। কী সুন্দর বিল্ডিং, কী সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়ে! শুনেছি ওখানে ছেলেমেয়ের বৈষম্য বলে কিছু নেই। ছেলেমেয়েরা শুনলাম পাশাপাশি বসে ক্লাস করে। ওখানে কোনো ছেলেমেয়ে একসঙ্গে কথা বললে ক্লাসের দেয়ালে যোগ চিহ্ন দিয়ে বলে নাম লেখা হয় না। ঢাকা শহরের একটা নামকরা স্কুল, যা কিনা অনেকের কাঙ্ক্ষিত পড়ার জায়গা। আগের স্কুলে একটা ছেলে বোন বলে নিষ্পাপ ডাকে ডাকলেও ক্লাসে পরদিন যোগ চিহ্ন দিয়ে নাম উঠে যেত দেয়ালে। কিন্তু এই স্কুলে নাকি সেসব নেই।
নতুন স্কুলে গিয়েই পড়লাম আরেক সংকটে। ছেলেমেয়েগুলো বেশির ভাগই আমার চেয়ে বয়সে বড়। কারণ, ভালো স্কুলে চান্স পেতে হলে দেখা যায় তারা অন্য কোনো স্কুলে ক্লাস ওয়ান, টু, থ্রিতে পড়াশোনা করে তারপরে এখানে ক্লাস ওয়ানে চান্স পেয়ে ভর্তি হয়েছে। কাজেই আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছেলেমেয়ের সঙ্গে পড়তে হতো, যারা জীবন–সম্পর্কিত অভিজ্ঞতায় আমার চেয়ে একটু হলেও এগিয়ে আছে। আর আমাকে বয়সের চেয়ে অনেক বড় দেখা যেত দেখে ক্লাস টু পাস করার পর ক্লাস ফোরে আব্বা-আম্মা সরাসরি ভর্তি করিয়ে দিলেন। ফলে আমার সহপাঠীদের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব আরও অনেক বেশি হয়ে গেল।
যা-ই হোক, সেই ছেলেমেয়েগুলো ছিল তুখোড়। এরা পড়াশোনায় ভালো, কবিতা আবৃত্তিতে ভালো, হাতের লেখায় ভালো, নাচে-গানে, ছবি আঁকায়, ব্যান্ড, কোরআন তিলাওয়াতে—কোন বিষয়ে ভালো ছিল না? আমি সেখানে একটা সরকারি স্কুল থেকে আসা সহজ-সরল সাধারণ একজন। আমি বুঝতে পারলাম যে একটা বিশাল সমুদ্রে এসে পড়েছি। আর এদের সবার ঘরে আমাদের মতো এত ভাইবোন ছিল না। ফলে বাবা-মায়ের একটু বেশি আদরে বেড়ে উঠছিল তারা।
এই ছেলেমেয়েগুলো আমাকে ভয়াবহ বুলিং করত। কী রকম? কিছু উদাহরণ দিই।
হয়তো ক্লাসে পড়ছি, পেছন থেকে কাঁধে দুইটা টোকা দিল। আমি যেই তাকালাম, সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার! ‘ম্যাডাম, রিফাত না পেছনে তাকিয়ে খালি কথা বলে, পড়তে দেয় না।’ ম্যাডামের তো আর খেয়ে পড়ে কাজ নেই যে সত্যতা যাচাই করবেন। কারণ, অভিযোগকারীকে তাঁরা চেনেন সেই ক্লাস ওয়ান কিংবা প্রিপারেটরি ক্লাস থেকে। আর আমাকে চেনেন ক্লাস ফাইভ থেকে। ম্যাডাম এসে আমাকে হয় হাত দিয়ে কিংবা স্কেল দিয়ে অমানুষের মতো মেরে চলে গেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কাঁদছি। তিনি সিট থেকে উঠে এসে আবার আমাকে কয়েকটা মেরে চলে গেলেন কেন শব্দ করে কাঁদছি। এখনই কান্না বন্ধ করতে হবে।
এটা খুবই সাধারণ একটা ঘটনা বললাম। এর চেয়েও ভয়াবহ সব ঘটনা আমার জীবনে প্রতিদিন ঘটত।
অ্যাসেম্বলি শুরু হওয়ার আগে আমি একা একটা জায়গায় বসে ওই ছোট বয়সেই আল্লাহর সঙ্গে কথা বলতাম, আম্মার কথা মনে করে কাঁদতাম। মনে হতো, এই মুহূর্তে আম্মা সঙ্গে স্কুলে থাকলে আমাকে নিশ্চয়ই আগলে রাখতেন। আমি থাকতাম মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, সব সময়ই আতঙ্কে থাকতাম, এক অদ্ভুত বিষণ্নতায় ডুবে গেলাম সেই ছোট বয়সে। বাসায় আস্তে আস্তে আমি অসম্ভব রাগী মানুষে পরিণত হলাম। কারণ, স্কুলের হতাশা বাসায় এসে অন্যদের সঙ্গে ঝাড়তাম। মা–বাবা, ভাই-বোন, গৃহকর্মী—সবাই আমার রাগারাগির জন্য অস্থির হয়ে থাকত।
আমি ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতাম না। কারণ ছিল বডি শেমিং। আমার গ্রোথ অনেক বেশি ছিল। যে বয়সে মেয়েরা বয়ঃসন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে যায়, আমাকে অনেক আগে তার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ জেনেটিক ও হরমোনগত কারণে। ফলে আমার বয়সী মেয়েদের চেয়ে সব সময়ই আমাকে একটু বেশি বয়স্ক লাগে। একটু স্থূলকায় ছিলাম, এখনো আছি। কিন্তু ছোটবেলায় খুব ভয় হতো যে আমার বেশি কিছু খাওয়া উচিত না। ফলে টিফিন পিরিয়ডে না খেয়ে বসে থাকা, বাসায় এসে ঠিকমতো না খাওয়া, একদিনও তো সকালের নাশতা করতে পারতাম না। আম্মা আর গৃহকর্মী আমাকে নিয়ে অতিষ্ঠ ছিল।
এ রকম হতে হতে আমার শরীর অসুস্থ হতে লাগল। মেজাজ খিটখিটে হতে লাগল। তীব্র গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, সারাক্ষণ গলা জ্বলে। টিফিনে যে খাবার দেওয়া হয়, সেটা আবার সেভাবেই ফেরত আসে, কিন্তু আমি দিন দিন লম্বা ও মোটা হচ্ছি এত খাওয়া কন্ট্রোল করার পরও।
এবার আরেকটা ঘটনা বলি।
আমি একদিন অঙ্ক পরীক্ষায় ২০–এর মধ্যে ৮ পাই। ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকে সবাইকে খাতা দিয়ে আমাকে সবার সামনে ডাকলেন। এরপর আমাকে সবার সামনে যাচ্ছেতাই অপমান করে অনেক মারলেন। এমন কিন্তু না যে অন্য কেউ পরীক্ষায় এ রকম কম নম্বর পায়নি। কিন্তু আমাকে কোনো একটা অদ্ভুত কারণে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। অমানুষের মতো মারতেন, অপমান করতেন, ‘গাধা’ বলে ডাকতেন আর মারার সময় তাঁর মুখে পৈশাচিক একটা হাসি লেগে থাকত।
আর স্কুলে তো প্রাইভেসি রক্ষার কোনো বিষয় নেই। দেখা যেত যে কোনো এক শিক্ষক বা শিক্ষিকার সন্তান, কিংবা নাতি-নাতনি আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। তারা বাসায় গিয়ে ক্লাসে ঘটা ঘটনাগুলো বলে দিত। কিংবা সেই পৈশাচিক হাসি–সংবলিত শিক্ষিকাই হয়তো টিচারস রুমে বসে আমাকে নিয়ে কটু কথা বলতেন। ফলে আমি যে কখনো চিন্তা করব যে না, এই ম্যাডাম আমাকে অপছন্দ করে তো কী হয়েছে, আমি অন্য ম্যাডামদের কিংবা স্যারদের ক্লাসে অবশ্যই ভালো করব, সেটা আর হয়ে উঠত না। আমি সব সময়ই ‘গুড ফর নাথিং’ ধরনের মানুষ ছিলাম সবার চোখে। পড়াশোনায় মাঝারি রেজাল্ট করতে লাগলাম। অথচ ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েই কিন্তু এ স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। আর পড়াশোনা ছাড়াও আমাদের আচার-আচরণ, শৃঙ্খলা, নেতৃত্ব—এসবেও গ্রেড দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। আমাকে সব সময়ই এগুলোতে ‘ঘ-চ’–এর মধ্যে গ্রেড দিতেন। বিশেষ করে নেতৃত্ব, এতে আমি সব সময়ই ‘চ’ পেতাম; ‘এ’ একজন ম্যাডামের কাছ থেকে। তাঁদের গুটিকয় প্রিয় ছাত্রছাত্রী কিছু পারুক বা না পারুক, তাদেরকে ‘ক’ গ্রেড দিতেন। ফলে এ স্কুলে পড়ার সময় আর কোনো দিন আমি নেতৃত্বে এগোতে পারলাম না, কিন্তু পরবর্তী সময়ে পেরেছিলাম।
আরেকজন শিক্ষক ছিলেন, ক্লাস সিক্স থেকে যাঁর ক্লাস করতাম। লোকটা ভয়াবহ রকমের পেডোফিলিক ছিলেন। শাস্তি দেওয়ার নামে সব সময় মেয়েদের পিঠে অন্তর্বাসের ফিতায় হাত দিতেন, সেখানে একটা ভয়াবহ খোঁচা দিতেন। পরীক্ষায় লেখার সময় এসে বলতেন, ‘এই! হাত দিয়ে খাতা ঢেকে লেখো, না হলে পাশের জন দেখবে’, এই বলেই ছাত্রীদের হাত ধরে এমনভাবে টেবিলে রাখতেন, যেন উনার লোমওয়ালা জঘন্য হাতটা একবার হলেও মেয়েদের বুক স্পর্শ করে।
এ শিক্ষকের বিষয়টা নিয়ে ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে কথা হলে তাদের কেউ কেউ বলল, তারা নিজেরাও এর শিকার। কিন্তু একজন–দুজন মেয়ে ছিল স্যারের প্রিয় পাত্রী। তারা আবার স্যার–সম্পর্কিত কোনো খারাপ কথা শুনতে চাইত না। কারণ, স্যার তাদের পিতার (!) স্নেহে অনেক খোঁজখবর রাখেন। রাত দুইটার সময় ফোন দিয়ে খবর নেয় যে পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে কি না! আমি আসলেই বুঝতাম না, এ রকম একটা লোকের সঙ্গে এদের এত রাতে কী এত কথা!
ক্লাসের মেয়েরা আমাকে একদিন বলল, স্যারের নামে অভিযোগ করতে হবে। আমি এগিয়ে গেলাম এ অভিযোগের জন্য। একজন ভালো ম্যাডামকে জানালাম, যিনি আমাদের অনেক আদর করতেন। তিনি সব শুনে একটু উত্তেজিত হলেও কয়েক দিন পর ডেকে বললেন, ‘দেখো, আমিও তো এখানে চাকরি করে খাই। এ রকম একজন স্যারের বিরুদ্ধে আমি যাব না। ভালো হয়, সব মেয়ের অভিভাবক এসে যদি অভিযোগ করেন।’
সেদিন বুঝলাম যে বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগ এখানে নেই। স্যার এভাবে এসে এসে গা হাতাবে আর আমাদের সেটা মুখ বুজে সয়ে নিতে হবে।
আমি হাজার চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়াশোনা করতাম, ভালো-খারাপ মিলিয়ে রেজাল্ট করতাম। আর বাসায় এসে সবার সঙ্গে রাগ দেখাতাম। আম্মাকে যদি বলতাম, আজ এগুলো এগুলো হয়েছে স্কুলে, আম্মা কেন যেন বিষয়গুলো শুনে বলত আমি যেন নিজে বুদ্ধি খাটিয়ে এসব মোকাবিলা করি। এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি অনেক ব্যস্ত থাকতেন। ফলে আর চাইতেন না এসব বিষয়ে বেশি কিছু করতে। দু–একবার এগুলো নিয়ে মুখ খুলে আম্মা কীভাবে যেন কালারড হয়ে গেলেন স্কুলে। তাই তিনিও আমার স্কুলে বাকি সময়টুকু যেন আর শিক্ষকেরা ঝামেলা না দেয়, এ জন্য একটু মুখ বুজে সহ্য করতে বলতেন। কিন্তু আম্মা পাশে থেকে সব সময় সান্ত্বনা দিতেন।
একবার আম্মাকে একজন শিক্ষক ডেকে আমার নামে অভিযোগ করলেন। আম্মা তাঁকে বলেছিলেন, যে আমি এত ভালো রেজাল্ট করতাম, সে কীভাবে এ রকম হয়ে যাচ্ছি? আগে তো ভালোই ছিলাম। নিজে নিজে পড়তাম। কেন তাঁরা একটু সহযোগিতা করছেন না? আম্মার কথা শুনে এই টিচার আমাকে কী জঘন্য একটা নামে যে ডাকতেন! তাঁর কথা হচ্ছে, আমি স্বভাবতই একটা Dull student। আমার মা আমাকে যে পরিমাণে মেধাবী ভাবেন, সেটা ভেবে স্যার হাসি থামাতে পারছিলেন না। ক্লাসে এসে সবার সামনে আমাকে একটা কুৎসিত নামে ডাকলেন এবং সমগ্র ক্লাস ভয়াবহ পৈশাচিক হাসিতে ফেটে পড়ল।
টিনেজ বয়সে একটা মানুষ জীবনের খুব অদ্ভুত ও স্পর্শকাতর সময় পার করে। আমার জন্য এটা ছিল চরম বিভীষিকার সময়। আমাকে স্কুলের ছেলেমেয়েরা এমন কোনো উপায় নেই, যা দিয়ে টর্চার করেনি। কেননা, ওরা এই স্কুলে পড়াশোনা করত সেই বাচ্চা ক্লাস থেকে, আমি মোটামুটি একটু বড় হয়ে এ স্কুলে ভর্তি হয়েছি। ফলে আমার সঙ্গে ওরা সব সময়ই একটা দূরত্ব রেখে চলত। এরপর ওখানে ৮ বছর পড়াশোনা করি এবং আমি সব সময়ই ওদের মধ্যে বহিরাগত ছিলাম। চেষ্টা করতাম, ওদের সঙ্গে গড্ডালিকায় গা ভাসাতে। কিন্তু স্বভাবে একটা জিনিস না থাকলে সেটা তো হয় না।
একটা ছেলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হলো আমাদের সঙ্গে। যেহেতু ক্লাস সেভেনে অনেক ছেলেমেয়ে ক্যাডেট কলেজে চলে যায়, ফলে অনেকগুলো সিট খালি হয়েছিল। ছেলেটি মানসিক প্রতিবন্ধী ছিল। তবে ওর যে কী ডিজঅর্ডার ছিল, এটা আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে, ছেলেমেয়েরা ওকে সুর করে জিজ্ঞাসা করত, ‘তোমার নাম কী?’ ছেলেটা ক্লান্তিহীনভাবে উত্তর দিয়ে যেত সবাইকে। আর সবার মধ্যে হা হা হি হি হাসির রোল! ছেলেটির মধ্যে শিশুসুলভ অনেক বিষয় ছিল। আমি খেয়াল করে দেখলাম, ছেলেটা অল্প সময়ে অনেক ভালো রেজাল্ট করছে। ওই স্কুলে নিয়ম ছিল বই মুখস্থ করে ক্লাসের সামনে এসে না দেখে গড়গড় করে বলা। যারা এই মুখস্থবিদ্যার অধিকারী ছিল, তাদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। ক্লাসের প্রথম সারির ছেলেমেয়েরা এই কাজটা ভালো পারত। ছেলেটিরও সেই গুণ ছিল।
একদিন দেখলাম, ক্লাসের দুষ্টু কিছু ছেলে ওকে খুব অশ্লীল কিছু বিষয় শিখাচ্ছে। ছেলেটা কিছু বুঝুক বা না বুঝুক, হাসছে। আরেকদিন জানতে পারলাম, ক্লাসের এক মাস্তান ধরনের ছেলে ওকে বিভিন্ন বিষয়ে ব্ল্যাকমেল করে বাসা থেকে টাকা আনাত। আমাদের গ্রুপে বিভিন্ন ধরনের প্রোজেক্ট করতে হতো। সরল ছেলেটাকে সেই মাস্তান ধরনের ছেলে শিখিয়ে দিত যেন বাবাকে গিয়ে বলে, এত হাজার টাকা লাগবে প্রোজেক্টের জন্য। ছেলেটা তা–ই আনত। মাস্তান ছেলেটি একদিন কী একটা বিষয়ে যেন ওকে পেটে চাকু ধরে ভয় দেখিয়েছিল।
এরপর থেকে আমি পরিবর্তন দেখলাম বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলেটির মধ্যে। ছেলেটা ক্লাসে আসত অনেক ক্লান্ত হয়ে। দেখেই বোঝা যেত যে রাতে ঘুমায় না। ক্লাসে পড়ার ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়ত। একজন শিক্ষক (আমি আজও তাঁর এই রূঢ়তার কথা ভুলব না) ওর ঘুমের মধ্যেই কান ধরে টেনে তুলে আবার মাথা সজোরে টেবিলের ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন। ফলে টেবিলে মাথা জোরে বাড়ি লাগার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটা হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠে চারদিকে একটা হাসি হাসি মুখে তাকাত। ক্লাসের ছেলেমেয়েদের গলা থেকে বিকৃত আনন্দের হর্ষধ্বনি বের হচ্ছে। এরপর ছেলেটির ঘুম ভাঙলে তাকে অমানুষের মতো মারধোর করলেন স্যার। কেননা, স্যারের ধারণা, ছেলেটি ঘুমের ভাণ করছিল। ছেলেটির বাবা এরপর স্কুল থেকে টিসি নিয়ে চলে গেলেন। এরপর আর কোনো দিন ওকে স্কুলে দেখিনি।
১৯৯৯ সালের ঘটনা। আমাকে কেউ গ্রুপ প্রোজেক্টে নেবে না। কারণ, আমার মেধা নিয়ে বাকিদের শঙ্কা ছিল। আমিসহ ক্লাসের সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মেয়েরা মিলে একটা গ্রুপ করলাম, যাদের অন্য কোনো গ্রুপে কেউ নেয়নি। আমি দিন-রাত পরিশ্রম করলাম। পড়াশোনার খবর নেই, কিন্তু ১০ নম্বরের প্রোজেক্টের জন্য আমি রাতের ঘুম হারাম করলাম। গ্রুপ মেম্বাররা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যা হওয়ার তা–ই হলো, আমাদের প্রোজেক্ট ফার্স্ট হলো। আমি গ্রুপ লিডার ছিলাম দেখে আমাকেই পুরস্কার আনতে যেতে হবে। একটা মেয়ে বাধা দিল, পুরস্কার তাকে আনতে দিতে হবে। আমি তখন খুবই বিনয়ের সঙ্গে শক্ত হয়ে বললাম, আমিই আনব, যেহেতু আমার দায়িত্বে কাজটি হয়েছে। আমাকে সারা জীবন শিক্ষকেরা ‘Good for Nothing’ মনে করত। Now it’s my turn to prove myself. এরপর সেই মেয়ে আমার এমন কোনো ক্ষতি নেই যা করার চেষ্টা করেনি। যেমন ক্লাসের সবচেয়ে বখাটে ছেলেকে আমার সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলে পেছনে লাগিয়ে দেওয়া। ক্লাস এইটে পড়ুয়া আমার চরিত্র নিয়ে এমন কথা নেই, যা সে বলত না। অথচ স্কুল-কলেজে থাকতে দূর থেকে কোনো সিনিয়র ভাইয়াকে দেখে ভালো লাগা ছাড়া আর কোনো চরিত্রহানির কাজ করেছিলাম কি না, মনে পড়ে না।
এসব বুলিং কিছুটা কমেছিল যখন আম্মা আমাকে স্যারদের বাসায় ব্যাচে পড়তে দিলেন। তখন শিক্ষকেরা আমাকে ছোটখাটো ভুলের জন্য নম্বর কাটা বন্ধ করলেন। সেভাবে বুলিং করতে দিতেন না। কিন্তু এই স্যারের বাসায় পড়তে যাওয়া নিয়েও কাহিনি ছিল। আমি যে এলাকায় থাকতাম, খুব একটা ভালো এলাকা না। রাস্তায় বখাটে ছেলেদের উৎপাত ছিলই। সেই সঙ্গে তখন বাংলাদেশে রাস্তার মোড়ে মোড়ে অ্যাসিড–ভায়োলেন্স হচ্ছে। প্রতিদিন স্কুল আর স্যারের বাসায় যেতাম, আমার মা যে কী অসহনীয় দুশ্চিন্তায় থাকতেন! স্যারের বাসায় যাওয়ার সময় একবার এক বয়স্ক লোক আমার রিকশা ফলো করছিল। এরপর রিকশা থামানোর চেষ্টা। আমি রিকশাওয়ালাকে বললাম, ‘ভাই, প্লিজ রিকশা দ্রুত টান মেরে নিয়ে যান।’ সেদিন সেই রিকশাওয়ালা শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে রিকশা টান মেরে নিয়ে যান স্যারের বাসায়। স্যারকে ঘটনা বলার পর তাঁর মধ্যে কোনো সমমর্মিতা নেই। আমাকে এরপরও বাধ্য হয়ে এ ভায়োলেন্ট পরিবেশে স্যারের বাসায় পড়তে যেতে হতো। নাহলে স্কুলে বুলিং করবে, নয়তো পরীক্ষার খাতায় কম নম্বর দেবে। আর ৬৫ শতাংশ নম্বর না থাকলে বের করে দেবে স্কুল থেকে।
এইচএসসিতে একই কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় আমাকেসহ আরও বেশ কিছু ছেলেমেয়েকে বাদ দিয়ে দেওয়া হলো। আমি তত দিনে লেগে থাকা একটা মানুষ। এত সহজে হার মানি না। যেসব স্যার আমাকে তাঁদের বাসায় ব্যাচে পড়তে বাধ্য করতেন, তাঁদের আমি বললাম, আমার কোন অপরাধে আমাকে বাদ দেওয়া হলো? আমার পরীক্ষা ভালো হয়েছে, এসএসসিতে রেজাল্ট ভালো। এসএসসি পরীক্ষার পর আমার সরকারি স্কুলের বন্ধু-বান্ধবেরা যেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমি সেখানে এসব স্যারের বাসায় ভর্তি হয়ে ইন্টারের পড়াশোনা এগিয়ে রাখছি। স্যারদের মুখে জবাব নেই। আমি তাঁদের জানালাম, আমার খাতা চ্যালেঞ্জ করব। যদি আমার প্রতি সুবিচার করা না হয়, আমি অনশনে রাস্তায় বসব।
তখন আমাকে নেওয়া হলো। আমার মা আমাকে বলে দিলেন, ভালো রেজাল্ট করতে হবে এইচএসসি পরীক্ষায়।
মজার বিষয় হলো, এইচএসসিতে আমি সেকেন্ড ইয়ারে বাসায় বুয়েটের ছাত্রদের কাছে পড়তাম। আমার পড়াশোনার বেসিক পুরোপুরি ঠিক করে ফেললাম। এইচএসসি পরীক্ষা দিলাম এবং আমি এ+ পেলাম। সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকার, পুরো পরিবারের আনন্দ, আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। কলেজে ডাকা হলো পত্রিকায় ছবি ছাপানো হবে দেখে ফটোশুট হবে। রেডি হয়ে গেলাম। সাংবাদিক দুজন ছাত্র-ছাত্রী চেয়েছে সাক্ষাৎকারের জন্য। প্রিন্সিপ্যাল স্যার আমাকে এবং আরেকজন সহপাঠীকে যেতে বললেন। বাকি ছেলেমেয়েরা ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। তাদের প্রশ্ন, ‘রিফাত এই স্কুলে মাত্র আট বছর পড়েছে আর আমরা পড়েছি ১২-১৪ বছর। কেন আমাদের না ডেকে ওকে ডাকা হচ্ছে?’ প্রিন্সিপ্যাল স্যার তাদের হালকা বকা দিয়ে আমাকে বললেন, ‘রিফাত, তুমি যাও, সাক্ষাৎকার দিয়ে এসো।’
বাংলাদেশে কৃতী শিক্ষার্থীদের সম্মাননা জানানোর জন্য নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়, যেখানে মা–বাবা, শিক্ষকেরা অংশ নেন। কলেজের শিক্ষকেরা পাঁচতারা হোটেলের সেই অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্র আমাদের হাতে আর দেননি। তাঁরা নিজেরাই পরিবার-পরিজন নিয়ে দাওয়াত খেয়ে চলে এসেছেন।
আমি ওই স্কুল থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে আমার দেখা সুন্দর মনের কিছু ছেলেমেয়ে পড়ত। এদের মতো ভালো মানুষ হয় না। ওখানকার শিক্ষকদের দেখে আমি শিখেছি শিক্ষকতা কত পবিত্র ও মহান একটা পেশা। একজন ডাক্তার রোগীর চিকিৎসা করবে, একজন প্রকৌশলী মানুষের কল্যাণে স্থাপনা বানাবে, কিন্তু একজন শিক্ষক অনেক মানুষকে গড়ে তুলবে, একটা জাতি তৈরি করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েগুলো ছিল বিভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে আসা। কিন্তু এদের চোখভরা অসম্ভব সব স্বপ্ন আমাকে সামনে এগোতে সাহায্য করেছিল। আমার রাগসহ অন্যান্য মানসিক সমস্যা আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে।
একটা মেয়েকে চিনতাম, যাকে আমার স্কুলের ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় নকল করার মিথ্যা অপবাদে ফাঁসিয়েছিল। মেয়েটিও আমার মতো নতুন শিক্ষার্থী ছিল। এরপর মেয়েটি প্রচণ্ড জেদ করে যে তাকে যে সাবজেক্টের জন্য মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, এই সাবজেক্টে সে অনেক ভালো রেজাল্ট করবে, উচ্চশিক্ষা নেবে। পরবর্তী সময়ে সেই মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সায়েন্সের সাবজেক্ট থেকে অনার্স (ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড) ও মাস্টার্স (ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট) সম্পন্ন করে। এরপর সে দেশেই একটা বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কাজ নেয়, যেখানে ডলারে তার বেতন হয়। সারা বছরই চাকরির কারণে আমেরিকা–কানাডা যাতায়াত করতে হয়। আমাদের মধ্যে মেয়েটিই সবচেয়ে অল্প বয়সে মেধা দিয়ে সম্মান অর্জন করতে পেরেছিল। চলবে...
*আগামীকাল পড়ুন ২য় পর্ব
*লেখক: রিফাত জাহান কানাডার ইউনিভার্সিটি অব সাস্কাচুয়ানে পিএইচডি শিক্ষার্থী। গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও কম্পিউটার সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট কাউন্সিলের সভাপতি।