সার্ব সেনাবাহিনীর মুসলিম গণহত্যার সাক্ষী সেব্রেনিৎসায় একদিন–১

গণহত্যা চলাকালে বিভিন্ন ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে এ জাদুঘর।

সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে একটি প্রবচন খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন টক শো কিংবা টেলিভিশন প্রোগ্রামে প্রায়ই আমরা একটা কথা শুনি যে ঋণ করে ঘি খাওয়ার কারণে নাকি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি পুরোপুরিভাবে ভেঙে গেছে।

আমি অবশ্য কখনো ঋণ করে ঘি খাইনি। আর এমন এক দেশে বর্তমানে বসবাস করছি, সে দেশে ঘি থেকে শুরু করে বাঙালি জিবে জল আনা যে কোনো খাবারের স্বাদ নেওয়ার সৌভাগ্য নিতান্ত সীমিত। কাজেই প্রবাস জীবনে কোনো দিন ঋণ করে ঘিয়ের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ হবে কি না জানি না, তবে ঋণ করে ভ্রমণে বের হয়েছি সেটা জোর দিয়ে বলা যায়।

২০১৮ সালে স্টুডেন্ট ভিসায় মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়ায় পা রাখার সৌভাগ্য হয়। স্লোভেনিয়া একই সঙ্গে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং সেনজেনের অন্তর্ভুক্ত। স্লোভেনিয়াতে আসার পর থেকে একটা পরিকল্পনা বারবার মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। বাংলাদেশে থাকতে বাইরের পৃথিবীকে সেভাবে ঘুরে দেখার সুযোগ হয়নি। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতগুলোর মধ্যে কক্সবাজার একটি, অন্যদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের অবস্থান আমাদের দেশে। কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সুন্দরবন, সিলেট অর্থাৎ সত্যি কথা বলতে গেলে নিজ দেশের দর্শনীয় স্থানগুলোকে ভালোমতো আবিষ্কার করার সৌভাগ্য আজও হয়নি। সহজে উপভোগ্য জিনিস সত্যি উপেক্ষিত থেকে যায়। ইউরোপের মাটিতে পা রাখার পর তাই দৃঢ়ভাবে সংকল্প করেছিলাম যে স্লোভেনিয়ার টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিটের সুবাদে যতগুলো দেশ ভ্রমণ করা যায়, সবগুলো আমি ঘুরে দেখব। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ২০১৮ সালে প্রথম ইউরোপ ট্যুরে বের হই। আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া ও রোমানিয়া এ তিন দেশ ভ্রমণের মধ্য দিয়ে ইউরোপ ট্যুরের সূচনা করি। আলবেনিয়া ও রোমানিয়া বলকান উপদ্বীপের অন্তর্গত দুটি দেশ, রোমানিয়ার অংশবিশেষও বলকানের মধ্যে পড়েছে। ইউরোপ ট্যুরের সমাপ্তি ঘটেছে বলকান উপদ্বীপের আরেক দেশ বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনাতে এসে। ২৫তম জন্মদিনে এটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় অর্জন।

বিদ্রোহী সার্ব সেনাবাহিনীর হাতে নিহত বসনিয়ার মুসলমানদের কবর।

এখন তাই বুক ফুলিয়ে ও গলা উঁচু করে বলতে পারি যে পূর্বে তুরস্ক ও জর্জিয়া থেকে শুরু করে পশ্চিমে পর্তুগাল ও স্পেন কিংবা উত্তরে আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্ক থেকে শুরু করে দক্ষিণে ইতালি ও ক্রোয়েশিয়া পর্যন্ত ইউরোপের যেসব দেশে সেনজেন ভিসা ব্যবহার করে ভ্রমণ করা যায়, সেসব দেশের সব কয়টিতে আমার পদচারণ পড়েছে। এটা ঠিক যে অনেক জায়গায় এখনো উল্লেখ করার মতো অপ্রাপ্তি রয়ে গেছে। সলো ট্রাভেলার হওয়ার কারণে অনেক সময় মনের মতো ছবি নিতে পারিনি। এ ছাড়া অপরিপক্বতার কারণে অনেক দেশ ঘুরে দেখলেও সেসব দেশের আত্মাকে ভালোমতো বুঝে ওঠার ক্ষেত্রে এখনো বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে।

বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনাকে ঘিরে আমার মাঝে আলাদা একধরনের উন্মাদনা কাজ করছিল। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, আলবেনিয়া ও কসোভো ইউরোপের এ তিনটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম। অটোমান শাসনামলে ইউরোপ মহাদেশে ইসলামি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনার আলাদা সুনাম ছিল।

প্রথমত, পৃথিবীতে অন্য কোনো দেশ পাওয়া যাবে না, যে দেশের শাসনব্যবস্থা বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনার মতো এতটা জটিল। কাগজে-কলমে বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা একক রাষ্ট্র, বাস্তবে ১৯ হাজার ৭৬৭ বর্গমাইলের এ ভূখণ্ডে তিনটি রাষ্ট্র বিরাজমান। আয়তনে যে দেশটি বাংলাদেশের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ, সে দেশে তিনজন রাষ্ট্রপতি শাসনকার্য পরিচালনা করেন, এটা ভাবতে অবাক লাগে। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা প্রকৃতপক্ষে বসনিয়াক, সার্ব ও ক্রোয়েট এ তিনটি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র। এমনিতে বসনিয়াক, সার্ব, মন্টিনিগ্রিন ও ক্রোয়েট এ চার জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মাঝে তেমন কোনো ভিন্নতা নেই। জাতিগতভাবে তারা স্লাভিক হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে মন্টিনিগ্রিন, সার্বিয়ান, বসনিয়ান এবং ক্রোয়েশিয়ান এ চারটি ভাষা আলাদাভাবে পরিচিতি পেলেও আদতে এ চারটি ভাষার মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই। যুগোস্লাভিয়া শাসনামলে এসব ভাষাকে সমন্বিতভাবে সর্বো-ক্রোয়েশিয়ান নামে ডাকা হতো। বসনিয়াকরা মূলত ইসলাম ধর্মকে অনুসরণ করেন।

বিদ্রোহী সার্ব সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে, তাঁদের নামের তালিকা।

অন্যদিকে সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রোর বেশির ভাগ মানুষ অর্থোডক্স খ্রিষ্টানিটিতে বিশ্বাস করেন। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনাতে যেসব সার্ব রয়েছেন, তাঁরাও অর্থোডক্স চার্চকে অনুসরণ করেন। আর ক্রোয়েট হিসেবে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা ক্যাথলিক চার্চের অনুসারী। একসময় বলকান উপদ্বীপে একটা কথা বেশ প্রচলিত ছিল। সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রো এ দুই দেশের অধিবাসীরা একে অপরকে একই বৃন্তের দুই কুসুম হিসেবে বিবেচনা করতেন। মূলত সার্বদের মধ্যে যাঁদের বসতি ছিল আড্রিয়াটিক সাগরের তীরে, তাঁরাই নিজেদের মন্টিনিগ্রিন হিসেবে পরিচয় দিতেন, যদিও মন্টিনিগ্রোর আলাদা ইতিহাস রয়েছে, যেটি সার্বিয়া থেকে ভিন্ন। ধর্মীয় পরিচয় ছাড়া বসনিয়াক, সার্ব, মন্টিনিগ্রিন ও ক্রোয়েট এ চার জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মাঝে পৃথক করার কিছু নেই।

বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনায় প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ প্রত্যক্ষ ভোটে আলাদা নিজেদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। সাধারণত প্রত্যেকে তাঁর নিজ জাতিসত্তার কাউকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভোট দেন, মাঝেমধ্যে ব্যতিক্রম ঘটে। আগেই বলেছি, তিনজন রাষ্ট্রপতি সমন্বিতভাবে এ দেশটির শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এ তিনজন রাষ্ট্রপতির একজন বসনিয়াক মুসলিম, একজন সার্ব এবং অন্যজন ক্রোয়েট। রাষ্ট্রীয় যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনজনকে ঐকমত্য পোষণ করতে হয়। দুটি পৃথক এনটিটির সমন্বয়ে বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা গঠিত। একটি হচ্ছে ফেডারেশন অব বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা এবং অন্যটি হচ্ছে রিপাবলিক অব সার্পসকা। রিপাবলিক অব সার্পসকার নিজস্ব প্রশাসন ও পুলিশ ফোর্স রয়েছে। অপর দিকে ফেডারেশন অব বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা ১০টি ক্যান্টনের সমন্বয়ে গঠিত। সাধারণভাবে যেসব অঞ্চলে সার্বরা সংখ্যায় বেশি, সেসব অঞ্চলকে একীভূত করে ‘রিপাবলিক অব সার্পসকা’ নামে ডাকা হয়। অন্যদিকে হার্জেগোভিনাতে মূলত ক্যাথলিক খ্রিষ্টানিটিতে বিশ্বাসী ক্রোয়েটরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলমানরা বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনার সর্বত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে, এমনকি রিপাবলিক অব সার্পসকা কিংবা হার্জেগোভিনার অনেক স্থানেও মুসলিমদের জনবসতি চোখে পড়ার মতো। রাজধানী সারায়েভোতে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।

লেখক ও ট্যুর গাইড কেমাল।

রিপাবলিক অব সার্পসকায় বসবাসরত সার্ব জাতিগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের মানুষ সার্বিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চান। এ কারণে রিপাবলিক অব সার্পসকার বিভিন্ন স্থানে সার্বিয়ার পতাকার অনুরকরণে তৈরি আলাদা একধরনের পতাকার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। একইভাবে ক্যাথলিক ক্রোয়েটদের একটি বড় অংশ হার্জেগোভিনাকে ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করতে আগ্রহী। এদের অনেকে দ্বৈত নাগরিক, অর্থাৎ বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনার পাশাপাশি তাঁদের ক্রোয়েশিয়ার নাগরিকত্ব রয়েছে। হার্জেগোভিনার বিভিন্ন স্থানে ক্রোয়েশিয়ার পতাকা ঝুলতে দেখা যায়। চলবে....

*লেখক: রাকিব হাসান, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া