স্কুল বুলিংয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা-২
...এবার আসি যে ছেলেমেয়েগুলো বুলিং করত, তাদের কথায়। তারা কোথায়? কেমন আছে? আমার সঙ্গে অনেক দিন যোগাযোগ নেই। মাঝে একটু যোগাযোগ হলো (কেন হলো, কীভাবে হলো, আরেক দিন অন্য একটা লেখায় লিখব)। এদের মোটামুটি সবাই ক্যারিয়ার গড়ে নিয়েছে সুন্দরভাবে, কিন্তু এদের একেকজনের জীবনে একেক ধরনের কষ্ট আছে। একটা ছেলে ক্লাসের মেয়েদের নামে খুব আজেবাজে কথা বলত, তার আর কোনো দিন পড়াশোনা হয়নি। আমাদের ক্লাসের একটা মেয়েকে সে একদিন গণধর্ষণের হুমকি দিয়েছিল। সেই মেয়ে ভয়ে-আতঙ্কে কীভাবে যে ক্লাস করত! শিক্ষকদের জানানো হলে তাঁরা মেয়েটিকে দোষারোপ করছিলেন। মেয়েটার স্বভাবের জন্যই নাকি ছেলেটা এসব বলার সাহস পাচ্ছে। সেই মেয়ের মাকে একজন শিক্ষিকা বললেন, ‘আপনার মেয়েকে কোনো ছেলে বাসায় ফোন করলে দেবেন না। এমনকি ওর মামা-চাচা ফোন করলেও দেবেন না।’ মানে ভিকটিম ব্লেমিং কাকে বলে, তা আমি আমার স্কুল থেকেই শিখেছিলাম।
এ ঘটনার ১১ বছর পর দেখলাম, সেই বখাটে (ইভ টিজার) ছেলে একটা টিভি চ্যানেলে কাজ করে। আমার সঙ্গে একদিন রাস্তায় দেখা। একটা গার্লস স্কুলের কথা জিজ্ঞাসা করছিল যে মেয়েদের কখন ছুটি হয়। মনে মনে ভাবলাম, এ বয়সেও উত্ত্যক্ত? আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার কী জন্য এই তথ্য দরকার?’ সে বলল, ‘আমি আসলে ইভ টিজিংয়ের বিরুদ্ধে কাজ করছি। তাই মেয়েদের কিছু সাক্ষাৎকার দরকার। জানো নিশ্চয়, আমার আর পড়াশোনা হয়নি। অনেক দায়িত্ব কাঁধে। কম বয়সে বিয়ে করে ফেললাম। সন্তানের দায়িত্ব এসে পড়েছে। যাহোক, গেলাম তাহলে।’ যে মেয়েটা এ ছেলেকে সাহায্য করত ইভ টিজিংয়ের জন্য, সেই মেয়ে নাকি এখন...আচ্ছা, থাক। বলার রুচি হচ্ছে না।
যেসব শিক্ষক-শিক্ষিকা বুলিতে অংশগ্রহণ করতেন, তাঁরা কোথায়? ‘অংশগ্রহণ’ কেন বললাম? তাঁরা তো দাঁড়িয়ে থেকে মজা নিতেন। এটা অংশগ্রহণ না? একটা মেয়ের মা আতঙ্কে ফোন করে অভিযোগ করছে যে এক ছেলে তার মেয়েকে গণধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে, এরপরও তাঁরা কিছু তো করছেনই না, বরং মেয়েটিকে গৃহবন্দী করছেন, তাকে উল্টো দোষারোপ করা হচ্ছে। তো শিক্ষকেরা ‘অংশগ্রহণ’ করতেন না?
নতুন প্রিন্সিপাল আসার পর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মোটামুটি একটা বড় অংশের চাকরি চলে যায় দুর্নীতির কারণে। একজন শিক্ষকের নাম উঠল যুদ্ধাপরাধীর তালিকায়। একজন শিক্ষিকা, যিনি কিনা প্রাইমারি ক্লাসের ছেলেমেয়েদের অমানুষের মতো মারধর করতেন, তাঁর আর কোনো দিন নিজের সন্তান হয়নি। এ জন্য তাঁকে তাঁর বাসায় অনেক কান্নাকাটি করতে দেখতাম। তখন মায়া হতো। কান্নাকাটি করেই আবার ফিরে এসে ক্লাসে মারধর করতেন। আরেকজন শিক্ষক ছেলেমেয়েদের মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলতেন। শুনেছিলাম, ওনার ছেলেটা বাসার দোতলা ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায় ওনারই চোখের সামনে। এরপর থেকে উনি এত হিংস্র হয়ে উঠেছেন। একদিন একটা মেয়েকে বেত দিয়ে মারতে মারতে বেত ভেঙে ফেললেন। চিৎকার করতে করতে ঠোঁটের পাশে ওনার থুতু জমে যাচ্ছে। তাও থামছেন না। আর হাসতে হাসতে বলতেন, ‘মেয়েদের পেছনে মারলে ব্যথা একটু কম লাগে।’ একদিন একটা ছেলে ক্লাসে পানি খাচ্ছিল পানির বোতল থেকে। তাকে বললেন, ‘তুমি মদ খাওয়ার মতো ক্লাসে পানি খাচ্ছ কেন?’ বলেই বেদম পিটুনি।
তাঁদের সবার জীবনে কষ্টের কিছু অধ্যায় আছে। এখনো তাঁরা বুকভরা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এ স্কুলে আর চাকরি নেই দেখে। আজকাল শুনছি, এ স্কুলের নাম ভেঙে একজন শিক্ষক প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে টাকাপয়সা চাইছেন, নতুন স্কুল খুলবেন বলে। আবার কেউ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁর নামে উল্টোপাল্টা কথা বলে বেড়াচ্ছেন। এ বয়সে এসে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, কোথায় আদর্শ, কোথায় সম্মান? কোনো শিক্ষকের হাতে বেড়ে উঠেছি আমরা?
স্কুলটা অনেক সুন্দর! যেকোনো মানুষ একবার স্বপ্ন দেখবে সেখানে পড়ার জন্য। স্কুলের সিরামিক ইটের লাল দেয়ালে ছোট্ট কোমল শিশুদের চাপা কান্না আটকে আছে। সেই কান্না কখনো কোনো অন্যায়কারীকে সেখানে টিকতে দেবে না।
এসব ঘটনা আমাকে আনন্দ দেয় না। ভাববেন না, এগুলো লিখে আমি খুবই আনন্দ পাচ্ছি যে ‘আহা! উচিত শিক্ষা হয়েছে!’ বরং সত্যি করে বলি, এগুলো লিখতে আমার বুকের ভেতর ভয়ে কেঁপে উঠছে। প্রকৃতির প্রতিশোধ সব সময়ই নির্মম হয়। সুন্দর প্রকৃতি অনেক ভালো জিনিস ছড়িয়ে রেখেছে আমাদের আনন্দের জন্য। মানুষ তার অন্যতম সৌন্দর্য। এর কোনো ক্ষতি করলে প্রকৃতি কখনোই চুপ থাকে না। অনেক ছোট বয়সেই জীবনের এ ভয়াবহতা আমি অনুধাবন করেছি। আমার নিজের অনেক দুঃখ-কষ্টের কারণ হলো আমার অনেক কর্মফল। আমি এসব ঘটনা দেখে ভাবি, আল্লাহ চাইলে আমাকে ইহজীবনে অনেক কঠিন শাস্তি দিতে পারতেন। কত দিন নিজের প্রতি জুলুম করেছি, অন্যায় করেছি, নিজেই নিজের ক্ষতি করেছি। আল্লাহ তারপরও সেভাবে শাস্তি দেননি, এটা তাঁর মহত্ত্ব। অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি আবার পরম আদরে আমাকে আগলে ধরেছেন, উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেছেন।
আমার স্কুলের ওই ছেলেমেয়েদের খুব জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, ‘এই শোনো! তোমাদের কি ওই ছেলেটার কথা মনে আছে? ওই যে ছেলেটা, সুর করে কথা বলত, আমরা কথা বললে শুধু হাসত। ওই ছেলেটার জীবন নষ্ট করে তোমরা কি রাতে ঘুমাতে পারো? ওই যে মেয়েটাকে মিথ্যা নকলের দায়ে ফাঁসিয়েছিলে, এরপর কি কোনো দিন তার চেহারা চোখ বন্ধ করলে ভেসে ওঠেনি? একবারও মনে হয়নি, ও তোমার-আমার মতো একটা মানুষ? ও আমাদের মতোই একটা ভালো স্টুডেন্ট। কখনো কি ভেবেছ, মৃত্যুর আগে সবার কাছে মাফ চেয়ে যেতে হবে? যত অন্যায় করেছ, সব অন্যায়ের জন্য। নিজের সঙ্গে অন্যায় করলে, আল্লাহর কোনো বিধান পালন না করলে তার জন্য মাফ চাইলে স্রষ্টা ক্ষমা করতে পারেন, তিনি পরম দয়ালু। কিন্তু অন্যের যে ক্ষতি করেছ, এর জন্য যার সঙ্গে অন্যায় করেছ, সে ক্ষমা না করা পর্যন্ত কোনো দিন স্রষ্টা ক্ষমা করবে না, এ তথ্য জানো তো?’
কানাডায় বুলিংয়ে অনেক আইন আছে। কখনো যদি এমন হয় যে বুলিং করা ছেলেমেয়েদের কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না, তখন যাকে বুলিং করা হয়, তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যে সে কীভাবে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে। মা-বাবা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, সবাই খুব সচেতনভাবে যত্নের সঙ্গে গোপনীয়তা রক্ষা করে এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখেন। চাইল্ড সাইকিয়াট্রিস্ট ও সাইকোলজিস্ট যে বুলিং করে এবং যাকে বুলিং করা হয়, তাদের দুজনকেই সাহায্য করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য। আসলে ছোটবেলায় এগুলো দেখাশোনা করলে বড় হয়ে মানসিক অসুস্থতা, বিকৃত মানসিকতা থেকে দূরে থাকা, এমনকি সিরিয়াল কিলার হওয়ার হাত থেকে মানুষকে বাঁচানো সম্ভব।
আর যারা বুলিং করে, হোক শিক্ষক, হোক ছাত্র, তারা কোনো এক হীনম্মন্যতা থেকে করে। হয় ছোটবেলায় নিজেরা এসব বুলিংয়ের স্বীকার হতো, কিন্তু সেটা মনের মধ্যে অমীমাংসিত রয়ে গেছে। অথবা তারা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার। আমাদের সঙ্গের ছেলেমেয়েরা কেন বুলিং করত, এই নিয়ে আমরা কজন বসেছিলাম ২০২০ সালে। অনেক আলোচনার পর বের হয়ে এল যে তাদের মানসিক হীনম্মন্যতা ছিল নানা রকম। সেগুলো এখানে উল্লেখ করতে চাই না। আর আমি একা নই। আরও অনেক ছেলেমেয়ে বুলির স্বীকার হতো স্কুল-কলেজে। কেউ মুখ বুজে থেকে কৌশলে এড়িয়ে যেত। আর আমার মতো প্রতিবাদীরা প্রতিবাদ করে বোকা বসে যেত। কারণ, এ রকম অবিচারের জায়গায় প্রতিবাদ না, প্রতিকারের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল।
কয়েক বছর আগে জানতে পারলাম, আমার সেই স্বপ্নের স্কুলে এখন নিয়মিত চাইল্ড সাইকোলজিস্ট বসেন এবং চেষ্টা করেন ছেলেমেয়েদের মানসিক সুস্থতার জন্য কাজ করতে।
প্লিজ ভাববেন না যে আমার স্কুল-কলেজের সব শিক্ষক এ রকম নেতিবাচক ছিলেন। সেখানে পিতৃ-মাতৃতুল্য অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা পেয়েছিলাম, যাঁরা আমাকে একজন মানুষ হিসেবে গড়তে সহযোগিতা করেছিলেন। যেমন, একবার একজন শিক্ষিকা আলাদা ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, তোমার বাংলা লেখার হাত মোটামুটি ভালো। তুমি আরেকটু ভালো করে পড়াশোনা করলে এসএসসি পরীক্ষায় অনেক ভালো করবে। জীবনেও বেশ ভালো লেখালেখি করতে পারবে। সেই শিক্ষিকার আশীর্বাদে এ বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আমার লেখা একটা বই প্রকাশিত হয়েছে।
একটা গল্প বলে লেখার ইতি টানছি—
ভদ্রমহিলা হাসপাতালে এসেছেন বাচ্চা হওয়ার আগে সবকিছু ঠিক করতে। জানতে পারলেন, লেবার রুমে তাঁর স্বামী পাশে থাকতে পারবেন না, হাসপাতালে এমন নিয়ম নেই। উনি রেগে গেলেন। বললেন, স্বামীকে লেবার রুমে পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ না দিলে এ বাচ্চা হাসপাতালে হবে না, বাসায় হবে। এ বলে তিনি চলে গেলেন বাসায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কানে এ কথা গেল। তখন পৃথিবীজুড়ে নারীবাদী আন্দোলন হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো একটা কারণে এ পেশেন্টকে অসন্তুষ্ট করতে চাচ্ছিল না। তাই তারা ভদ্রমহিলার স্বামীকে লেবার রুমে থাকার অনুমতি দিল।
২৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১। হাসপাতালে যন্ত্রণাহীন ও সহজ একটা লেবারের মধ্য দিয়ে ফুটফুটে এক পুত্রসন্তান জন্ম নিল এ দম্পতির। দেখতে আসলেই একটা রাজপুত্রের মতো। এ দম্পতির আরও কয়েকটা সন্তান জন্ম নেয় এবং কয়েক বছর পর এক বেদনার্ত বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।
সেই ছেলেকে ঘটনাটি মানসিকভাবে বেশ আঘাত করে। ছেলেটি এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। স্কুলে যখন গেল, তখন দেখল এর ভয়াবহতা! সহপাঠীরা এই বিচ্ছেদ নিয়ে অনেক খোঁচা দিতে লাগল। ছেলেটি কখনো প্রতিক্রিয়া দেখাত না, এড়িয়ে যেত। একদিন স্কুলের একজন সহপাঠী এসে ছেলেটিকে একটা অশ্লীল ম্যাগাজিন দেয়, যেখানে ছেলেটির মায়ের অশ্লীল বানানো ছবি। ছেলেটি চমকে উঠল ও বেশ কষ্ট পেল। কিন্তু সে কোনোভাবেই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। সে জানে, একবার প্রতিক্রিয়া দেখালে তার পুরো স্কুলজীবন বিষময় হয়ে যাবে। তার প্রতিক্রিয়াহীন অবস্থা দেখে বুলিং চলে গেল।
এর অনেক বছর পরে ছেলেটি তার আত্মজীবনীতে এ ঘটনা উল্লেখ করে। চলার পথে অনেক বাধা এসেছে। কিন্তু ধৈর্য ও সহনশীলতা তাকে জীবনের পথে সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।
সুদর্শন এ ভদ্রলোকের নাম জাস্টিন ট্রুডো—কানাডার অন্যতম কমবয়স্ক প্রধানমন্ত্রী। তাঁর বাবাও ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বলা হয়, আজকের এই সুন্দর কানাডা তৈরিতে জাস্টিনের বাবার অনেক পরিশ্রম ছিল। স্কুলের ছেলেমেয়েদের এ রকম বিকৃত আচরণের জবাব জাস্টিন দিতে পারতেন শুধু তাঁর বাবার ক্ষমতার জোরে। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি একটা উদাহরণ হয়ে রইলেন কীভাবে বুলিংয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ইতিবাচক থাকতে হয়। স্রষ্টা মানুষকে বিপদের মুখে ফেলে যেমন পরীক্ষা করেন, ক্ষমতা দিয়েও পরীক্ষা করেন। সামনে যখন অনেক বড় লক্ষ্য থাকে, তখন ছোটখাটো বাধাকে এভাবেই এড়িয়ে যেতে হয়। শেষ...।
*লেখক: রিফাত জাহান, কানাডার ইউনিভার্সিটি অব সাস্কাচুয়ানে পিএইচডি শিক্ষার্থী। গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও কম্পিউটার সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট কাউন্সিলের সভাপতি।