বিপদে আছি-৩য় পর্ব

শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে বাসায় এসে দেখলাম নিপা রুমের দরজা লাগিয়ে ঘুমাচ্ছে। যার কারণে আমি আর রুমে ঢুকতে পারলাম না। বাধ্য হয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলাম। একটু পর আমার বড় বোন এসে আমাকে তাঁর রুমে ডেকে নিয়ে গেলেন। রুমে গিয়ে বসতেই আপা বললেন,
-তুই কি বুঝতে পারছিস, তোর বউ এ বাসায় আসার পর থেকে একের পর এক বিড়াল মারতেছে।

-ও মাই গড, বলো কী? এ কথা তো আমি জানি না। আর বাসার কেউ তো আমাকে কিছু বলেনি। তুমিই এই প্রথম বললে। তা আপা, এ পর্যন্ত সে কয়টা বিড়াল মারছে?
-বিড়াল মারা বলতে আমি কী বুঝিয়েছি, সেটা কি তুই বুঝতে পারছিস?

-অবশ্যই পারছি। আমি তো আর অশিক্ষিত না। কিন্তু আপা, আমি বুঝলাম না, নতুন বউ বাসায় সবার সামনে একের পর এক বিড়াল মারতেছে অথচ কেউ তাকে বাধা দিল না! আপা, অ্যাটলিস্ট তুমি তো তারে বাধা দিতে পারতে। তুমি একজন সিনিয়র মানুষ। আমি তোমার কাছে আরও দায়িত্বশীল আচরণ আশা করেছিলাম।

আমাদের দেশের মেয়েদের চাওয়া কিন্তু খুব বেশি না। তারা কিন্তু পুরো গ্রাম, দেশ বা পুরো দুনিয়াকে দখলে নিতে চায় না। তারা শুধু চায়, তার নিজের সংসারটা নিজের দখলে রাখতে। এই ছোট্ট সংসারটাই তার কাছে বিরাট এক রাজ্য। সে চায় তার এ রাজ্যটি তার মন মতো চলবে। স্বামী হিসেবে একটা পুরুষ কি এইটুকু ছাড় তার স্ত্রীকে দিতে পারে না?

আপা আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। আমি আবার বলা শুরু করলাম,
-আপা শোনো, বিড়ালের মতন নিরীহ প্রাণীকে যে মারতে পারে, তার পক্ষে মানুষ মারাও সম্ভব। আমাদের বোধ হয় র‌্যাবে খবর দেওয়া উচিত। অ্যাটলিস্ট থানায় গিয়ে একটা জিডি করা উচিত। তুমি কী বলো? তুমি যেহেতু সিনিয়র মানুষ, তাই তোমার পরামর্শ দরকার।

আপা এবারও কোনো উত্তর দিলেন না। উনি আমার দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

-আপা, এই মাত্র একটা প্রশ্ন মাথায় এল। আমাদের বাসায় তো কোনো বিড়াল নেই। তাহলে ও বিড়াল মারছে কোথা থেকে? ও মাই গড, আপা তুমি কি বলতে চাইছ নিপা আমাদের বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে গিয়ে গিয়ে বিড়াল মারতেছে? হে আল্লাহ, সবাই তো এখন আমার বউরে খুনি বলবে। আর আমাকে বলবে খুনির স্বামী।

-ভাই রে, আমার ভুল হয়ে গেছে। তোরে আমার রুমে ডেকে আনা উচিত হয়নি। আমি ভুল করছি। আমারে মাফ করে দে। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, তোরে কিছু জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না।

-না না, তুমি ঠিকই করেছ। তোমার ছোট ভাইয়ের বউ বিড়াল মারবে, আর তুমি চুপ করে বসে থাকবে, এটা কোনো কথা? শত হলেও তুমি একজন সিনিয়র মানুষ।
-ভাই রে, থাক। আমি আসলে মিথ্যা বলছি। তোর বউ কোনো বিড়াল-টিড়াল মারেনি। তুই আমারে এভাবে বারবার সিনিয়র বলে আর অপমান করিস না।

-ও, তাহলে নিপা বিড়াল মারেনি? তুমি মজা করেছ?
-হ্যাঁ, মজা করেছি।

-যাক, নিশ্চিন্ত হলাম। আমার বউ তাহলে খুনি নয়।
-ভাই, যদি ফান না করিস, তাহলে তোকে একটা সিরিয়াস বুদ্ধি দিতে পারি। দেব?
-অবশ্যই দেবে। তুমি আমার একমাত্র সিনিয়র বোন।

-শোন, বউ এখন নতুন। এখনই বউকে টাইট দেওয়ার উপযুক্ত সময়। তাই বলছি, বউ নতুন থাকতে থাকতে তারে একটু টাইট দে। পরে কিন্তু আর টাইট দিতে পারবি না।
-আপা, তুমি যখন বলছ, অবশ্যই টাইট দিয়ে দেব। সেটা কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো নিপার মাথায় অনেক চুল। যার কারণে স্ক্রুটা মাথার ঠিক কোন পজিশনে আছে, সেটা খুঁজে বের করা আমার পক্ষে একটু কঠিন হবে। আচ্ছা আপা, মাথার ঠিক কোন পজিশনে স্ক্রু থাকে, বলতে পারবে? এক কাজ করো তোমারটা আমাকে দেখায়ে দাও। তাহলে আমি নিপারটা ঠিকই খুঁজে বের করে ফেলতে পারব।

দেখলাম, আপা আমার কথা শুনে দুই ভুরু কুঁচকে রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

-আপা, তুমি রাগী চোখে তাকাচ্ছ কেন? স্ক্রু খুঁজতে সাহায্য করতে পারবে না, সেটা বললেই তো হয়। ঠিক আছে তোমাকে সাহায্য করতে হবে না। আমি নিজেই খুঁজে বের করে নেব। দরকার হলে নিপাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তারপর খুঁজে বের করব।

আপা এখন হাঁ করে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি এবার ফিসফিস করে বললাম,
-আপা, সমস্যা তো আরও আছে। নিপার মাথায় স্ক্রু কোথায় আছে, সেটা নাহয় খুঁজে বের করলাম, কিন্তু টাইট দেব কীভাবে? বাসায় তো স্ক্রু ড্রাইভার, প্লাস কিছুই নেই। এক কাজ করি, একটা স্ক্রু ড্রাইভার কিনে আনি, কী বলো?

-ভাই রে, আমি আবারও ভুল করেছি। তোর বউকে টাইট দেওয়ার কথা বলা আমার একদম উচিত হয়নি। তুই আমারে ক্ষমা কর। তবু এত উল্টাপাল্টা কথা বলিস না।
-আপা, তুমি কি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছ?

-না, আমি তোর কথায় বিরক্ত হচ্ছি না। তবে তোর আচরণে অবাক হচ্ছি। আমার ধারণা, তোর কোনো মেরুদণ্ড নেই। থাকলে নতুন বউ তোকে এভাবে নাজেহাল করার পরও তুই ফান করতে পারতি না।

-না আপা, তোমার এ কথা ঠিক নয়। আমার মেরুদণ্ড আছে। তুমি চাইলে ধরে দেখতে পারো।

-শোন, সব সময় ফাজলামি করবি না। একটু গম্ভীর হ। তোর দুলাভাইকে দেখে কিছু শেখার চেষ্টা কর। আমি কি তোর দুলাভাইয়ের সঙ্গে তাফালিং করার সাহস পাই? সে তো আমাকে দৌড়ের ওপর রাখে। সে যদি বলি রাত, তো রাত। যদি বলে দিন, তো দিন।

শোন, স্বামীকে হতে হয় শক্ত। তুইও তোর দুলাভাইয়ের মতো একজন শক্ত পুরুষ হ।
-আপা, তুমি যখন বলেছ, তখন অবশ্যই আমি একজন শক্ত পুরুষ হওয়ার চেষ্টা করব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমার কেন জানি মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি পুরুষই না। হা হা হা...
-হারামজাদা, তুই দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে। তোরে বুদ্ধি দিতে চাওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে। শোন, তোরে একটা সত্য কথা বলি, আমার ধারণা তোর মাথায় সমস্যা আছে, তুই ডাক্তার দেখা।

-আপা, তুমি কিন্তু কথাটা ভুল বলোনি। আমারও তা-ই ধারণা। ইদানীং মাথায় সব উদ্ভট চিন্তা আসতেছে। জানো আমি ঠিক করেছি কাক আর ইঁদুরের ভাষা শিখব। আচ্ছা কাক আর ইঁদুরের ভাষা জানে, তোমার জানাশোনা এমন কেউ আছে?
-হারামজাদা, তুই বাইর হ আমার রুম থেকে।

-আপা, তুমি রাগ করছ কেন? ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি। তবে যাওয়ার আগে তোমারে একটু জ্ঞানের কথা বলি। পুরুষের মেরুদণ্ড আছে কি না, তা দেখানোর জন্য দুনিয়ায় অনেক জায়গা আছে। সেটা সেখানেই দেখানো উচিত। ঘরে এসে বউয়ের ওপর খবরদারি করে, তাকে চাপের মধ্যে রেখে, ভয়ের মধ্যে রেখে, গায়ে হাত তুলে নিজের মেরুদণ্ডের প্রমাণ দিতে চাওয়াটা কাপুরুষের লক্ষণ। শোনো, আমাদের দেশের মেয়েদের চাওয়া কিন্তু খুব বেশি নয়। তারা কিন্তু পুরো গ্রাম, দেশ বা পুরো দুনিয়াকে দখলে নিতে চায় না। তারা শুধু চায় তার নিজের সংসারটা নিজের দখলে রাখতে। এই ছোট্ট সংসারটাই তার কাছে বিরাট এক রাজ্য। সে চায় তার এ রাজ্য তার মন মতো চলবে। স্বামী হিসেবে একটা পুরুষ কি এইটুকু ছাড় তার স্ত্রীকে দিতে পারে না? আপা শোনো, আমি জানি নিপা একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছে। যেটা আমার কাছেও কিছুটা অসহ্য মনে হয়েছে। যার কারণে আজ আমি শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে বিচার দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ফিরে আসার সময় মনে হলো, কাজটা আমি অন্যায় করেছি।

নিজের স্ত্রীর বিচার কেন আমি অন্যের কাছে চাইব? স্বামী যদি স্ত্রীর পাগলামি সহ্য না করে, তাহলে কে করবে? আপা শোনো, আমি চাই আমার সংসার রাজত্বে সর্বেসর্বা হবে আমার স্ত্রী। এ রাজ্য তার, এর রাজত্বও তার। আমি আর আমার ভবিষ্যৎ সন্তানেরা এ রাজ্যের প্রজা। এখন এতে যদি কারও মনে হয় আমার মেরুদণ্ড নেই, তাহলে নেই। আপা তোমার বাড়ি, গাড়ি, টাকাপয়সার কোনো অভাব নেই। তারপরও তুমি কি সুখী? তোমার সংসারটা কি আসলেই তোমার? ওই সংসারে তোমার কি কোনো গুরুত্ব আছে?
হঠাৎ করে খেয়াল করলাম, আপার চোখের কোনাটা চিকচিক করছে। সম্ভবত এখনই জল বের হয়ে আসবে। কারও কান্না দেখতে আমার ভালো লাগে না। তাই দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে এলাম।

নিপা ঘুম থেকে উঠেই আমাকে রুমে ডাকল। আমি রুমে যেতেই মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
-নতুন বউকে বাসায় একা রেখে কোথায় গিয়েছিলে?
আমি যে ওদের বাসায় গিয়েছিলাম, সেটা গোপন করে বললাম,
-ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে গিয়েছিলাম।

-কেন? তোমার কি শরীর খারাপ? কই দেখি তো, আবার জ্বরটর বাঁধালে কি না?
এ কথা বলে নিপা আমার কপালে হাত দিয়ে দেখল। এই প্রথম নিপা আমাকে স্পর্শ করল। আমি আবেগে গলে গিয়ে বললাম,
-না না, শরীর খারাপ করেনি। তুমিই তো বললে, আমার পুরো বডি টেস্ট করাতে হবে।
-থাক করা লাগবে না। আমার স্বামীর যে কোনো অসুখ নেই, সেটা আমি জানি। এই, তোমাকে না আজ অনেক সুন্দর লাগছে। কেমন জানি মায়াও লাগছে। ইচ্ছা হচ্ছে তোমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিই।

বলেই নিপা আমার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল। বুঝলাম না, হঠাৎ করে নিপার কী হলো? ও আজ এত রোমান্টিকভাবে কথা বলছে কেন? তবে যে কারণেই বলুক না কেন, নিপার এমন রোমান্টিক আচরণে আমার হৃদয়টা পুলকিত হয়ে উঠল। নিপা আবদারের সুরে বলল,
-এই, চলো না একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।

-কোথায় যাবে বলো?
-চলো বসুন্ধরা মার্কেটে যাই। কিছুক্ষণ ঘুরব, তারপর স্টার সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখব।
আমি সাধারণত হলে এসে মুভি দেখি না। কেন জানি হলে এলেই আমার ঘুম পায়। আজ পর্যন্ত হলে কোনো মুভি আমি পুরো দেখতে পারিনি।

বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখতে ঢুকলাম। সব আলো নিভে যেতেই নিপা আমার গা ঘেঁষে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। তারপর আমার হাতের ওপর তার কোমল হাতটি রাখল। নিপার এমন স্পর্শে আমার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। মনে হলো ভালো লাগার এক মিষ্টি বাতাস বয়ে যাচ্ছে আমার চারপাশে। আমি আবেগে নিপার হাতটি মুঠো করে ধরলাম। নিপা আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
-তুমি মুভি দেখো। আমি একটু রেস্টরুম থেকে আসছি।
-চলো আমিও তোমার সঙ্গে যাই।

-আরে না। তুমি কি আমার সঙ্গে মেয়েদের টয়লেটে ঢুকবে? তুমি বসো, আমি দুই মিনিটের মধ্যেই আসছি।

নিপা চলে গেল। আমি একা একা মুভি দেখতে লাগলাম। আসলে মুভি দেখলেও আমার মন আর মুভিতে নেই। আমি চোখ বন্ধ করে মনের জমিতে নিপাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে লাগলাম। আর এই স্বপ্নের মধ্যে ভাসতে ভাসতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারব না।

একটি ছেলে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠাল। চোখ খুলে দেখি সিনেমা শেষ। সবাই একে একে হল থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম কোথাও নিপা নেই।

মাই গড, তার মানে নিপা এখনো ফেরেনি? দ্রুত হল থেকে বের হলাম। আশপাশে সব জায়গায় নিপাকে খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না। হঠাৎ মনে পড়ল, আরে আমি নিপাকে ফোন দিচ্ছি না কেন? তাড়াতাড়ি নিপাকে ফোন দিলাম। কিন্তু নিপার ফোন বন্ধ। আমাদের বাসায় আর নিপার বাসায় ফোন দিলাম। না, নিপা ওই দুই জায়গার কোথাও যায়নি। তাহলে নিপা কোথায়? ও কি কোনো বিপদে পড়ল? আমি ঘামতে লাগলাম। সেই সঙ্গে চোখ দুটো ভিজে উঠল। হঠাৎ করে অনুভব করলাম, তিন দিনেই আমি এই পাগল মেয়েকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। নিজেকে এখন কেন জানি খুব অসহায় মনে হচ্ছে। ইচ্ছা হচ্ছে চিৎকার করে নিপাকে ডাকি। ডেকে বলি, নিপা তুমি কোথায়? তুমি কি ভালো আছ? চলবে...

বি. দ্র.: এটি একটি রম্য লেখা। এই গল্পে শিক্ষণীয় কিছুই নেই। সে জন্য সরি। অবশ্য সবকিছু থেকেই শিখতে হবে, এর তো কোনো মানে নেই তাই না?

*লেখক: ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
[email protected]

আরও পড়ুন