থমকে যাওয়া জীবন, মৃত্যুর আলিঙ্গনে-২২
কোভিড সেন্টারে পৌঁছে দেখি লম্বা গাড়ির লাইন। সেন্টারের দরজা পর্যন্ত যেতে হলে অনেক সময় লাগবে। আমার সামনে প্রচুর গাড়ি। হয়তো চার-পাঁচ ঘণ্টা গাড়িতে বসেই অপেক্ষা করতে হবে। আজ পুরো শহর কি ভেঙে পড়েছে কোভিড সেন্টারে? শহরে প্রতিদিন তিন শ, চার শ রোগীর কোভিড হচ্ছে। এমনি শরীর ভীষণ ক্লান্ত, জ্বরজ্বর অনুভূতি। ভীষণ মাথাব্যথা। দুর্বলতাও জেঁকে বসেছে। এতক্ষণ গাড়িতে বসে থাকা ভীষণ এক কঠিন কাজ মনে হলো। ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিলাম ফিরে আসার। কাল সকালে না হয় আবার যাব। আবার গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফেরা ভীষণ কঠিন মনে হচ্ছিল।
স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়ে শক্ত করে বসে আছি। বারবার মনে হচ্ছিল যেকোনো সময় গাড়ি অন্য লেনে চলে যাবে। মাথাটা ঘোরাচ্ছে। একটু যদি স্টিয়ারিংয়ে মাথা রেখে চুপ করে শুয়ে থাকতে পারতাম।
কোনো রকমে মনের জোরে বাসায় ফিরলাম। বাসায় এসে দেখি এজাজ ঘরের মেঝে পরিষ্কার করছে। আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘কী ব্যাপার, তোমার না বিশ্রাম নেওয়ার কথা, এখানে কী করো?’
‘আমি ভালো হয়ে গেছি।’
গলা ভাঙা কণ্ঠে বললাম, ‘ভালো হলে কেমন করে?’
সে হেসে বলল, ‘আজ অনেক শক্তি পাচ্ছি শরীরে।’
‘কী বলো?’ আমি ক্লান্ত কণ্ঠে খয়েরি রঙের সোফাটায় বসতে বসতে বললাম।
সে মহা উৎসাহে ঘরবাড়ি গোছাতে লাগল। বাইরে থেকে ঘরে ঢুকলেই বোঝা যায় পুরো বাসায় অনেক দিন যত্নের হাতে স্পর্শ করেনি কেউ। কেউ ছোঁয়ায়নি ভালোবাসা।
বাড়িঘর এক সপ্তাহেই ধুলা জমে একাকার। ডাইনিং টেবিলে মাছের ঝোল আর ডালের পানির হলদেটে রং বিচ্ছিরি এক বিদঘুটে মানচিত্র তৈরি করেছে। টবে লাগানো গাছের পাতারা নিচের দিকে হলদে রং নিয়ে জন্ডিস রোগীর মতো ধুঁকছে। রান্নাঘরে কাউন্টার টপের মার্বেল পাথরেও কাঁচা সবজির রসে ফ্যাকাশে এক আজগুবি রঙে ধরেছে।
এ বাসায় কাল রাতে ছোট বোন শীলা খাবার পাঠিয়েছে। এজাজ সব খাবার মাইক্রো ওভেনে গরম করে টেবিলে সাজিয়েছে। অনেক ধরনের মাছ ভাজা, ভর্তা আর সবজি চিংড়ি। আমি লেবু ডলে মাছ ভাজা সবজি খেলাম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল, বিছানায় চলে এলাম। কম্বল মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুতেই বুকের পাশে ব্যথা শুরু হলো। আমি পাত্তা না দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
রাত বাজে দুইটা। ঘুমাতে পারছি না। নাকটা জ্বলছে, কিছুটা অস্বস্তি। বুকের ভেতর বেশ চাপ চাপ ব্যথা। বিছানায় উঠে বসলাম। তবু ব্যথা কমে না। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি হেলথের ৮১১ নম্বরে ফোন দিলাম।
ওপাশে নার্স ধরল। তাকে বললাম, ‘আমার বুকে একটু ব্যথা। কী করব?’
সে বলল, ‘৯১১ ফোন করো। এক্ষুনি ফোন করো। তুমি পারবে, নাকি বাসায় কেউ আছে?’
‘আছে, ওকে, রাখি।’ ফোন রেখে ভয় করতে শুরু করল।
আসলে আমি কি মারা যাচ্ছি। ৯১১–এর অভিজ্ঞতা আমার আরেকবার হয়েছিল, যখন গাড়ি দুর্ঘটনা হয়েছিল। এখন বাসায় ডেকে আনব কি আনব না বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু ব্যথাটা বাড়ছেই। আমি পাশে রাখা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ঠক করে দুই দাগ খেয়ে ফেললাম। ভাবলাম দেখি কী হয়। ওষুধে কাজ হতে সময় লাগে। আমি আবারও ৮১১–তে ফোন দিলাম।
একই নার্স ফোন ধরল। সে কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বলল, ‘তুমি এখনো ৯১১–তে কল করোনি?’
আমি ভয় পেয়ে বললাম, ‘ওকে, এক্ষুনি ডাকছি। শোন, আমার মনে হয় কোভিড হয়েছে।’
‘তুমি ৯১১–তে কল করো এক্ষুনি।’
৯১১–তে কল করার পর ওরা ঠিকানা চাইল। আমি ঠিকানা দেওয়ার চার মিনিটের মধ্যে তিন সদস্যের টিম দরজার বেল বাজাতে লাগল। বেলের শব্দে এজাজ উঠে গেল। আমি লিভিং রুমের সোফায় বসে আছি। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল—
‘কী হয়েছে? কে বেল টেপে?’
আমি বললাম, ‘অ্যাম্বুলেন্স।’
এজাজ তার ছোট চোখ বড় করে ভীত চোখে বলল, ‘কেন, কী হয়েছে তোমার?’
‘আগে দরজা খোল।’
এজাজ সিঁড়ি বেয়ে নেমে দরজা খুলতেই দ্রুত গতিতে আজব পোশাকে তিনজন গটগট করে ওপরে উঠে এল। এসেই আমাকে শুইয়ে দিল সোফায়। শুরু হয়ে গেল তাদের কাজ। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অক্সিজেন লেভেল আর জ্বর মাপা, প্রেশার পরীক্ষা, ব্লাড সুগার চেক করা শেষ। ইতিমধ্যে ইসিজির যন্ত্র বের করে একবার ইসিজিও করল।
নভোচারীদের মতো পোশাক পরা মেয়েটি নিজেই ডাইনিং টেবিলে রাখা আমার ওষুধের ব্যাগ বের করে দেখে নিল আমি কী ওষুধ খাই।
ছেলেটা বলল, তোমার সব রেজাল্ট তো ভালো। তুমি কি যাবে হাসপাতালে?
ততক্ষণে আমার নিজেরও একটু সুস্থ লাগছে। আমি বললাম, ‘বুঝতে পারছি না কী করব? যাব? তোমরা কী বলো।’
‘তোমার ইচ্ছা।’
আমি ওদের শরীরের ফাঁক গলে ওপাশের দরজার সামনে চেয়ার নিয়ে বসা এজাজের দিকে তাকালাম।
এলোমেলো চুলে, খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে। সাদা-কালো একটা দাগ কাটা মাফলার নাকে, মুখে বেঁধে কুঁজো হয়ে বসে আছে। বুঝতে পারলাম না বাসায় এত মাস্ক থাকার পরও লোকটা কেন নাকে মাফলার পেঁচিয়ে বসে আছে। ভীষণ বিরক্ত লাগছে ওর নাকে মাফলার বাঁধা চেহারার দিকে তাকিয়ে। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকা দুই চোখের দিকে তাকিয়ে ভীষণ বিরক্তি নিয়েই বললাম, ‘কী করব বল তো?’
ওরা তিনজনও তাকাল এজাজের দিকে। সে কিছু বলল না, কেমন অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকল। বেচারা ঘুম থেকে উঠে হয়তো বুঝে উঠতে পারছিল না, কী হচ্ছে। বুঝতে পারলাম নিজের সিদ্ধান্ত নিজেরই নিতে হবে।
ছেলেটা বলল, ‘হাসপাতালে গেলে অবশ্য তোমার ব্লাড চেক হবে। আরও ভালো করে পরীক্ষা করা যাবে সব। আমি এক মুহূর্ত ভাবলাম, বললাম, ‘আমাকে নিয়ে যাও।’
‘তোমার মোবাইলটা নাও সঙ্গে।’
‘আর কিছু লাগবে না?’
‘না, ওখানেই সব পাবে। শুধু মোবাইল আর চার্জারটা নাও, তোমার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য।’
আমি কাঁধে ঝোলানো ছোট্ট চামড়ার ব্যাগে মোবাইল আর চার্জারটা ঢুকিয়ে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই স্ট্রেচারে শুইয়ে দুজন আমাকে তুলে নিয়ে বাইরে বের করল।
আজ এক সপ্তাহ পর বাইরে বেরিয়েছি। প্রাণভরে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিলাম। কী নির্মল এই বাতাস। নিচে বরফের চাদরে ঢাকা শুভ্র পৃথিবী। ওপরে নীল আঁচলের নীলিমাময় হাজার বুটির তারায় ঝিকমিক করছে অসীম আকাশ। তার বিশালতার মুগ্ধতায় আমি ভেতরে ভীষণ রকম হাহাকার অনুভব করলাম। এমন চমৎকার মায়াবী রাতে কিনা আমাকে যেতে হচ্ছে হাসপাতালে। আমার কিছুই হয়নি ওরা বলল। তারপরও মনে হচ্ছিল, এই যে চমৎকার জ্যোৎস্না ভরা শীতের রাতের দূর আকাশের তারা, তাদের কাছেই আমার শেষ গন্তব্য না তো আজ?
সেই যে আমার সবচেয়ে প্রিয়, মায়া ভরা কালো চোখের মেয়েটি, যার চোখের মায়ায় এ পৃথিবীকে ভীষণ মায়াময় মনে হয়। যে থাকে তিন হাজার মাইল দূরে, তার সঙ্গে হবে কি আর দেখা? আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটির সঙ্গে? আর কখনো? চলবে...