সার্ব সেনাবাহিনীর মুসলিম গণহত্যার সাক্ষী সেব্রেনিৎসায় একদিন-২

গণহত্যা চলাকালে বিভিন্ন ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে এ জাদুঘর।

ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহ সব সময় প্রবল। বিশেষত যুগোস্লাভ যুদ্ধকে ঘিরে আমার মধ্যে আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। এ কারণে বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা ভ্রমণের পরিকল্পনা করা। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা ভ্রমণের প্রথম দিনটি ছিল সেব্রেনিৎসাকে ঘিরে।

রিপাবলিক অব সার্পসকার অন্তর্গত ছোট্ট একটি মিউনিসিপ্যালিটির নাম হচ্ছে সেব্রেনিৎসা। সেব্রেনিৎসা রিপাবলিক অব সার্পসকার সবচেয়ে পূর্বের অংশগুলোর মধ্যে একটি। সার্বিয়ার সীমানার একেবারে কোল ঘেঁষে এ মিউনিসিপ্যালিটির অবস্থান। কৃষিকাজ ও নিকটবর্তী লবণের খনিতে কাজ করে এ মিউনিসিপ্যালিটির বেশির ভাগ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। রাজধানী সারায়েভো থেকে সেব্রেনিৎসা অনেকাংশে বিচ্ছিন্ন। যদিও প্রশাসনিকভাবে সেব্রেনিৎসা রিপাবলিক অব সার্পসকাতে পড়েছে, তবে এ গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই বিদ্রোহী সার্ব মিলিশিয়া বাহিনী এ গ্রামের অসংখ্য নিরীহ মানুষের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল। বলা বাহুল্য, সার্ব সেনারা যাঁদের হত্যা করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগ ছিলেন মুসলিম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ মহাদেশের ইতিহাসে সেব্রেনিৎসাতে সংগঠিত গণহত্যাকে অন্ধকারতম অধ্যায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

১৯৮০ সালে মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ধীরে ধীরে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ১৯১৮ সালে সার্বিয়ার নেতৃত্বে যুগোস্লাভিয়া গঠিত হয়, কিন্তু মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর সার্বিয়ার রাজনৈতিক নেতাদের উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাব যুগোস্লাভিয়ার পতনকে ত্বরান্বিত করে। এ ছাড়া যুগোস্লাভিয়ার পতনের পেছনে অর্থনৈতিক বিভিন্ন প্রেক্ষাপটও জড়িত। রাষ্ট্রীয় আয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় হতো রাজধানী বেলগ্রেডে, যেটা নিয়ে যুগোস্লাভিয়ার একটি বড় অংশের মানুষের মধ্যকার অসন্তুষ্টি চরমে পৌঁছেছিল। স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মেসেডোনিয়া, মন্টেনেগ্রো ও বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা প্রত্যেকে নিজেদের অর্থনীতির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করছিল। বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ যুগোস্লাভিয়ার পতনের কারণ হিসেবে সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট স্লোবাদান মিলোশেভিচকে দায়ী করেন।

বিদ্রোহী সার্ব সেনাবাহিনীর হাতে নিহত বসনিয়ার মুসলমানদের কবর।

১৯৯১ সালের ২৫ জুন স্লোভেনিয়া স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে যুগোস্লাভিয়া থেকে বের হয়ে আসে। স্লোভেনিয়ার পর ক্রোয়েশিয়াও নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। একই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর মেসেডোনিয়াও গণভোটের মধ্য দিয়ে যুগোস্লাভিয়া থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেয়। সার্বিয়ার রাজনৈতিক নেতারা যুগোস্লাভিয়ার পতনকে মেনে নিতে পারেননি। সার্বদের অনেকে আজও ক্রোয়েশিয়া, মন্টেনেগ্রো ও বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনাকে এক করে গ্রেটার সার্বিয়া গঠনের স্বপ্ন দেখে। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, রোমানরা ক্রোয়েটদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানিটি গ্রহণে বাধ্য করেছে। একইভাবে অটোমানদের কাছে বশ্যতা স্বীকারের মাধ্যমে যেসব সার্ব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন, তাঁরাই বসনিয়াক হিসেবে আজকের দিনে আত্মপ্রকাশ করেছেন বলে তাঁরা দাবি করেন।

আদৌ সার্ব, ক্রোয়েট, বসনিয়াক ও মন্টেনেগ্রিন—এ চার জাতিগোষ্ঠীর মানুষ একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছেন এবং তাঁদের সবাই নাকি একসময় একই অর্থোডক্স চার্চের অনুসারী ছিলেন। সার্বদের একটি বড় অংশের মানুষের বক্তব্য এমন। যুগোস্লাভিয়া গঠনের পেছনে সার্বদের গ্রেটার সার্বিয়া গঠনের স্বপ্ন একটি প্রধান প্রভাবকের ভূমিকা পালন করছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে সার্ব মিলিশিয়া বাহিনী সেব্রেনিৎসাসহ বসনিয়ার বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালিয়েছিল। স্লোবোদান মিলোশেভিচ সে সময় বসনিয়াকদের জাতিগতভাবে নির্মূলের ঘোষণা দিয়ে বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। হেগের আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে তিনি দণ্ডিত হয়েছেন এবং জেলখানায় তাঁর মৃত্যু হয়। স্লোবোদান মিলোশেভিচের পক্ষে মন্টেনেগ্রো থেকেও অনেকে বসনিয়ায় এসে প্রকাশ্যভাবে সার্ব মিলিশিয়া বাহিনীকে সহায়তা করেছেন এবং গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন।

সারায়েভোর সঙ্গে সরাসরিভাবে সেব্রেনিৎসার গণপরিবহন সংযোগ নেই, শোঅ্যারাউন্ড নামক এক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে কামের ও কেমাল নামের দুই বসনিয়াক তরুণের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। বসনিয়া ভ্রমণকালে তাঁদের থেকে সহায়তা পেয়েছি, তাঁদের কারণে সেব্রেনিৎসা ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বসনিয়া ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় খরচের সম্পূর্ণটা আমার রুমমেট ও এক ক্লাসফ্রেন্ডের থেকে ধার করেছিলাম। ধারের টাকা শোধ করেছি। তবে এখনো তারা জানে না যে তাদের থেকে টাকা ধার নিয়ে আমি বসনিয়া থেকে ঘুরে এসেছি।
বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনার প্রায় পুরো অংশ পর্বতময়। গোটা বলকান অঞ্চলে স্কি রিসোর্ট হিসেবে বসনিয়ার কয়েকটি অঞ্চল বেশ প্রসিদ্ধ। ক্রোয়েশিয়ার সীমান্ত পার হয়ে সারায়েভো এবং সেখান থেকে সেব্রেনিৎসা পর্যন্ত পুরো অংশে ছোট–বড় বিভিন্ন উচ্চতার পাহাড়ের উপস্থিতি যে কাউকে মুগ্ধ করবে।

আরও পড়ুন

বসন্ত আসার সঙ্গে সঙ্গে সব পাহাড় গাঢ় সবুজে ছেয়ে ওঠে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দেশটির বেশির ভাগ জনপদ গড়ে উঠেছে। পর্যটন, কৃষি ও পশুপালন—এ তিনের ওপর ভিত্তি করে দেশটির অর্থনীতি টিকে আছে। শিল্পক্ষেত্রে দেশটি এখনো সেভাবে অগ্রসর হতে পারেনি।

সেব্রেনিৎসায় পা রাখতেই আমার চোখ থেকে পানি ঝরেছিল। পাহাড়ঘেঁষা ছবির মতো সুন্দর এক মিউনিসিপ্যালিটি, অথচ এ মিউনিসিপ্যালিটির অধিবাসীদের বুকে নেমে এসেছিল ইতিহাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন এক গণহত্যার ইতিহাস। ঠিক কতজন মানুষ সার্ব সেনাদের হাতে নিহত হয়েছেন, এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কেমাল বলেন, ‘সেব্রেনিৎসা, ব্রাটুনাচসহ আশপাশের এলাকাগুলোয় সব মিলিয়ে পঁচিশ হাজার বসনিয়াক মুসলমান গণহত্যার শিকার হয়েছেন, যদিও এখন পর্যন্ত সাড়ে সাত হাজার মানুষের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু সেব্রেনিৎসাতে সাড়ে আট হাজারের মতো মানুষ সার্ব সেনবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন।

বিদ্রোহী সার্ব সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে, তাঁদের নামের তালিকা।

বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে এটা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। নারী, পুরুষ ও শিশু থেকে শুরু করে সব শ্রেণির বসনিয়াক মিলোশেভিচের বাহিনীর হাতে নির্বিচারে প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকের পরিচয় আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখনো অনেকে নিখোঁজ। সবাইকে গণকবর দেওয়া হয়েছে।’

কেমাল বলেন, ‘সার্ব সেনাদের বর্বরোচিত আক্রমণে পুরুষ ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারিয়েছে। কেননা, তাদের ধারণা ছিল, পুরুষেরা যুদ্ধে অংশ নিতে সক্ষম। তাই তারা যাতে কোনো ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে, সে জন্য তাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। অন্যদিকে, ভবিষ্যতে বসনিয়াক মুসলমানরা সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে পারে, সে শঙ্কা থেকে শিশুদেরও তারা টার্গেটে পরিণত করেছিল। অন্তঃসত্ত্বা নারীদেরও তারা নৃশংসতা থেকে মুক্তি দেয়নি। এমন অনেক নারী আছেন, যাঁদের চোখের সামনে তাঁদের পেটের বাচ্চাকে হত্যা করা হয়েছে। অসংখ্য নারীকে সার্ব সেনারা ধর্ষণ করেছেন এবং তাঁদেরও প্রাণ হারাতে হয়েছে।’

লেখক ও ট্যুর গাইড কেমাল।

২০০১ সালে সেব্রেনিৎসা ও এর আশপাশের অঞ্চলে মিলোশেভিচের বাহিনীর হাতে প্রাণ হারানো এসব বসনিয়াক মুসলমানকে স্মরণ করতে একটি মেমোরিয়াল স্থাপন করা হয়। এখন পর্যন্ত যাঁদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে, তাঁদের সবার নাম মেমোরিয়ালের ভেতর লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিটি কবরে নামফলকের পাশাপাশি আরবি ও বসনিয়াক ভাষায় বিভিন্ন দোয়া খোদাই করা হয়েছে। কেমাল বলেন, প্রতিবছর ১১ জুলাই গণহত্যার শিকার মানুষকে স্মরণ করতে পুরো বসনিয়া থেকে হাজারো মুসলমান সেব্রেনিৎসায় জড় হন এবং তাঁদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করেন।

গণহত্যার শিকার বসনিয়াকদের স্মরণ করতে মেমোরিয়ালের উল্টো পাশে রাস্তার অপর প্রান্তে একটি পরিত্যক্ত ব্যাটারির কারখানায় জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে। মেমোরিয়াল ও জাদুঘর দুটি স্থান দর্শনার্থীদের জন্য সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত। জাদুঘরের ভেতরে ঢুকতে সেখানে দায়িত্বরত এক তরুণী জানান, কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ থেকে কয়েকজন সমবেতভাবে সেব্রেনিৎসা ঘুরে গিয়েছেন। আমাদের তিনি ওই সময়ে ধারণ করা ডকুমেন্টারি ও ভিডিও ক্লিপ দেখালেন। ওই সময়ের বিভিন্ন ছবি দিয়ে এ জাদুঘর সাজানো হয়েছে। যুগোস্লাভ যুদ্ধের সময় সেব্রেনিৎসা, ব্রাটুনাচসহ বিভিন্ন স্থানে ঘরবাড়ি ও দালানকোঠা থেকে শুরু অসংখ্য স্থাপনা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। এখনো এসব স্থানে যুদ্ধকালীন ধ্বংসপ্রাপ্ত বিভিন্ন স্থাপনার দেখা মেলে।

প্রয়োজনীয় বাজেটের অভাবে দেশটির সরকারের পক্ষে সেগুলো মেরামত করা সম্ভব হয়নি। কেমাল জানান, সার্বরা এখনো শিকার করেন না যে সেব্রেনিৎসাসহ গোটা বসনিয়ায় গণহত্যা হয়েছে। এমনকি রিপাবলিক অব সার্পসকার বিভিন্ন স্থানে আজও মুসলমানরা সার্বদের হাতে বিভিন্নভাবে লাঞ্ছনার শিকার হন। সেব্রেনিৎসাতে যেসব বসনিয়াক বসবাস করেন, তাঁদের স্থানীয় সার্বরা মাঝেমধ্যে উচ্ছেদের হুমকি দেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

শুক্রবার হওয়ায় জুমার নামাজ শেষে সেব্রেনিৎসা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল অন্য রকম। মুসলিম সমাজে জুমার নামাজ শেষে মৃত আত্মীয়স্বজনের রুহের মাগফিরাত কামনায় কবর জিয়ারতের একটি রীতি রয়েছে। মেমোরিয়ালের ভেতরে এক স্থানে এসে বসনিয়ার ভাষায় লেখা কয়েকটি লাইনের দিকে চোখ পড়তে অঝরে কেঁদে দিয়েছিলাম। কেমালও এ সময় অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন, যুগোস্লাভ যুদ্ধে সার্ব মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে তাঁর মামা প্রাণ হারিয়েছেন।

পৃথিবীর ইতিহাসে যাতে আরেকটি সেব্রেনিৎসা নেমে না আসে এবং কোনো মায়ের চোখের সামনে যাতে তাঁর সন্তান হত্যাযজ্ঞের শিকার না হয়, সে কামনা করি। কোনো মানুষের অপমৃত্যু কখনো কাম্য নয়।

লেখক: রাকিব হাসান, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া