বিপদে আছি-৪র্থ পর্ব
আমি মিরপুর থানার একটি রুমে বসে আছি। একটু আগে পুলিশ আমাকে জোর করে বাসা থেকে ধরে এনেছে। কারণ, শাশুড়ি আমার নামে গুম-খুনের মামলা করেছেন। সাব-ইন্সপেক্টর রহমান সাহেব টেবিলের বিপরীত দিকের একটি চেয়ারে বসে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি পাশে দাঁড়ানো কনস্টেবল আবুল সাহেবকে ইশারা করলেন। আবুল সাহেব দুবার খুকখুক করে কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর মোটা গলায় প্রশ্ন করলেন,
-লাশ কোথায় লুকাইছেন বলেন? আমাদের লাশ লাগবে।
-আপনাদের লাশ লাগবে, তা আমি কী করব? আমার কাছে লাশ নাই।
-তার মানে তুই তোর বউরে খুন কইরা কবরও দিয়া ফেলছিস?
-এটা কী বললেন? আমার বিয়ে হয়েছে মাত্র তিন দিন। এখনো ঠিকমতো মনভরে ঝগড়াটাও করতে পারলাম না। তার আগেই খুন করে ফেলব? আমি কি বোকা?
-তুই কি বিয়া করছোস ঝগড়া করার জন্য?
-জি ভাই। আমার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন, বিয়া করে বউয়ের সঙ্গে টক-ঝাল-মিষ্টি ঝগড়া করব।
এবার সাব-ইন্সপেক্টর রহমান সাহেব মুখ খুললেন,
-আচ্ছা, গতকাল আপনি আপনার শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলেন?
-জি।
-কেন গিয়েছিলেন?
-বেড়াতে গিয়েছিলাম।
-শোনেন, আমরা আপনার শাশুড়ির কাছ থেকে সব শুনেছি। অতএব কিছু লুকাবেন না। আপনার শাশুড়ি বললেন, আপনি নাকি আপনার বউয়ের বিরুদ্ধে বিচার দিতে গিয়েছিলেন?
-জি।
আমি ‘জি’ বলামাত্রই কনস্টেবল আবুল সাহেব দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন,
-তার মানে ঘটনা সত্য। স্যার, এই হারামজাদাই খুন করছে। শালায় কত্ত খারাপ। তিন দিনের বউয়ের বিরুদ্ধে বিচার নিয়া শ্বশুরবাড়ি যায়।
-আবুল ভাই, আপনি গালি দেন ক্যান? আর আপনি আমারে ‘তুই’ করে কেন বলছেন? আপনার স্যারকে দেখে কিছু শেখেন। দেখেন উনি কীভাবে ‘আপনি’ করে সম্বোধন করে কথা বলছেন।
-স্যার ভালো মানুষ, তাই তোরে ‘আপনি’ করে বলছেন। আমি অত ভালো না, তাই ‘তুই’ করে বলছি। আর আমি গালি দিতেছি বলে কি তোর মন খারাপ হইছে? গালির দেখছোস কী? ভালোয় ভালোয় সব স্বীকার কর। না হলে তোরে আজ সেই রকম ধোলাই করব।
-ধোলাই করবেন মানে!
-ধোলাই বোঝো না চান্দু? ওই দিকে তাকায়ে দেখ।
বাঁ পাশে তাকিয়ে দেখলাম দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা একটা বিশাল মোটা লাঠি। লাঠিটাতে সম্ভবত তেল মাখানো হয়েছে, যার কারণে চিকচিক করছে। আমি ভয় পেয়ে ঢোঁক গিলে বললাম,
-আপনারা কি সত্যি সত্যিই আমারে মারবেন?
-অবশ্যই মারব। পুলিশ তোরে থানায় ধরে আনবে, আর তোরে মারবে না, এটা তুই ভাবলি কী করে? তোরে আজ আমি পিটাইতে পিটাইতে হাগিয়ে ছাড়ব।
-বলেন কী? আপনারা কি আমাকে না হাগা পর্যন্ত মারবেন? আচ্ছা আবুল ভাই, ধরেন, আমি যদি মারার আগে হেগে দিই, তাহলে কি মাইর থেকে রক্ষা পাব?
সাব-ইন্সপেক্টর রহমান সাহেব আমার কথা শুনে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। ওদিকে আবুল সাহেব আমার প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেছেন। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন,
-স্যার, এ হারামজাদা কত ত্যাঁদড় দেখছেন? হারামজাদা বলতেছে, মারার আগেই নাকি সে হেগে দেবে।
এরপর আবুল সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে চোখ কটমট করে বললেন,
-তুই মারার আগে হাগবি মানে? তুই কি পুলিশের সঙ্গে মশকরা করিস?
-ভাই, আমি তো মশকরা করিনি। আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছিমাত্র। আমার তো জানা দরকার, আমাকে কেন মারবেন? কতক্ষণ মারবেন? আমি আসলে আপনার কথায় কনফিউজড। আপনারা আমারে হাগানোর জন্য মারবেন, নাকি খুন স্বীকার করার জন্য মারবেন? সেটা বোঝার চেষ্টা করছি। আবুল ভাই, আমার সাফ কথা, হাগতে বললে হাগব, কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু ভাই, আমি খুন করছি, সে কথা স্বীকার করব না। যত মারাই মারেন।
-কেন করবি না?
-কারণ আমি কোনো খুন করিনি। আচ্ছা আবুল ভাই, আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি খুনি?
-অবশ্যই মনে হয়। তোর চেহারা দেখলেই বোঝা যায় তুই খুনি। শুধু খুনি না, তোর চেহারায় একজন ছিনতাইকারী ও ধর্ষকের ছাপও আছে। শুধু তা-ই না, তোরে দেখলে কেমন জানি চোর চোর মনে হয়।
-বলেন কী? আমার চেহারা চোরের চেহারা!
-কেন, তোরে কেউ বলেনি?
এবার রহমান সাহেব হাত তুলে আবুল সাহেবকে থামিয়ে দিলেন। তারপর আমাকে প্রশ্ন করলেন,
-ঠিক আছে মানলাম, আপনি খুন করেননি, গুম করেননি। তাহলে আপনার স্ত্রী এখন কোথায়?
-স্যার, সেটা তো আমি জানি না।
-আপনি আপনার স্ত্রীকে সঙ্গে করে মার্কেটে নিয়ে গেলেন। আর আপনি বলছেন আপনি জানেন না, উনি কোথায়। শোনেন, বাংলাদেশে ইদানীং স্বামীর হাতে প্রচুর স্ত্রী খুন হচ্ছে।
-স্যার, আমাদের দেশে স্বামীদের হাতে অনেক স্ত্রী নির্যাতনের শিকার হয়, খুন হয়, সেটা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু তাই বলে সব স্বামীই খারাপ, আর সব স্বামীই খুনি, তা কিন্তু নয়। আমাদের দেশের বেশির ভাগ স্বামীই কিন্তু স্ত্রীকে বিপদ থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করে।
-ধরে নিলাম আপনি অপরাধী নন। আর আপনি কিছু জানেন না। আমার প্রশ্ন, আপনি যদি অপরাধী না হয়ে থাকেন, তাহলে যখন আমরা আপনার বাসায় গেলাম, তখন আপনি আমাদের দেখে দৌড় দিলেন কেন?
-ভয়ে। স্যার আমি এই দুনিয়ায় একটা জিনিসই ভয় পাই। সেটা হচ্ছে পুলিশ।
-কেন?
-কারণ স্যার, এরা মাইরের সিস্টেম জানে না। ফ্রি স্টাইলে উড়াধুরা মারে। কোথায় মারলে কী হবে, কোনো জ্ঞান নাই। খালি মারে। মারতে হবে তাই মারে।
রহমান হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর নরম সুরে বললেন,
-যান আপনারে মারব না। আপনি সব স্বীকার করেন। তাহলেই হবে।
-সেটা তো আমি কখনোই করব না।
-ঠিক আছে আপনি যেটা ভালো মনে করেন, সেটাই করেন। আমি এখন চলে যাচ্ছি। আবুল সাহেব আপনি শুরু করেন। হাগান, মুতান আমার কোনো আপত্তি নাই। আমি স্বীকার উক্তি চাই।
এ কথা বলে রহমান সাহেব চলে গেলেন। আবুল সাহেবও পিছে পিছে চলে গেলেন। একটু পর উনি এক বাটি তেল নিয়ে এলেন। তারপর লাঠিটি আমার হাতে দিয়ে বললেন,
-আগামী ১০ মিনিট এটাতে ভালো করে তেল লাগা। তারপর খেলা শুরু হবে।
-আবুল ভাই, এটাতে যথেষ্ট তেল লাগান আছে। আবার কেন লাগাবেন?
-ওটা যখন তোর ওপর চালাব, তখন টের পাবি তেল দেওয়া লাঠির সুবিধা কী? শোন, তেল বেশি থাকলে তোরই সুবিধা হবে। কষ্ট কম পাবি।
বলেই হো হো হো করে হাসতে লাগলেন। ওনার হাসি দেখে আমার মাথা ঘুরে উঠল। কারণ আমি এখন বুঝতে পারছি, উনি কীভাবে মারতে মারতে হাগাবেন। ছোটবেলায় মাকে দেখতাম, আমার ছোট ভাইয়ের কয়েক দিন হাগু না হলে মা হাগু করানোর জন্য পানের বোঁটায় তেল লাগিয়ে দিতেন। আর ছোট ভাই সঙ্গে সঙ্গে হাগু করে দিত। আমার তো মনে হচ্ছে আবুল সাহেবও আমার ওপর সেই থিওরি খাটাবেন। যদিও পদ্ধতিটা ভালো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, কোথায় পানের বোঁটা, আর কোথায় এই মোটা লাঠি। এরা তো আমারে মেরেই ফেলবে। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
-আবুল ভাই, আমার টয়লেট নিয়ে কোনো সমস্যা নাই। আপনার কষ্ট করে আমাকে হাগাতে হবে না। আর তা ছাড়া এসব পচা কাজ, আপনি কেন করবেন? আপনি একজন সম্মানিত পুলিশ। আবুল ভাই, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?
-কর।
-আপনি কখনো টিভি বা সিনেমায় অভিনয়ের জন্য চেষ্টা করেছেন?
-না, কেন?
-না ভাই, আপনার চেহারা মাশা আল্লাহ অনেক সুন্দর। আপনার অভিনয়ে নামা উচিত। আপনার চেহারার ভেতর অনেকগুলো নায়কের ছায়া আমি খুঁজে পাচ্ছি।
-তাই নাকি? কেডা কেডা?
-আপনি হাসলে মনে হচ্ছে শাহরুখ খান, আপনার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা পুরাই অমিতাভের মতন। আর আপনার চুলগুলো…
-শোন, তোরে একটা পরামর্শ দিই। তুই আমারে পাম দিস না। আমারে পাম দিয়া কোনো লাভ হবে না। আমার সামনের একটা দাঁত নাই। অথচ তুই কইলি আমি হাসলে আমারে মনে হয় শাহরুখ খান। আমি খাটো একটা মানুষ। আরেকটু হইলে পুলিশে আমার চাকরিই হইত না, আর তুই আমারে কইতাছোস আমি দাঁড়ালেই মনে হয় আমি অমিতাভ। আমার মাথায় বিশাল টাক। আমি জানি তুই এখন বলবি, আমার চুল দেখলে তোর মনে হয় ‘তেরে নাম’ সিনেমার সালমান খান? তাই না?
-না মানে...
-শোন, পাম দিতে হবে না। তোরে আমার পছন্দ হইছে। আমি স্যারকে বলে তোর জন্য কিছু করার চেষ্টা করমু। তুই শুধু স্বীকার কর তোর বউ কই। হয় বউরে বাহির কর। না হয় লাশ দিয়া দে। তুই যে শুকনা মানুষ, ওই লাঠির বাড়ি তোর সহ্য হইবে না। তোরে আমি আরও ১০ মিনিট সময় দিলাম। ১০ মিনিট পর তোরে আমি আর কিছুই জিগামু না। তখন শুধু লাঠি চলবে।
আবুল সাহেবের বলার ধারণটা এমন ছিল যে আমি এবার আসলেই ভয় পেয়ে গেলাম। এখন আর মনে হচ্ছে না, উনি আমার সঙ্গে ফান করছেন। আর মাত্র ১০ মিনিট। যা করার এর মধ্যেই করতে হবে। বুঝতে পারছি না, আমি কী করব? পুলিশের টর্চার সহ্য করব? নাকি পুলিশের কাছে নিপার সবকিছু খুলে বলব, যা আমি কাউকে বলিনি। চলবে...
বি. দ্র.: এটি একটি রম্য লেখা। এ গল্পে শিক্ষণীয় কিছুই নেই। সে জন্য সরি। অবশ্য সবকিছু থেকেই শিখতে হবে, এর তো কোনো মানে নেই, তাই না?
*লেখক: ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]