বিয়েভীতি: দ্বিতীয় পর্ব
রিকশা সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। আমি তুলির পাশে জড়সড় হয়ে বসে আছি। তুলি এখনো শক্ত করে আমার হাত ধরে রেখেছে। আমি মিনমিন করে বললাম,
-তুলি শোন, পাগলামি করিস না। বিবাহ ছাড়া এসব করা মহাপাপ। এটা কিন্তু জিনা বা ব্যভিচার। আর পরকালে জিনাকারীর শাস্তি কিন্তু খুবই ভয়াবহ।
আমার কথায় তুলির চেহারায় কোনো পরিবর্তন দেখলাম না।
-আর শুধু পরকাল কেন, এই কালেও কি কম সমস্যা? পুলিশ প্রায় সময় এসব আবাসিক হোটেলে তল্লাশি করে। তারপর থানায় ধরে নিয়ে যায়।
এবারও তুলি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না।
-শোন, তোকে তো তোর বাবা থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে। একবার ভেবে দেখ, আমার কী হবে? আমার পরিবার তো গ্রামে থাকে। তারা আসতে আসতে তো পুলিশ আমার বারোটা বাজিয়ে দেবে। আমি শুনেছি, পুলিশ যেসব ছেলেদের হোটেল থেকে ধরে নিয়ে যায়, তাদের নাকি বিবস্ত্র করে লাঠি দিয়ে পেটায়। ধর, আমারে যদি বিবস্ত্র করে পেটাতে যায় এবং তখন যদি দেখে আমার পরনে লাল জাঙ্গিয়া, তাহলে তো ওরা আমারে মাইরা শেষ করে ফেলবে। হয়তো মারবে আর বলবে, তুই লাল জাঙ্গিয়া পরস? তোর মনে এত রং?
তুলি এবারও আমার কথার কোনো উত্তর দিল না।
-আচ্ছা আমার কথা না হয় বাদ দিলাম। পুলিশে ধরলে তোর কী হবে? তোর বাবা না হয় তোকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল, কিন্তু ঘটনা তো সবাই জেনে যাবে। তখন কি তোর আর বিয়ে হবে? কেউ তো তোকে আর বিয়ে করতে চাইবে না।
আমার কথা শেষ হতেই তুলি শান্ত কণ্ঠে রিকশাওয়ালা মামাকে বলল,
-মামা আমরা হোটেল যাব না। হোটেলে যাওয়া ক্যানসেল।
আমি তুলির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললাম,
-ধন্যবাদ। আমি জানতাম, তুই একটা বুদ্ধিমতী মেয়ে। তোরে বোঝালে তুই বুঝবি।
তুলি এবারও আমার কথার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। এমনকি আমার দিকে তাকালও না। সে মামাকে বলল,
-মামা এ এলাকায় কি কোনো কাজি অফিস আছে?
-জি আছে। এই তো সামনেই।
-ঠিক আছে, প্রথমে ওখানেই চলেন। এরপর আমরা হোটেলে যাব।
আমি বুঝলাম, আজ এই মেয়ের মতিগতি আসলেই ভালো না। আমি ভয় পেয়ে বললাম,
-মাইগড, তুই কি এখন আমারে বিয়ে করবি? শোন, আমি কিন্তু এখন বিয়ের জন্য একদম রেডি না। বিয়ের জন্য আমার সময় প্রয়োজন। অ্যাটলিস্ট আরও ২০ বছর।
তুলি ঘাড় ঘুরিয়ে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল। আমি আমতা-আমতা করে বললাম,
-না, মানে ২০ বছর অবশ্য একটু বেশি হয়ে যায়। তখন তো আমরা প্রায় বুড়া হয়ে যাব। আচ্ছা ২০ বছর না, তুই শুধু আমারে দুইটা বছর দে।
তুলি আমার কথা না শোনার ভান করে মামাকে বলল,
-মামা আপনি কি আমাদের বিয়ের সাক্ষী হতে পারবেন?
মামা কিছু বলার আগে আমি বললাম,
-কী যা তা বলছিস? উনি রিকশা ফেলে কীভাবে আমাদের বিয়ের সাক্ষী হবেন? উনার রিকশা তো চুরি হয়ে যাবে। এক কাজ কর, আজ থাক। আমরা না হয় অন্য একদিন বন্ধুদের সাথে করে নিয়ে আসব।
আমার কথা শেষ হতেই মামা বললেন,
-আফা আমনে চিন্তা কইরেন না। আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি সাক্ষী হব। তয় আফা, টাকাটা একটু বাড়ায়ে দিয়েন।
-ঠিক আছে বাড়িয়ে দেব। কিন্তু মামা, সাক্ষী তো আরও লাগবে।
-চিন্তা কইরেন না। কাজি অফিসের সামনে গিয়া আরও কয়েকজন রিকশাওয়ালারে সাথে লইয়া নিমুনে। আমনে শুধু কয়টা টাকা বাড়ায়ে দিয়েন।
-ঠিক আছে মামা। বললাম তো, আমি টাকা বাড়িয়ে দেব।
আমি ধরা খাওয়ার চিন্তায় হতাশায় নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে তুলির দিকে তাকালাম। দেখলাম, সে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখেমুখে দৃঢ় একটা ভাব ফুটে রয়েছে। তুলি সহজে রাগে না, তবে রাগলে ওকে মানানো খুবই কঠিন কাজ। এমন জেদি মেয়ে আমি খুবই কম দেখেছি।
খেয়াল করলাম, রিকশাওয়ালা মামা বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে আমাকে দেখছে, আর ফিকফিক করে হাসছে। ব্যাটা বদমাশ, আমার বিপদে মজা নিচ্ছে। ইচ্ছে করছে ব্যাটারে নিয়ে পচা পানিতে চুবাই। মনে মনে বললাম, ব্যাটা ফাজিল, তোর এত টাকার লোভ ক্যান? আমার বিয়ের সাক্ষী হওয়ার কী দরকার তোর?
একটু আগে আমাদের বিয়ে সমাপ্ত হলো। এরপর রিকশাওয়ালা মামাদের নিয়ে আমরা একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁয় গেলাম। তুলি সবাইকে পেট ভরে খাওয়াল। কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোনো খাবার নামল না। অনেক কষ্টে শুধু একটু স্যুপ গলা দিয়ে নামাতে পারলাম। নিজেকে কেন জানি খুব এতিম এতিম মনে হচ্ছে।
খাওয়া শেষে তুলি মামাদের বকশিশ দিয়ে বিদায় করল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-মুখটাকে এমন করে রেখেছিস কেন? আমি জানি, এভাবে বিয়ে করায় তোর মন খারাপ। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। শোন, আমার পক্ষে তোকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না। অথচ আজ মামার অফিসে, মামার কাছে তোর সব কথা শুনে বুঝলাম, তুই আমাকে সহজে বিয়ে করবি না। তাই জোর করেই কাজটা করতে হলো।
-না না, ঠিক আছে। তোর বিবেকে যা কুলাইছে, তুই আমার সাথে তা-ই করেছিস। বিয়ে তো শেষ। এখন আমাকে ছাড়, আমি হলে যাই।
- হলে যাবি মানে? আমরা এখন হোটেলে যাব। রুম ভাড়া করব। তা-র-প-র……। এখন তো আর এটা জিনা হবে না, তাই না?
বলেই তুলি হাসতে লাগল, কিন্তু তুলির এই ফানে আমার হাসি এল না। আমি তুলিকে বললাম,
-প্লিজ আমাকে যেতে দে। আমার ওপর এত অত্যাচার করিস না।
-প্রশ্নই আসে না। আজ আমাদের বাসররাত। যে জন্য বিয়ে করলাম, সেটা না করেই তোকে ছেড়ে দেব? এটা কি হয়?
-তুই কি সিরিয়াস?
-অবশ্যই সিরিয়াস। পরীক্ষা করে দেখতে হবে না আমার জামাই টারজান না অন্য কিছু।
বলেই তুলি আবার খিলখিল করে হাসতে লাগল। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
-তা সেই পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আমাকে এখন কোথায় নিয়ে যাবি? শোন, আমি কিন্তু কোনো হোটেলে যাব না।
-ঠিক আছে, হোটেল বাদ। তা কোথায় যাবি? আমার বাসায় যাওয়া যেত, কিন্তু বাবার জন্য সেটা সম্ভব না। কারণ, বাবা একেবারে মেরে ফেলবে। এক কাজ করি, চল, মামার বাসায় যাই। ওখানেই আজ রাতে আমাদের বাসর হবে। তারপর কাল সকালে, তুই হলে আর আমি বাসায় ফিরে যাব। বিয়ের ব্যাপারটা আপাতত মামা-মামি ছাড়া আর কেউ জানবে না। এরপর সব দায়িত্ব তোর। কীভাবে কী করবি, সেটা আমি জানি না। স্বামী হিসেবে তোর তো সেই চাপটা নিতে হবে, তাই না?
আমরা উবার কল করে মামার বাসার উদ্দেশে রওনা হলাম। গাড়িতে বসে তুলি প্রথমে ওর বাসায় ফোন করল। ফোন করে মাকে বলল, আজ রাতে ও বাসায় ফিরবে না। মামার বাসায় থাকবে। এরপর তুলি মামাকে ফোন করে জরুরি ভিত্তিতে বাসায় আসতে বলল।
আমি এখন মামার বাসার ড্রয়িংরুমে একাকী বসে আছি। বেশ অনেকক্ষণ হয়েছে আমরা মামার বাসায় এসেছি। তুলি একটু আগে ভেতরের রুমে গিয়েছে মামি আর ওর মামাতো ভাই-বোনের সাথে গোপনে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে। ভাবলাম, এটাই পালানোর সুযোগ। আমি সোফা থেকে উঠে দরজার দিকে এগোতেই দেখলাম, মামা বাসায় ঢুকছেন। উনি আমাকে দেখেই রেগে গেলেন। বললেন,
-এই ছেলে তুমি এখানে কেন?
মামাকে দেখেই আমারও খুব রাগ হলো। কারণ, এই বুইড়াই আজ তুলিকে আমার সম্পর্কে নেগেটিভ ধারণা দিয়েছে। যার কারণে তুলি আজ আমারে জোর করে বিয়ে করল। ঠিক করলাম, এরে আজ জ্বালাতন করে মারব।
-আপনার স্ত্রীকে একটা পরামর্শ দিতে এসেছি।
-মানে কী!
-শোনেন, আজ ইন্টারভিউ বোর্ডে আপনাকে দেখেই আমার মায়া লেগেছে। আমি চাই, আপনার উপকার করতে। আপনাকে বৈবাহিক জীবনের চাপ থেকে মুক্ত করতে। কিন্তু আপনি তো আমার সাথে বান্দরবান যেতে রাজি হচ্ছেন না। সমস্যা নাই, আমার মাথায় আরেকটা সুন্দর আইডিয়া এসেছে। সেই আইডিয়া অনুযায়ী আমি এখন আপনার স্ত্রীকে কিছু পরামর্শ দেব। দেখবেন, উনি আমার পরামর্শ পাওয়ার পর আপসে আপনার জীবন থেকে সরে গিয়ে আপনাকে চাপমুক্ত করে দেবে।
-তোর পরামর্শের গুষ্টি কিলাই। বেটা বদমাশ, খবরদার, তুই আমার বাসার কাউকে কোনো পরামর্শ দিবি না। তাহলে আমি তোরে খুন করে ফেলব। ব্যাটা পাগলের বংশ।
মামার চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে ড্রয়িংরুমে এল। তুলি এসে মামাকে শান্ত করে আমাদের বিয়ের কথা খুলে বলল। মামা সব শুনে বললেন,
-শোন মা, কোনো চিন্তা করিস না। আমি তোর বাবাকে ম্যানেজ করব। তবে তোর কাছে আমার শুধু একটাই অনুরোধ, তুই এই বদমাশটাকে বল, সে যেন আমার স্ত্রী বা আমার ছেলেমেয়েকে কোনো ফালতু পরামর্শ না দেয়।
এরপর মামা সামনে বসে থাকা উনার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েকে বললেন,
-তোমরা একটা কথা মন দিয়ে শোনো, তোমরা জীবনেও এর কাছ থেকে কখনো কোনো পরামর্শ চাইবে না। এমনকি ও যদি নিজ থেকে তোমাদের কোনো পরামর্শ দিতে চায়, সেটাও শুনবে না। কারণ, এ ছেলের মাথায় কিঞ্চিৎ সমস্যা আছে। এ ছেলে কখনো মানুষকে সুস্থ পরামর্শ দেবে না।
তুলি কপট রাগের ভঙ্গিতে মামাকে বলল,
-মামা, তুমি কিন্তু আমার স্বামীকে অপমান করছ?
-না রে মা, আমি অপমান করছি না। আমি নিজের সংসার রক্ষা করছি। একে আমি এক দিনেই চিনে ফেলছি। এ বড়ই ভেজাইল্লা মানুষ।
-মামা তুমি চিন্তা করো না। ও এসব কিছুই করবে না। মামা, তোমার কিন্তু ওকে একটা চাকরি দিতে হবে।
-প্রশ্নই আসে না। তুই যদি আমাকে আত্মহত্যা করতে বলিস, আমি তাতেও রাজি। কিন্তু এ ছেলেকে আমার অফিসে ঢুকতে দেব না।
তুলি অবাক হয়ে বলল,
-কেন মামা?
-কোনো কেনটেন বুঝি না। এই চিজ আমি আমার অফিসে ঢোকাব না। ব্যস।
একটু আগে মামা উনার স্ত্রী-সন্তানদের তুলির সাথে মার্কেটে পাঠিয়েছেন। উদ্দেশ্য, আমার আর তুলির জন্য কিছু কেনাকাটা করা। মামা চাচ্ছেন, তুলির বিয়েটা সাদামাটা হলেও বাসরটা যেন ফুলে ফুলে সাজানো হয়। আমাকেও শপিংয়ে যেতে বলেছিলেন, আমি যাইনি। আমি আসলে পালানোর ধান্দায় আছি, যেটা তুলির সামনে সম্ভব না। ঠিক করেছি, তুলি শপিংয়ে গেলেই চান্স নেব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মামাকে নিয়ে। তুলি কৌশলে আমাকে পাহারা দেওয়ার জন্য মামাকে রেখে গেছে।
মামা আর আমি ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলাম। এ সময় মনে হলো, মামাকে একটু বিরক্ত করি। উনাকে বিরক্ত করে আমার মনের রাগটা একটু কমাই। আমি টিভির সাউন্ড কমিয়ে দিয়ে মামাকে বললাম,
-মামা শোনেন, খামাখা আপনারা টাকাপয়সা নষ্ট করে আমার জন্য কেনাকাটা করছেন। আমি তো সুযোগ পেলেই পালাব।
-পালাবে মানে?
-মামা আপনি আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনেন। বিয়ে করে আপনি যেমন চাপের মধ্যে আছেন, আমিও এখন তেমনি চাপের মধ্যে আছি। এ চাপ থেকে আমার-আপনার দুজনেরই মুক্তি দরকার। মামা, বাসায় তো এখন কেউ নাই, চলেন আমরা দুজনে পালিয়ে বান্দরবান চলে যাই। এমন সুযোগ সব সময় আসবে না।
-তোমারে না বলছি আমারে কুপরামর্শ দিবা না।
-মামা বুঝেছি, আপনি জাঙ্গিয়া পরে গাছে ঝুলতে হবে বলে লজ্জা পাচ্ছেন, তা-ই না? অবশ্য এটা স্বাভাবিক। আপনি তো আর কখনো টারজানের মতো শুধু জাঙ্গিয়া পরে সারা দিন থাকেননি, যার কারণে আপনি এত লজ্জা পাচ্ছেন। শোনেন, আমরা দুজনে এখন বাসায় জাঙ্গিয়া পরে একটু প্র্যাকটিস করব। দেখবেন, প্র্যাকটিস করলেই আপনার লজ্জা ভেঙে যাবে। মনে সাহস আসবে। তখন আর আপনার বান্দরবান যেতে খারাপ লাগবে না। চলেন, প্যান্ট-শার্ট সব খুলে, আমরা টারজান হয়ে যাই। অবশ্য আপনার তো আবার লাল জাঙ্গিয়া নাই। লাল জাঙ্গিয়া ছাড়া কিন্তু টারজান হওয়া যাবে না। আচ্ছা মামা, আপনার কি সাদা জাঙ্গিয়া আছে? থাকলে নিয়ে আসেন। আমি নেইল পলিশ বা লিপস্টিক দিয়ে ওটার রং লাল করে দিচ্ছি।
-ওই তোরে না বলছি, আমারে কুপরামর্শ দিবি না।
বুঝলাম, মামা ধীরে ধীরে রাগছেন। আমি আবার বললাম,
-মামা আপনি রাগছেন কেন? আমি তো আপনার উপকার করতে চাচ্ছি। আপনাকে আপনার বউয়ের হাত থেকে বাঁচাতে চাচ্ছি। অথচ আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন?
মামা এবার তার মেজাজ হারালেন। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন,
-ওই ফাজিলের ফাজিল, আমি কি তোর কাছে কোনো উপকার চাইছি? আমি কি তোর কাছে কোনো পরামর্শ চাইছি? আমি কি তোরে একবারও বলছি যে আমি আমার বউকে নিয়ে বিপদে আছি?
-না, তা বলেননি। কিন্তু আপনার মুখ দেখলেই বোঝা যায়, আপনি বউ নিয়ে বড়ই বিপদে আছেন।
-ওই, তুই কি সবজান্তা শমসের? তুই কি গণকঠাকুর? যে মানুষের মুখ দেখে সব বুইঝা ফেলিস?
মামা এ কথা বলেই ফোন হাতে নিলেন। তারপর তুলিকে ফোন করলেন। মামা চিৎকার করে তুলিকে বললেন,
-ওই তোর কেনাকাটা বন্ধ কর, তুই তাড়াতাড়ি বাসায় আয়। এই হারামজাদা আমারে পাগল বানায়ে ফেলতেছে। আমি শিওর, তোরা আসতে দেরি করলে ও আমারে জোর করে কাপড় খুলে লাল জাঙ্গিয়া পরায়ে দেবে। তোরা যখন বাসায় আসবি, তখন হয়তো দেখবি, আমি টারজান হয়ে ওহোওওওওও ওহোওওওওও করতেছি আর পুরা ঘর দৌড়াইতেছি।
তুলি কী বলেছে জানি না। মামা ফোনটা আমার হাতে দিলেন। আমি ফোনে হ্যালো বলতেই, তুলি আমাকে ধমক দিয়ে বলল,
-ওই কুত্তা, তোর সমস্যা কী? তোরে না বলছি মুরব্বিদের সাথে বেয়াদবি করবি না? শোন, আমি না আসা পর্যন্ত মামার সাথে তুই আর কোনো কথা বলবি না। খবরদার। আর শোন, তোর জন্য আমি এখন পাঞ্জাবি কিনতেছি। বল, কোন কালার কিনব।
-লাল। আমার জন্য যা যা কিনবি, সব লাল। আমি টারজান।
তুলি লাইন কেটে দিতেই আমি মামাকে ফোন ফেরত দিলাম। দেখলাম, মামা এখনো রাগে ফুঁসছেন। আমি মামাকে বললাম,
-মামা, আপনি তুলিকে ফোনটা না করলেও পারতেন। আমরা পুরুষ মানুষ, আমরা টারজান হব, নাকি বান্দর হব, সেটা তো আমাদের ব্যাপার তাই না? এ বিষয় কেন অন্যকে জানাতে হবে? মামা শোনেন, আমি আপনাকে একটা জিনিস বোঝাই। আপনার বয়স হয়ে গেছে। আপনি কিন্তু মামির চোখে এখন একজন বুইড়া ছাড়া আর কিছু না। এখন যদি আপনি মামির সামনে টারজানের মতো জাঙ্গিয়া পরে দৌড় দেন আর ওহোওওওওও ওহোওওওওও করেন, তাহলে মামি কিন্তু অনেক খুশি হবেন। মামি আপনাকে নিয়ে গর্ববোধ করবেন। উনি সবাইকে গর্ব করে বলবেন, আমার স্বামী একজন টারজান। আপনি কি মামিকে গর্বিত করতে চান না?
মামা কিছু বললেন না। তবে রাগে তিনি ফোঁসফাঁস করতে লাগলেন। আমি এবার ঠিক মামার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর মামার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-মামা আসেন, পোশাকটা খুলে ফেলেন। এখন আমরা দুজনে জাঙ্গিয়া পরে সারা বাড়ি দৌড়াব আর টারজানের মতো ওওওওওওওও করে আওয়াজ করব।
দেখলাম, মামা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে রাগে তার চোখ দুটো যেকোনো সময় বের হয়ে আসবে। জানি, বিষয়টা বেয়াদবি হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। আমার বিয়ের প্রতিশোধ আমাকে নিতেই হবে। আর তা ছাড়া আমি চাচ্ছি মামা রাগ করে অন্য রুমে চলে যাক, সেই সুযোগে আমি পালাব।
-মামা আপনি এমন করছেন কেন? আরে বাবা, অ্যাটলিস্ট একবার ট্রাই তো করবেন। চেষ্টা DO. দেখেন, আমিও খুলছি। নেন প্যান্ট খোলেন।
বলেই আমি আমার প্যান্ট খোলার জন্য বেল্টে হাত দিলাম। এবার মামার ধৈর্যের সব বাঁধ ভেঙে গেল। উনি বসা থেকে চোখের পলকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আমার হাত ধরে টানতে টানতে পাশের রুমের সামনে নিয়ে গেলেন। রুমের সামনে দাঁড়িয়ে মুখের কাছে দুই হাত নিয়ে টারজানের মতো ওহোওওওওও ওহোওওওওও করে দুইবার চিৎকার দিলেন। তারপর আমাকে ধাক্কা মেরে রুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। এরপর চিৎকার করে বললেন,
-হারামজাদা, Leg Round-এর গুষ্টি Leg Round, তুই বন্দীই থাক। আজ সারা রাত তুই এই রুমে আটকা থাকবি। কাল সকালে তোরে আমি পাবনায় গিয়ে রেখে আসব। তোর জায়গা পাগলাগারদে। ওহোওওওওও ওহোওওওওও …….
মামা টারজানের মতো করে আবার দুইবার আওয়াজ করলেন। আমি মামার ইংলিশ শুনে অবাক হলাম। উনি এটা কি বললেন ? ‘Leg Round-এর গুষ্টি Leg Round’-এর মানে কী? হঠাৎ করেই মনে পড়ল, Leg মানে পা, Round মানে গোল। তার মানে, মামা আমাকে ‘পাগলের গুষ্টি পাগল’ বলে গালি দিয়েছেন। রুমের ভেতর থেকে আমি চিৎকার করে বললাম,
-মামা, আপনি তো আমার ইংরেজিতে কথা বললেন। ধন্যবাদ। মামা দেখছেন, আমি কত বড় মেধাবী, কত বড় গবেষক? শেষ পর্যন্ত আপনিও কিন্তু আমার ইংরেজিতে কথা বললেন।
-চুপ কর হারামজাদা।
-মামা প্লিজ, দরজাটা খোলেন। আপনি না যান, কমপক্ষে আমাকে পালানোর সুযোগ দেন। না হলে আজ রাতে আমার সব শেষ হয়ে যাবে।
মামা আর কোনো কথা বললেন না। বুঝলাম, তুলিরা না আসা পর্যন্ত মামা আর দরজা খুলবেন না। ভাবলাম, বাবাকে ফোন দিয়ে দুঃখটা শেয়ার করি। বাবাকে ফোন দিলাম,
-বাবা, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।
-কেন, কী হয়েছে?
-আজ তুলি আমাকে জোর করে বিয়ে করে ফেলেছে।
বাবা আমার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন।
-বাবা তুমি হাসতেছ?
-শোন, সারা জীবন সিনেমা-নাটকে দেখলাম ছেলেরা মেয়ে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে জোর করে বিবাহ করে আর আমার ছেলেকে কিনা একটা মেয়ে উঠিয়ে নিয়ে বিয়ে করে ফেলল? বিষয়টা খুবই ইন্টারেস্টিং। তাই একটু হাসলাম। শোন, তোর মা শুনলে খুবই খুশি হবে। তুই বউ নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আয়।
-বাবা, তুমি এসব কী বলছ? বউ নিয়ে আসব মানে? আমি আরও এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। তুমি জানো, আমার মামাশ্বশুর আমাকে একটা রুমে আটকিয়ে রেখেছেন।
-উচিত কাজ করেছে। তোর মতো ফাজিল ছেলেদের এভাবেই শিক্ষা দেওয়া উচিত। দাঁড়া, আমি তুলিকে ফোন করে আরও কিছু বুদ্ধি দিচ্ছি।
-বাবা, তুমি কিন্তু একসময় আমার স্বাধীন থাকার পক্ষে মত দিয়েছিলে?
- তা দিয়েছিলাম। কারণ, তখন তুই অবিবাহিত ছিলি। এখন তো তুই বিবাহিত। আমি এখন আমার বউমার পক্ষে। শোন, তুলির মতো এত ভালো মেয়ে তুই আর পাবি না।
-বাবা, তোমাকে ফোন করাটাই আমার ভুল হয়েছে।
বলে ফোন কেটে দিলাম। আমাকে যেভাবে হোক, তুলি আসার আগে এই রুম থেকে বের হতে হবে। তুলি চলে এলে আর পালাতে পারব না। আমি রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে মামাকে বললাম,
-মামা প্লিজ, দরজা খোলেন। আমি বাথরুমে যাব। আমার yes body has come.
-আমি দরজা খুলব না। ব্যাটা ফাজিল, তোর yes body তুই প্যান্টেই কর।
-মামা প্যান্টে কেমনে করব? প্যান্টে তো ওটা হবে না।
-হবে হবে। চেষ্টা Do.
মাইগড, দেখি আমারে নকল করে আমার মতো ইংরেজি বলতেছে। বুঝলাম, এই বুড়া কোনোভাবেই দরজা খুলবে না। আমার এখন রাগ উঠতেছে। আমি রাগের চোটে দরজায় জোরে জোরে দুইবার লাথি মারলাম। তারপর টারজানের মতো দুইবার গলা ফাটিয়ে ওওওওওওওওওও করে আওয়াজ করলাম।
আমার টারজানের ডাক শুনে, বাহির থেকে মামা চিৎকার করে বললেন,
-হারামজাদা, পাগলের গুষ্টি পাগল। চলবে...
বি.দ্রষ্টব্য :
এটি একটি রম্য লেখা। এই গল্পে শিক্ষণীয় কিছুই নেই। আপনি যদি শিক্ষণীয় কিছু খোঁজার জন্য এখানে এসে থাকেন, তাহলে বলব, ‘সরি, এ গল্প আপনার জন্য না।’
*[email protected]