পঞ্জিকা অনুযায়ী ঋতুর বিভাজন এমন হলেও বাস্তবে একই দিনে সব ঋতুর দেখা অহরহ পাওয়া যায়। তাই অস্ট্রেলিয়ায় বহুল প্রচলিত একটা কৌতুক হচ্ছে, এখানে তিনটি জিনিসকে কখনোই বিশ্বাস করবেন না। সেই তিনটি জিনিস হলো অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া, কাজ আর মেয়েমানুষ। আমরা আজ বিস্তারিত সেই আলোচনায় যাব না; বরং আবহাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব।
পঞ্জিকা অনুযায়ী এখানে এখন বসন্তকাল। শীতের শেষে সেপ্টেম্বরের প্রথম দিন থেকেই তাপমাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। আর হুমায়ুন আহমেদের ভাষায়, বসন্তের লিলুয়া বাতাস বইতে শুরু করে। প্রকৃতিতে যৌবনের স্পন্দন দেখা যায়। গাছগুলো পুরোনো পাতা বিসর্জন দিয়ে নতুন পত্রপল্লবে সুশোভিত হয়। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জায়গায় চেরি উৎসবের আয়োজন করা হয়। চেরি উৎসব বলতে চেরি ফলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। অনেক ফুল এ সময় একসঙ্গে ফোটে, সেগুলোর সামগ্রিক সৌন্দর্যকে চেরি উৎসব বলা হয়। এ ছাড়া গাছে গাছে চোখজুড়ানো, মনভোলানো বাহারি রঙের ফুল দেখা যায়।
সারা অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘ শীতের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে বিভিন্ন রকমের উৎসব আয়োজন করা হয়ে থাকে। যেমন সিডনির অন্যতম সিগনেচার ফেস্টিভ্যাল বন্ডাই উইন্ড উৎসব, যেখানে রংবেরঙের শত শত ঘুড়ি বন্ডাই সমুদ্রসৈকতের আকাশে ভেসে বেড়ায়। সকাল ১১টায় শুরু হয়ে সেই উৎসব চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। করোনার কারণে এ বছর সব উৎসব নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আমাদের মেয়ে তাহিয়া ও আমি মিলে ঠিক করলাম, আমরা অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেনে যাব, যেটি মাউন্ট অ্যানানে অবস্থিত। অস্ট্রেলিয়াজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে অনেক বোটানিক্যাল গার্ডেন। দ্য অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেন আমাদের বাসা থেকে সবচেয়ে কাছে। তাই আমরা সেখানে যাওয়ার জন্যই মনস্থির করলাম। সময়টা সেপ্টেম্বরের শেষ প্রায়।
এই ফাঁকে দ্য অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেনের কিছু তথ্য দিয়ে রাখি। বাগানটি ৪১৬ হেক্টর জমির ওপর অবস্থিত। এখানে প্রায় চার হাজার প্রজাতির গাছ রয়েছে। বাগানের এই বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম। সেই ১৮১৮ সাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায় পার করে বাগানটি আজকের এই অবস্থায় এসেছে। ১৯৮৮ সালে অফিশিয়ালি বাগানটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। শুরুতে এখানে ঢোকার জন্য ফি নির্ধারণ করা হলেও ২০১১ সাল থেকে সেটি বাতিল করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। গত বছরই দ্য অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেন তাদের ত্রিশ বছর পূর্তি উদযাপন করেছে। সে উপলক্ষে ইংরেজি অক্ষরে ত্রিশ লেখা বিশাল এক ভাস্কর্য বাগানের কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছিল।
আমাদের বাসা থেকে বোটানিক গার্ডেনে যেতে কুড়ি মিনিটের ড্রাইভ। অবশ্য আপনি সিডনি সিটি থেকে যেতে চাইলে ঘণ্টাখানেকের ড্রাইভ। গাড়িতে সাধারণত শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালিয়ে রাখা হয়, কিন্তু আজ আর সেটি করলাম না। কারণ, বাইরে বসন্তের নাতিশীতোষ্ণ বাতাস বইছিল। তাই আমরা বসন্তের বাতাস গায়ে মেখে এগিয়ে চললাম। বোটানিক গার্ডেনে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে গায়ে একটা শীতল বাতাসের ছোঁয়া লাগল। একটু এগিয়ে যেতেই নাকে মধুর ম–ম গন্ধ এসে লাগল। আমরা সামনে খেয়াল করে দেখি, বোটানিক গার্ডেনের স্প্রিং গার্ডেনে ফুটে আছে অনেক ফুল। এই ম–ম গন্ধ সেখান থেকেই আসছে।
আমরা নির্দিষ্ট কার পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে ফুলের বাগানের কাছে গেলাম। সেখানে অনেক মানুষ ফুলের সঙ্গে নিজের বা নিজেদের পরিবারের ছবি তুলছে। আমরাও বিভিন্ন রকমের ছবি তুলতে শুরু করলাম। আমাদের পাশেই এক নবদম্পতি ছবি তুলছিলেন। তাঁদের ছবি তুলতে দেওয়ার জন্য কিছুক্ষণ আমাদের হাঁটা থামিয়ে দিলাম। ছবি তোলা শেষ হলে তাঁরা আমাদের ধন্যবাদ দিলেন নির্বিঘ্নে ছবি তোলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। আমি বললাম, ইট’স ওকে। এ ধরনের সৌজন্যমূলক কথাবার্তা অস্ট্রেলিয়ার পথেঘাটে হরহামেশাই হয়। আমি বললাম, আপনি কি বাতাসের গন্ধটা অনুভব করতে পারছেন? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ আমি বললাম, এটি মধুর গন্ধ। শুনে তিনি বললেন, ‘তাই তো ভাবছিলাম, গন্ধটা কেন এত পরিচিত মনে হচ্ছিল।’
অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেনে অন্য সময়েও অনেক মানুষের সমাগম থাকে। কিন্তু বসন্তকালে সংখ্যাটা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। বোটানিক গার্ডেনের বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে পরিকল্পনামাফিক লাগানো লক্ষ লক্ষ গাছ। পুরো বোটানিক গার্ডেন ঘুরে দেখতে হলে আপনাকে সারা দিন সময় নিয়ে আসতে হবে। গার্ডেনের হ্রদগুলোতে হাঁস, পানকৌড়ি সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। আপনার কপাল ভালো হলে শতবর্ষী কচ্ছপের দেখাও পেয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া কপাল যদি আরও একটু ভালো হয়, তবে পেয়ে যেতে পারেন ক্যাঙারুর দেখাও।
ঘুরতে ঘুরতে আমাদের ক্ষুধা পেয়ে গেল। বোটানিক গার্ডেনের মধ্যে রয়েছে শিশুদের জন্য একটি পার্ক, একটি ক্যাফে, টয়লেট এবং শেডের তলায় আছে বারবিকিউয়ের ব্যবস্থা। তবে ক্যাফেতে খাবারের দাম আমার কাছে একটু চড়াই মনে হয়েছে। এবার করোনার কারণে ক্যাফে বন্ধ থাকায় বাগানের কেন্দ্রে একটি ভ্রাম্যমাণ ক্যাফে স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে আইসক্রিম থেকে শুরু করে হালকা খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যাচ্ছে। আমি তাহিয়া ও রায়েনাকে দুটি আইসক্রিম কিনে দিলাম। এতক্ষণ যে ফুলের সমারোহ দেখছিলাম, সেগুলো শুধু বসন্তকালীন অস্থায়ী ফুলের বেড।
এরপর আমরা মূল বাগানের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। বাসন্তী বাগানের ফাঁকে কয়েকটি ধাতব মৌমাছির মূর্তি আছে। মূর্তি দুটির কঙ্কাল ধাতুর তৈরি হলেও শরীরটা মাটির এবং সেই মাটির মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকমের ফুলের গাছ লাগানো। দেখতে অনেক সুন্দর। অন্যান্য সময়ে এত বেশি সুন্দর না লাগলেও শরীরের বাসন্তী ফুলগাছগুলোতে এই সময়ে ফুল ফুটে মৌমাছিগুলোকে জীবন্ত রূপ দেয়। বাচ্চারা এমন মৌমাছি দেখে খুবই অবাক হলো। অনেকেই মৌমাছির সামনে–পেছনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন। আমিও এক মা–মেয়েকে ছবি তুলতে সাহায্য করলাম।
আমরা ঘুরেফিরে একসময় একেবারে চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। সেখানে এক টুকরা সবুজের বিছানা। বাচ্চারা সেখানে গিয়ে শুয়ে পড়ল। সেখান থেকে চারপাশে অনেক দূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। এক অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি এসে ছবি তোলা শুরু করলেন। দুটি আফ্রিকান বাওবাবগাছ আছে সেখানে। যেগুলো দেখতে সাধারণ গাছের উল্টো। মনে হয় মাটি থেকে হঠাৎ একটা আস্ত কাণ্ড বের হয়ে গেছে। তারপর কাণ্ডের মাথার শাখাগুলোকে মনে হয় যেন শিকড়। অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রমহিলা একটি বাওবাবগাছকে জড়িয়ে ধরে আছেন আর ভদ্রলোক তার ছবি তুলছেন দেখে আমি পাশ থেকে বললাম, কেউ একজন গাছের সঙ্গে ভালোবাসা করছেন।
আমার কথা শুনে তাঁরা দুজনই হেসে দিলেন। তারপর ভদ্রলোক বললেন, ‘এটি তো আফ্রিকান বাওবাবগাছ।’ আমি বললাম, জি, এটি বাওবাব গাছ। উত্তর শুনে তিনি গাছের ছোট্ট নেমপ্লেট দেখিয়ে বললেন, ‘কিন্তু এখানে তো অন্য নাম লেখা।’ আমি বললাম, ‘এটিকে বলে সায়েন্টিফিক নাম। কিন্তু আমি নিশ্চিত এটি বাওবাবগাছ।’ তারপর তাঁরা আমাদের বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেলেন অন্য একটি বাওবাবগাছের দিকে। আমি তখন আবারও বললাম, ডোন্ট লুজ হার উইথ দ্য ট্রিস। আমার কথা শুনে ভদ্রলোক আবারও হাত নেড়ে সায় দিলেন।
এরপর আমরা গাছের ছায়াঢাকা পথ পার করে একটি খোলা জায়গায় এসে পৌঁছালাম। সেটি বোটানিক গার্ডেনের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। পাশেই একটি বিশাল আকারের গোলাকৃতি পানির ট্যাংক। একটা রাস্তা চলে গেছে পানির ট্যাংকের দিকে। সেই রাস্তায় দাঁড়ালে দূর থেকে মনে হবে আপনি শূন্যে দাঁড়িয়ে আছেন। কারণ, রাস্তাটির পেছনে পুরোপুরি ফাঁকা। এভাবে চলতে চলতে আমাদের সময় ফুরিয়ে এল। এখানে উল্লেখ্য, বোটানিক গার্ডেন শীতকালে বিকেল পাঁচটা এবং গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে।
বোটানিক গার্ডেনে এর আগেও আমরা গিয়েছি এবং এর সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়েছি। কিন্তু এবারের ভ্রমণটি ছিল মনে রাখার মতো। কারণ, সারাটি সময়ই আমাদের নাকে ফুলের মধুর ম–ম গন্ধটা লেগে ছিল। তাই এবারের ভ্রমণটিকে আমরা বললাম, ‘মৌমাছিদের সঙ্গে একটা দিন’।