থমকে যাওয়া জীবন, মৃত্যুর আলিঙ্গনে-২৩
অ্যাম্বুলেন্সটাকে একটা ছোটখাটো হাসপাতাল মনে হচ্ছিল। আমার স্ট্রেচারটা ভালো করে বাঁধা হয়েছে বিছানার সঙ্গে। ওরা তড়িৎগতিতে আমাকে নিয়ে চলল বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে। ততক্ষণে আমার আবারও অক্সিজেন মাপা হলো, ইসিজি করা হলো। এ দেশের অ্যাম্বুলেন্স চলে ঝড়ের গতিতে, কোনো সিগন্যালে না থেমে। নিয়ম হচ্ছে, রাস্তার সব গাড়ি অ্যাম্বুলেন্স দেখলে রাস্তার এক পাশে সরে যাবে। আধা ঘণ্টার রাস্তা দশ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম।
তাড়াতাড়ি একটি রুমে ঢুকিয়ে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হলো। এক নার্স এসে নিজের পরিচয় দিয়ে আমাকে বললেন, ‘আপনার কেমন লাগছে?’
-শরীরব্যথা, মাথাব্যথা।
-কোভিড নার্স আসছেন, আপনার কোভিড টেস্ট করবেন। আপনার শীত করছে?
–হ্যাঁ, একটা কম্বল দিন।
একটা ওম ওম গরম কম্বল পেঁচিয়ে দিলেন আমার শরীরে। হাসপাতালের এই গরম কম্বল আমার ভীষণ ভালো লাগে। রোগীর শরীরে এই কম্বল জড়িয়ে দিলে রোগী ভীষণ আরাম আর আন্তরিকতা অনুভব করে। একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হলো, কেমন করে এসব কম্বল গরম রাখে তারা! জিজ্ঞেস করা হয় না, তবে আরামে চোখ বন্ধ করি। ততক্ষণে শুরু হয়ে গেল বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
একেকজনের একেক কাজ, কেউ নিলেন রক্ত, কেউ খাওয়ালেন পানি, কেউ এসে কোভিড পরীক্ষা করলেন। এটা হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। এখানে রোগীর প্রাথমিক সব পরীক্ষা যত দ্রুততার সঙ্গে করা হয়, আর কোথাও তা হয় না। পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে তারপরই ডাক্তার এসে দেখেন।
এক নার্স এসে বিছানা টেনে এক্স–রে রুমে নিয়ে গেলেন। বুকের আর ফুসফুসের পরীক্ষা করা হবে। বাকি সবাই তাঁদের যন্ত্রপাতি নিয়ে আমার রুমে চলে এসেছিলেন। হয়তো এক্স–রে মেশিন টেনে আনা যায় না।
ফোন বাজছিল আমার, নার্সকে বেল টিপে ডাকলাম। তিনি পিপিই পরে ঢুকে আমাকে মুঠোফোনটা বের করে দিয়ে গেলেন। মুখে হাসি। এ দেশে হাসিটা চাকরির অংশ। এসব দেশে রোগীকে একাই রাখা হয় হাসপাতালে, কোনো অ্যাটেনডেন্ট থাকে না। কিন্তু এতে কোনো সমস্যা নেই। হাসপাতালের কর্মচারী, নার্স, ডাক্তার সবাই এমন মধুর ব্যবহার করেন, মনে হয় যেন রোগী সেই হাসপাতালের বিশেষ কোনো ব্যক্তি কিংবা এমপি মর্যাদার কেউ।
মেয়েটি ঠিক ছয় ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আলো–আঁধারি ঘরে ওকে দেখে চমকে উঠলাম। রোদেলা না তো?
রোদেলার মতো দেখতে শ্যামলা মেয়েটি এসে আমার পাশে দাঁড়াল।
‘আমি ডিউটি ডাক্তার, কী হয়েছে আপনার?’
আমার ভ্রম কেটে গেছে তখন। একটু দম নিয়ে বললাম, ‘বুকে ব্যথা ছিল, মাথাব্যথা। কোভিড হয়েছে মনে হয় আমার।’
—আপনার হার্টরেট ভালো। রক্ত পরীক্ষার ফলাফল এলে আবার আসব আমি। এখন টাইনোরেল খান। আর স্যালাইন নিতে হবে।
মায়া মায়া চেহারার শ্যামলা মেয়েটি চলে গেল মিষ্টি হেসে।
আমি আবারও চোখ বুঝলাম। মুঠোফোনটা এখন হাতের কাছে নেই, তাই সময় বুঝতে পারছি না। এখানে কোনো জানালা নেই, শুধু সামনের দরজা দিয়ে নার্সদের টুকটাক কথোপকথনের শব্দ কানে আসছে।
কিছুক্ষণ পর আবারও এল সে। বলল, ‘রেজাল্ট সবই ভালো। তারপরও সবকিছু আবার পরীক্ষা হবে। দ্বিতীয়বারও একই রেজাল্ট এলেই বাসায় যাবেন।’ সবকিছু দুবার পরীক্ষা করবে, ডাক্তার জানালেন। তার মানে, এটাই নিয়ম হয়তো এখানে।
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে।’
আজ সারা রাত এখানেই থাকতে হবে বুঝতে পারছিলাম।
মুঠোফোনে চোখ রাখতে পারছিলাম না, ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। ঘুম ঘুম পাচ্ছিল খুব। আমি কাত না হয়ে ঘুমাতে পারি না। কিন্তু এক হাতে স্যালাইনের তার, অন্য পাশে মনিটরের তার। ঘুমাতে কষ্ট হচ্ছিল। তারপরও ঘুমে চোখ বুজে আসছিল। কখন ঘুমিয়েও পড়লাম। একসময় ডাক্তার এসে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন,
‘আপনার সব রেজাল্ট ভালো। বাসায় যান আজ। খারাপ লাগলে আবার চলে আসবেন।’
আনন্দিত গলায় বললাম, ‘তাই! ধন্যবাদ আপনাকে।’
তিনি হাসলেন, বাই বলে চলে গেলেন। আমি আমার নিজের জামাকাপড় পরতে পরতে ভাবছিলাম, বাসায় কীভাবে যাব? এখন বাজে ভোর পাঁচটা। এজাজ নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে। ট্যাক্সি ডাকব? কিন্তু ট্যাক্সিওয়ালাকে জেনেশুনে করোনার ভাইরাস দেওয়া কি ঠিক হবে? আমি সাসপেকটেড করোনা রোগী। আমি কীভাবে ট্যাক্সিতে উঠব? এজাজকে ফোন দিলাম। সে একবার রিং হতেই ফোন ধরল, ‘কী অবস্থা? কী বলছে ওরা?’
—ভালো বলেছে, কোনো সমস্যা নেই। বাসায় যাব কেমন করে? ট্যাক্সি ডাকা ঠিক হবে?
—না, ট্যাক্সিচালকের যদি করোনা হয়? আমিই আসি।
—তোমার খারাপ লাগছে না?
—একটু তো লাগছেই। তবু অন্য আরেকজনকে জেনেশুনে ভাইরাস দেওয়াটা তো অন্যায়।
আমি পোশাক পরে আলো-আঁধারি ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। এক নার্স এগিয়ে এলেন, ‘চলুন আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাই।’ অদ্ভুত পোশাকে আবৃত নার্স হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে।
‘আপনাকে অনেক দুর্বল লাগছে, আমার হাত ধরুন।’ যখন মূল ফটকে এলাম, কাচের দরজা দিয়ে তাকিয়ে লাল আভা মাখা আকাশটা দেখে মন ভালো হয়ে গেল।
নার্সকে বিদায় দিলাম।
এখন ২০২০ সাল। জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো হাসপাতালে থাকলাম সারা রাত। মোটামুটি আদর-যত্নেই রাতটা কাটালাম। এখন থেকে বিশ বছর আগে ২০০০ সালে এমনই এক সকালে নিজের দেশের আরেকটি হাসপাতালে রাত কাটিয়ে বের হয়ে এসেছিলাম। রোদেলার জন্মের সময়। সেই সময়কার বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত প্রাইভেট হাসপাতালে রাত কাটিয়েছিলাম। আমার কন্যা রোদেলার শরীরে জটিলতা তৈরি হওয়ায় সেই বিখ্যাত হাসপাতালের ইনকিউবেটর থেকে জোর করে বের করে তাকে অন্য একটা হাসপাতালের ইনকিউবেটরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাকেও সেখানে ট্রান্সফার করা হয়েছে। আমার চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়েছে নার্স আর আয়ার দল। এখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার আগে তাঁদের বকশিশ দিতে হবে। এরপর এজাজের হাতে এক লাখ টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হলো। ২০০০ সালে এক লাখ টাকা অনেক টাকা।
আজ কানাডার অনেক উন্নত এবং গুণগত মানে বিশ্বসেরা হাসপাতাল থেকে বের হলাম। শুধু একটি হেলথ কার্ডের বিনিময়ে সবকিছু পরীক্ষা করিয়ে মোটামুটি জামাই–আদর নিয়ে এখন বিনে পয়সায় বাসায় ফিরছি। টাকা ছাড়া চিকিৎসার আনন্দ অনেক আরামের আর শান্তির।
এজাজ চলে এসেছে, আমি গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। এই বরফ ঝরা সকালের রাস্তা একদম ফাঁকা। আমরা দুই করোনা রোগী একদমই চুপচাপ। কথা বলতে ভালো লাগছিল না। বরফের গুঁড়ো মুক্তোদানার মতো এসে পড়ছে গাড়ির কাচে। বরফের ছোট্ট কণা—সাদা, নরম। কেমন আহ্লাদী ঢঙে বরফের মুক্তোদানা ছড়িয়ে পড়ছে প্রকৃতির মধ্যে। প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় খেলার মতো আমার জীবনের ছন্দও বদলে গেল যেন এই মুহূর্তে। প্রবাসী জীবনের অনেক হতাশা আর বেদনার সঙ্গে কিছু প্রাপ্তি তো আছেই। জীবনযুদ্ধে এই যে চমৎকার একটি সেবা পেয়ে প্রচণ্ড সন্তুষ্টি নিয়ে ঘরে ফিরছি, কানাডার মতো দেশের প্রবাসী না হলে এমনটি হয়তো হতো না। বেঁচে থাকার চেয়ে আনন্দের আর কী আছে জীবনে! এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, জীবন কিন্তু অনেক বেশি আশাময়ও হয়।