বিয়ে ভীতি-১ম পর্ব
আমি ঠিক করেছি জীবনে কখনো বিয়ে করব না। না, আমার কোনো শারীরিক সমস্যা নেই। আমি আসলে ঠিক করেছি, আমি স্বাধীন জীবন যাপন করব। চাকরি-বাকরি করব না, স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াব। কোনো দায়-দায়িত্ব থাকবে না। যেখানে রাত, সেখানেই কাত। বিষয়টি আমি আমার মা-বাবাকে জানিয়ে দিয়েছি। মা রাগ করলেও বাবা আমাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। উনি আমার চাকরি আর বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত শুনে বলেছেন,
-গুড সিদ্ধান্ত। একটাই তো জীবন, বিয়ে করে সেই জীবনে এত চাপ নেওয়ার কোনো মানে নেই।
কিন্তু সমস্যা বেধেছে তুলিকে নিয়ে। সে আমার চাকরির জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তুলি আমার নামে, বিভিন্ন জায়গায় চাকরির আবেদন করছে, আর আমাকে জোর করে ইন্টারভিউ দিতে পাঠাচ্ছে। কখনো কখনো সে নিজেই আমাকে সঙ্গে করে ইন্টারভিউ দিতে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন আজ সকাল সাতটার দিকে সে হলে এসে হলের মামাকে দিয়ে আমাকে জোর করে ঘুম থেকে উঠিয়ে ইন্টারভিউ দিতে নিয়ে এসেছে। সে বলেছে আমাকে দ্রুত চাকরি পেতে হবে। আর চাকরি পাওয়ামাত্রই সে আমাকে বিয়ে করবে।
তুলি আমার সহপাঠী। আমরা এবার মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছি। লেখাপড়া শেষ হলেও আমি এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছাড়িনি।
তুলির বাবা অনেক বড় ব্যবসায়ী। তুলি অবশ্য আমাকে ওর বাবার অফিসে একটা চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু আমি তুলির সেই প্রস্তাবে রাজি হইনি। আমি ওকে বলেছি, আমি কারও দয়ায় চাকরি পেতে চাই না। আমি নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেতে চাই।
এ কথা শুনে তুলি বেজায় খুশি। আসলে সব মেয়েই চায় তার বয়ফ্রেন্ড বা স্বামী হবে একজন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষ। বোকা মেয়েটা তো আর জানে না, আত্মসম্মানবোধটোধ কিছু না, আমি আসলে বিয়ে করার ভয়েই ওর বাবার অফিসের চাকরির অফারটি গ্রহণ করিনি। আমি এ পর্যন্ত চাকরির জন্য যত পরীক্ষা দিয়েছি, তার সবগুলোতে আমি ইচ্ছা করেই ফেল করেছি। আমি ঠিক করেছি পূর্বের মতো আজকের পরীক্ষাতেও আমাকে ফেল করতে হবে।
ইন্টারভিউ রুমে ঢুকেই দেখলাম, তিনজন বয়স্ক মানুষ বোর্ডে বসে আছেন। আমি তাঁদের অনুমতি না নিয়েই চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। অনুমতি না নিয়ে চেয়ারে বসার কারণে কি না জানি না, চেয়ারে বসতেই তিনজন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। আমিও তাঁদের দিকে চোখের পলক না ফেলে, বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলাম। প্রায় মিনিট খানেক চলল আমাদের এ দৃষ্টি বিনিময়। অনেকক্ষণ বসে থেকেও যখন দেখলাম ইন্টারভিউ বোর্ডের কেউ কোনো কথা বলছেন না, তখন আমিই বললাম,
-আচ্ছা আপনারা কি শুধু আমার চেহারা দেখেই নিয়োগ দেবেন, নাকি কোনো প্রশ্ন করবেন?
-আপনার কী ধারণা?
মাঝের জন প্রশ্ন করলেন।
-আমার ধারণা কোনো বিষয় না। আপনারা প্রশ্ন করলে করেন, না হলে আমি চললাম। আমার হাতে সময় খুবই কম।
-কেন, আপনি কি খুব ব্যস্ত মানুষ?
-অবশ্যই। আমি একজন বিশিষ্ট গবেষক।
-বলেন কী! আপনি গবেষক!
-জি। আমি মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করছি।
-মহাকাশ নিয়ে! কিন্তু বায়োডাটাতে তো দেখলাম, আপনি বাংলা সাহিত্যে পড়ালেখা করেছেন।
-এটা কোনো সমস্যা না। গবেষণার জন্য আসলে পড়ালেখা না, একটা মাথা দরকার।
-তাই! পড়ালেখার কোনো দরকার নেই, মাথা হলেই হলো? তা আপনি মহাকাশের কী নিয়ে গবেষণা করছেন? আর সেই গবেষণা থেকে আপনার নোবেল পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
বুঝলাম টিঁটকারি করছে। তার মানে আমি সঠিক লাইনেই এগোচ্ছি। এরা অলরেডি আমাকে মাথা মোটা ভাবতে শুরু করেছে। আমি গলার স্বরটা একটু ভারী করে বললাম,
-আমি আসলে চাঁদ নিয়ে গবেষণা করছি। আমি গবেষণা করে আবিষ্কার করলাম, মানুষ আসলে চাঁদে যায়নি।
-বলেন কী, মানুষ চাঁদে যাননি! তাহলে তাঁরা কোথায় গিয়েছিলেন?
-কোথায় গিয়েছিলেন সেটা নিয়ে আমি গবেষণা করছি না। উনারা যে চাঁদে যাননি, সেটা নিয়ে আমি গবেষণা করছি।
-আচ্ছা কী কারণে আপনার মনে হলো যে মানুষ চাঁদে যাননি।
-বিষয়টি খুবই সহজ। আমি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলছি। ধরুন, একটা মানুষ জীবনে কখনো ঢাকা শহরে আসেনি। আপনি তাকে চোখ বেঁধে ঢাকা শহরে নিয়ে এলেন। এরপর তার চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে তাকে প্রশ্ন করুন, তিনি এখন কোথায়? দেখবেন সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে দেবে, সে এখন ঢাকা শহরে। বলেন তো কীভাবে বলবে?
-আপনিই বলেন কীভাবে?
-সাইনবোর্ড দেখে। কারণ, ঢাকা শহরের প্রায় সব সাইনবোর্ডেই ‘ঢাকা’ কথাটি লেখা আছে। কিন্তু মানুষ যেটাকে চাঁদ বলছে, সেখানে কোনো সাইনবোর্ড ছিল না। তাহলে উনারা কীভাবে বুঝলেন যে ওটা চাঁদ। এটলিস্ট একটা সাইনবোর্ড তো থাকা উচিত ছিল।
দেখলাম তিনজনই ভ্রু কুঁচকে অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তাঁদের তাকিয়ে থাকা দেখে প্রশ্ন করলাম,
-আপনারা এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
ডানের জন বললেন,
-আসলে এই প্রথম আমরা একজন বিশাল জ্ঞানী মানুষকে সামনাসামনি দেখছি। এ ধরনের জিনিস দেখার সৌভাগ্য তো আর সব সময় পাওয়া যায় না। তা আপনি কি শুধু মহাকাশ নিয়েই গবেষণা করছেন, নাকি অন্য আরও কিছু নিয়ে গবেষণা করছেন?
-না না, শুধু মহাকাশ না, অনেক কিছু নিয়েই গবেষণা করছি। আমি আসলে মশা থেকে মহাকাশ, সবকিছু নিয়েই গবেষণা করি।
-ভেরি গুড। আচ্ছা তার মধ্য থেকে কি আরও দুই-একটা আমাদের বলা যাবে?
-অবশ্যই যাবে। আমার আরেকটি প্রধান গবেষণার বিষয় হচ্ছে, ইংরেজি ভাষা। আমি ইংরেজি ভাষাকে সহজ করার চেষ্টা করছি। যাতে সাধারণ মানুষও সহজেই ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারে এবং বুঝতে পারে।
-তাই নাকি! সেটা কী রকম?
-কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন। আচ্ছা বলুন তো, ‘আমি তোমাকে চিনি’ এর ইংরেজি কী হবে?
-I know you.
-ঠিক বলেছেন। কিন্তু এটাকে এভাবে না বলেও সহজে অন্যভাবেও বলা যায়। যেমন, ‘I sugar you.’
-তারপর?
-আচ্ছা বলেন তো My, Yes body has come. এর অর্থ কী?
তিনজনই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বাঁয়ের জন টিঁটকারির সুরে বললেন,
-স্যার আপনিই বলেন।
-My মানে আমার, Yes মানে হ্যাঁ, body মানে গা, has come মানে আসিয়াছে। তার মানে এর অর্থ হচ্ছে, ‘আমার হাগা আসিয়াছে।’
দেখলাম এবার তিনজনই রাগী রাগী চেহারা নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি উনাদের রাগী চেহারাকে উপেক্ষা করে বললাম,
-দাঁড়ান, আর একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
এ কথা বলামাত্রই মাঝের জন বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তারপর চিৎকার করে বললেন,
-খবরদার, তুই আর একটা ইংরেজিও বলবি না। এ অফিসের ভেতর তুই যতক্ষণ থাকবি, ততক্ষণ তোর জন্য ইংরেজি বলা হারাম। ব্যাটা ফাজিল, তুই কি মানুষের মাথা খারাপ করার জন্য এই দুনিয়ায় আসছিস?
এতটুকু বলে উনি আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। আমাকে তুই করে বলায় আমি মনে মনে খুশিই হলাম। কারণ, আমি উনাদের রাগিয়ে দিতে পেরেছি। দেখলাম ভদ্রলোক চেয়ারে বসেও রাগে কাঁপছেন। একটু পর উনি ডান পাশের জনকে ইশারা দিয়ে আমাকে প্রশ্ন করতে বললেন। ডান পাশের জন শান্ত কণ্ঠে বললেন,
-আচ্ছা বলেন তো, ১৯৯০ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার কে পেয়েছিলেন?
-একজন রসায়নবিদ।
-রসায়নের নোবেল তো রসায়নবিদই পাবেন, তাই না ? আপনি তাঁর নাম বলুন।
-আচ্ছা আপনি কী বলতে পারবেন, ২০০০ সালে অর্থনীতিতে কে নোবেল পেয়েছেন? আপনি যদি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন, তাহলে আমিও আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব।
-দেখুন, চাকরির ইন্টারভিউ তো আপনি দিচ্ছেন, আমি না। আমি আপনার পরীক্ষক।
-সেটা ঠিক আছে। কিন্তু পরীক্ষক যদি সব প্রশ্নের উত্তর না জানেন, তাহলে পরীক্ষার্থীর কাছে কেন তা আশা করবেন? আর তা ছাড়া আপনাদের এ চাকরির জন্য এই প্রশ্নের উত্তর জানাটা কি জরুরি?
-এভাবে উল্টোপাল্টা কথা না বলে সরাসরি বললেই তো পারেন যে আপনি উত্তর জানেন না। আমরা বুঝতে পারছি আপনার বইপুস্তকের জ্ঞান অনেক কম। ঠিক আছে, আপনাকে আমরা আর বইপুস্তকের কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব না। এখন আমরা পড়ালেখার বাইরের জিনিস নিয়ে আলোচনা করব। আচ্ছা, আপনার হবি কী?
-নারীর সঙ্গে মেলামেশা।
-ছি ছি আপনি এটা কী বললেন!
-যা সত্য আমি তাই বলেছি। আর বুঝলাম না, আপনি ছি ছি করছেন কেন? এটা খুবই স্বাভাবিক একটা জিনিস। আমরা সবাই…।
-থাক, আপনাকে আর ব্যাখ্যা করতে হবে না।
এবার বাঁয়ের জন প্রশ্ন করলেন,
-আচ্ছা, আপনার জীবনের স্মরণীয় একটা ঘটনা বলুন। যেটার মধ্যে শিক্ষণীয় কিছু আছে।
-আমি যখন কলেজ পড়ি, সেই সময় ক্লাস নাইনের একটা মেয়ে, আমাকে একটা প্রেমের চিঠি দিয়েছিল। আমি সারা রাত কষ্ট করে সেই চিঠির রোমান্টিক একটা উত্তর লিখেছিলাম। তারপর মেয়েটির লেখা চিঠি এবং আমার লেখা উত্তর, দুটো একসঙ্গে খামে ভরে মেয়েটির মায়ের হাতে দিয়েছিলাম। এরপর থেকে ওই মেয়ে আমাকে দেখলেই ডাকত, হারামজাদা।
-এটা আপনার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা! আর এর মধ্যে শিক্ষণীয় কী আছে তা তো বুঝলাম না?
-বলেন কী, এই ঘটনার মধ্যে অনেক বড় শিক্ষণীয় একটা বিষয় আছে। আর সেটা হলো, প্রেমের চিঠি কখনোই মেয়ের মায়ের হাতে দেওয়া ঠিক না।
এবার ডানের জন গম্ভীর গলায় বললেন,
-আপনার জীবনের লক্ষ্য কী? মানে আগামী পাঁচ বা দশ বছর পর আপনি নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
- আমার জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই। আমি ঠিক করেছি আমি জঙ্গলে চলে যাব। কারণ, ছোটবেলা থেকে আমার টারজান হওয়ার খুব শখ। আমি অলরেডি দর্জির কাছ থেকে টারজানের মতো একটি জাঙ্গিয়া বানিয়ে নিয়েছি। টকটকে লাল রঙের। আমি সেটা আজ পরেও এসেছি। কারণ, আপনাদের এখান থেকে বের হয়ে, আমি সোজা বান্দরবানের জঙ্গলে চলে যাব।
-আপনি যদি জঙ্গলেই যাবেন, তাহলে আজ এখানে এসেছেন কেন?
-আমি এখানে নিজের ইচ্ছায় আসিনি। আমার গার্লফ্রেন্ড আমাকে জোর করে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে।
এবার মাঝের জন গম্ভীর গলায় বললেন,
-সেই শুরু থেকে দেখছি আপনি আমাদের সঙ্গে ফাজলামি করছেন। কারণটা কী জানতে পারি?
ভদ্রলোক সম্ভবত আবার রেগে যাবেন। বলা যায় না, আবার হয়তো তুই–তুকারি করতে পারেন। কারণ, উনার চোখে-মুখে সেই ধরনের একটা আভা ফুটে উঠেছে। আমি নরম সুরে বললাম,
- আসলে আমি চাচ্ছি না, আমার চাকরিটা হোক। কারণ, আমার গার্লফ্রেন্ড বলেছে, চাকরি পেলেই সে আমাকে বিয়ে করবে। অথচ আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি না।
-কেন? কেন আপনি বিয়ে করতে চাচ্ছেন না?
-সংসারের চাপ খুবই কঠিন চাপ। আমি ওই চাপ নিতে পারব না। আমি চাই স্বাধীন জীবন।
-সংসারের চাপ কঠিন? কে বলল আপনাকে?
-কারও বলার দরকার নেই। বিবাহিত লোকের চেহারা দেখলেই এটা বোঝা যায়। এ যেমন আপনাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, আপনারা তিনজনই খুব চাপের মধ্যে আছেন। আপনারা আসলে কেউ সুখে নেই। শোনেন, আপনারা চাইলে আমি আপনাদের এ চাপ থেকে বের হয়ে আসার একটি উপায় বাতলে দিতে পারি।
-তাই নাকি! বলেন শুনি, কীভাবে আমরা আমাদের বৈবাহিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে পারি।
-খুবই সোজা। আপনারা গৃহ ত্যাগ পদ্ধতি ব্যবহার করুন। আপনারা চাইলে আমি সাহায্য করতে পারি।
-বুঝিনি। খুলে বলুন।
-এক কাজ করুন, আপনারা তিনজন আমার সঙ্গে বান্দরবান চলুন। এখান থেকে বের হয়ে প্রথমে আমরা নিউমার্কেট যাব। ওখানে লাল কাপড় কিনে আপনাদের জন্য তিনটি জাঙ্গিয়া বানাব। তারপর আমরা বান্দরবান চলে যাব। বান্দরবানের জঙ্গলে গিয়ে আমরা শরীর থেকে সব পোশাক খুলে ফেলব। আমাদের শরীরে থাকবে শুধু লাল জাঙ্গিয়া। এরপর আমরা গাছের ওপর উঠব। তারপর গাছের ডালে ডালে ঝুলব, আর মুখ দিয়ে টারজানের মতো ওহোওওওওও, ওহোওওওওও করে আওয়াজ করব। দেখবেন ওখানে যাওয়ার পর থেকে আপনাদের চেহারায় আর কোনো চাপের ছাপ থাকবে না। আপনারা আবার আগের মতো সুখী হয়ে যাবেন।
খেয়াল করে দেখলাম, তিনজনই হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু পর মাঝের জন কাউকে ফোন করে বললেন,
-মা, একটু এই রুমে আয় তো।
কিছুক্ষণ পর আমাকে অবাক করে দিয়ে তুলি ইন্টারভিউ রুমে ঢুকল। তারপর আমার পাশের চেয়ারে এসে বসল। মাঝের জন তুলির দিকে তাকিয়ে বললেন,
-মা, এই তুই কারে নিয়ে আসলি। এর মাথায় তো সমস্যা আছে। এরে চাকরি দিলে তো ও আমার অফিসের সবার মাথা খারাপ করে দেবে। ও ঠিক করেছে, ও নাকি লাল জাঙ্গিয়া পরে টারজান হয়ে জঙ্গলে চলে যাবে। আমাদেরও বুদ্ধি দিয়েছে ওর সঙ্গে যেতে। ও বলেছে, ও সহ আমরা তিনজন শুধু লাল জাঙ্গিয়া পরে গাছের ডালে ঝুলব আর টারজানের মতো মুখ দিয়ে ওহোওওওওও, ওহোওওওওও আওয়াজ করব। তুই শুধু কল্পনা কর, আমরা তিনজন বয়স্ক মানুষ গাছের ডালে ডালে ঝুলছি, আর মুখ দিয়ে ওহো, ওহো আওয়াজ করছি। কী ভয়ংকর দৃশ্য! কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে কি এমন পরিকল্পনা করা সম্ভব!
এবার ডানের জন বললেন,
-শুধু তা–ই না, এই ছেলের তো ক্যারেক্টারেও সমস্যা আছে। উনি বলেছেন উনার হবি নাকি নারীর সঙ্গে মেলামেশা।
তুলি ঘাড় ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর নরমভাবে বলল,
-যা, তুই বাইরে গিয়ে অপেক্ষা কর। আমি আসছি।
আমি বাইরে চলে এলাম। মিনিট দশেক পর তুলি রুম থেকে বেরিয়ে এল। তারপর আমি ও তুলি অফিস থেকে বের হয়ে এলাম। ফুটপাত ধরে তুলির পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললাম,
-তুলি শোন, আসলে কি জানিস, এরা ওদের লোক আগেই নিয়ে রেখেছে। এসব ইন্টারভিউ, লোক দেখানো ইন্টারভিউ।
তুলি আমার দিকে না তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শান্ত স্বরে বলল,
-শোন, আমারে উল্টোপাল্টা বুঝ দিবি না। তুই কি জানিস, এটা আমার মামার অফিস? ওই মাঝের জন আমার মামা।
-তাই নাকি? তাই তো বলি, ওই বুইড়া আমারে তুই–তুকারি করে কেন?
-বেয়াদবের মতো কথা বলবি না। ভেবেছিলাম তোকে না জানিয়ে মামার অফিসে তোকে একটা চাকরি দেব। অনেক বড় মুখ করে মামার কাছে তোর কথা বলেছিলাম। আর তুই কী করলি? উল্টোপাল্টা কথা বলে আমাকে ছোট করলি।
-আরে না, আমি উল্টোপাল্টা কিছুই করিনি।
-শোন, তুই ভেতরে যা যা করেছিস, মামা তার সবই আমাকে বলেছে। আচ্ছা, তুই মামাকে কীভাবে বললি, লাল জাঙ্গিয়া পরে উলঙ্গ অবস্থায় তোর সঙ্গে বান্দরবান যেতে?
-আরে ওটা তো ফান করে বলেছি।
-শোন, বাবার বয়সী তিনজন মানুষের সঙ্গে এমন বেয়াদবি করাকে ফান বলে না। আচ্ছা, আরেকটা কথা, আজ পর্যন্ত তুই ঠিকমতো আমার হাতটিও ধরলি না, অথচ মামার সামনে তুই বললি, তোর হবি নারীর সঙ্গে মেলামেশা। এ কথার অর্থ কী তুই জানিস? এই কথা বলে তুই মামাকে বুঝিয়ে দিলি, তুই আমার সঙ্গে এসব করিস, তাই না? ছি।
আমি কোনো কথা না বলে তুলির পাশে চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম। আসলে বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। এতটা না করলেও পারতাম। একটু পর তুলি হঠাৎ করে শক্তভাবে আমার হাত ধরল। তারপর বলল,
-শোন, এখন আমরা একটা হোটেলে যাব। তারপর একটা রুম ভাড়া করব।
-কেন!
-কেন মানে? আজ আমরা মেলামেশা করব। তুই না বলেছিস তোর হবি। এখন থেকে আমার হবি ওটা।
-যা, এসব কী ফালতু মজা করছিস? এসব কথা মুখে আনাও পাপ।
-শোন, আমি মোটেও মজা করছি না। আমি সিরিয়াস। হোটেলে গিয়ে দেখব লাল জাঙ্গিয়ায় তোকে টারজানের মতো লাগে কি না?
-লা হাওলা ওয়ালা কুওআতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম।
উচ্চস্বরে এই দোয়া পড়তে পড়তেই আমি ওর হাত থেকে আমার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। কারণ, তুলি খুব শক্ত করে আমার হাত ধরে রেখেছে। আমি ভয় পেয়ে ঢোঁক গিললাম। কারণ, এ মেয়েকে আমি ভালো করেই চিনি। এ মেয়ের মাথায় সিট আছে। আমি ভয় পেয়ে মনে মনে বললাম,
-হে আল্লাহ, তুমি আমাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করো। আজ তোমার এ বান্দার মানসম্মান-ইজ্জত-সতীত্ব সব তোমার হাতে।
তুলি হাত তুলে একটা রিকশা থামাল। থামতেই রিকশাওয়ালা মামাকে বলল,
-মামা আশপাশে আপনার পরিচিত কোনো আবাসিক হোটেল আছে? চলবে...
বি. দ্রষ্টব্য
এটি একটি রম্য লেখা। এ গল্পে শিক্ষণীয় কিছুই নেই। আপনি যদি শিক্ষণীয় কিছু খোঁজার জন্য এখানে এসে থাকেন, তাহলে বলব, ‘সরি, এ গল্প আপনার জন্য না।’